বাংলাদেশে করোনার নতুন রূপ, সংশয়ে ভ্যাকসিনের ‘কার্যকারিতা’!

0

বাংলাদেশে নভেল করোনা ভাইরাসের নতুন মিউটেশন পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) ল্যাবে দেখা গেছে কোভিড-১৯’র নতুন এই রূপবদল। এ পর্যন্ত পৃথিবীতে পি৬৮১আর নামের এই মিউটেশনটি পাওয়া গেছে সাতবার। এর মধ্যে পাঁচবারই পাওয়া গেছে বাংলাদেশে এবং এগুলো রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। 

বিসিএসআইআর’র বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি নিয়ে আরও অনেক গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। খুব দ্রুতই আন্তর্জাতিক জার্নালে এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ হবে। এই মিউটেশনটির ফলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে কিছুটা সংশয় থেকে যায়। কারণ বিশ্বের প্রায় সব ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ডি৬১৪জি মিউটেশনকে প্রাধান্য দিয়ে টিকা তৈরি করছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পি৬৮১আর এখন পর্যন্ত তেমনভাবে কোথাও দেখা যায়নি। তাই এটি এক ধরণের সাইলেন্ট মিউটেশন হতে পারে।

চলতি বছরের ৬ সেপ্টেম্বর বিসিএসআইআর মিলনায়তনে জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবরেটরির কোভিড-১৯ এর জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রতিবেদন অবহিতকরণ সভায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আফতাব আলী শেখ জানান, বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কোভিড-১৯ অনেক দ্রুতগতিতে রূপ পরিবর্তন করছে। বিশ্বে এ পরিবর্তনের হার ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। এখন পর্যন্ত দেশে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ, মিউটেশনের হার, জিনগত বৈশিষ্ট্য, নন-সিনোনিমাস মিউটেশন এবং জেনোমিক ফাইলোজেনি পর্যবেক্ষণ করে পাঁচ ধরনের স্বতন্ত্র করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। যা বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যায়নি।

গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সংগৃহীত নমুনায় শতভাগ ক্ষেত্রে আধিপত্যকারী ভ্যারিয়েন্টের জি ৪১৪ (স্পাইক রুটিনে ৬১৪তম অবস্থানে অ্যাসপার্টিক গ্লাইসিন হওয়ার কারণ) উপস্থিতি পাওয়া যায়। দেশে করোনাভাইরাস রূপ বদলেছে ২৬৩ বার। ডি৬১৪জি মিউটেশনের মাধ্যমে সংক্রমণ বেশি, তবে জটিলতা তৈরি করে কম। নতুনভাবে পাওয়া পি৬৮১আর নামের এই মিউটেশনটির কারণে সংক্রমণের তীব্রতা ও মৃত্যুঝুঁকি এখনও জানা না গেলেও এটি দেশে কতটুকু ছড়িয়েছে তা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান বিসিএসআইআর’র জিনোমিক ল্যাবের প্রকল্প কর্মকর্তা ড. সেলিম খান।

বিসিএসআইআর’র জিনোমিক ল্যাবের প্রকল্প কর্মকর্তা ড. সেলিম খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা দেশের কোভিড-১৯ নিয়ে নানাধরনের গবেষণা করে যাচ্ছি। এর মধ্যে আমরা যে নতুন মিউটেশন পেয়েছি তা আন্তর্জাতিক জার্নালে আপলোড করার জন্য দিয়েছি। সেক্ষেত্রে আপলোড হওয়ার পরে ডাটাব্যাংক থেকে যারা ভ্যাকসিন বানাচ্ছে তারা অবশ্যই সেটি তাদের ধারণাতে নেবে। এটা নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা নাও হতে পারে। কিন্তু আমাদের সমস্যা হবে অন্য ক্ষেত্রে। আমরা আগে যে ডি-৬১৪ মিউটেশন পেয়েছি সেটি অনেকদিন ধরেই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। যেটাকে অনেকেই ভাবছেন দুর্বল হয়ে গেছে। আমরা পুরো বিশ্বে পি৬৮১আর পেয়েছি সাতটা। তার মধ্যে বাংলাদেশেই পেয়েছি পাঁচটা। বাকি দুইটার একটি পেরুতে ও অপরটি রাশিয়াতে পাওয়া গেছে। এগুলো পাওয়া গেছে অক্টোবরের মধ্যেই। এটা আসলে কতটা ক্ষতিকর বা কতটুকু ছড়িয়েছে তা নিয়ে আরও অনেক গবেষণা প্রয়োজন। এটি নিয়ে আমরা গবেষণা করে করে যাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘স্পাইক প্রোটিন থেকে যেকোনো মিউটেশনই খারাপ। যারা ভ্যাকসিন বানাচ্ছে তাদের একটি গবেষক দল বসেই থাকে কোনো দেশ থেকে নতুন কোনো মিউটেশন পাওয়া যাচ্ছে কি-না তা দেখার জন্য। নতুন কিছু পাওয়া গেলে তখন তারা সে হিসেবে পরিকল্পনা করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে ডি৬১৪জি মিউটেশন অনেক ক্ষেত্রেই হয়তোবা দুর্বল হয়ে গেছে। যে কারণে মৃত্যুর হার কম। কিন্তু নতুন যে মিউটেশন পেয়েছি সেটার ক্ষেত্রে নতুন কোনো উপসর্গ দেখা যাবে না-কি সাইলেন্ট থাকবে- তা নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের দেশে দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ আক্রান্ত উপসর্গহীন থাকছে। সেক্ষেত্রে অনেকেই নমুনা পরীক্ষার বাইরে থাকছেন। এখন নতুন এই মিউটেশনের কারণে নতুন কোনো উপসর্গ দেখা যায় কি-না তা গবেষণার বিষয়।’

ড. সেলিম খান বলেন, ‘আমরা গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। কোনো কিছু নিয়ে পরিপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে গেলে প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ গবেষণা। আমরা চেষ্টা করছি আরও সাত থেকে আটশত নমুনা পরীক্ষা করে গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার। চেষ্টা করব মার্চ মাস পর্যন্ত এই কাজ চালিয়ে যেতে। কিছু সীমাবদ্ধতা আমাদের অবশ্যই আছে। আর তাই আমরা সেগুলো দূর করে সামনের দিনগুলোতে কাজ করে যাব।’

তিনি বলেন, ‘যেকোনো মিউটেশন সাধারাণত খারাপ কিছুরই লক্ষণ হয়ে থাকে। এটা স্পাইক প্রোটিন। আমরা যে পাঁচটি নমুনা পেয়েছি তার সবই ঢাকার। রাজধানীর কোন কোন এলাকা থেকে এই মিউটেশন পাওয়া গেছে তা এখন অজানা। এক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা সুবিধা হতো এটি নিয়ন্ত্রণ করার।’

বিসিএসআইআরের জিনোমিক ল্যাবের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুরশেদ হাসান সরকার বলেন, ‘সারাবিশ্বে যে ভ্যাকসিনগুলো তৈরি হচ্ছে তার প্রায় সবই তৈরি হচ্ছে স্পাইক প্রোটিনকে কেন্দ্র করে। এটি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন ভ্যাকসিন তৈরি করা হয় তখন অবশ্যই এটা দেখতে হবে যে, এই মিউটেশনের কারণে ভাইরাসের এন্টিজেনিক কোনো প্রোপার্টিজ পরিবর্তন হচ্ছে কি-না। সেক্ষেত্রে ভ্যাকসিন তৈরিতে এটি আমাদের দেশ এবং সারাবিশ্বের জন্য বড় ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের গবেষণার পাঁচটি নমুনায় পি৬৮১আর মিউটেশন পেয়েছি। এক্ষেত্রে স্পাইক প্রোটিনের অ্যামাইনো এসিড সিকোয়েন্সের ৬৮১তম স্থানে প্রোলিনকে প্রতিস্থাপন করেছে আরজিনিন। আমরা আশা করছি, দ্রুত এটি নিয়ে আরও গবেষণা করা যাবে। গবেষণার পরই এটি নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে। খুব দ্রুতই আন্তর্জাতিক জার্নালে এই গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করা হবে।’

একমাত্র দেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) বিভাগের প্রধান ড. আসিফ মাহমুদ নতুন এই মিউটেশন বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সারাবিশ্বেই সাধারণত ডি৬১৪জি মিউটেশনকে লক্ষ্য করেই ভ্যাকসিন তৈরির কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে যদি বাংলাদেশে নতুন কোনো মিউটেশন পাওয়া যায় তবে সেটিকেও গুরুত্ব দেওয়া হবে। এই মিউটেশনের বিষয়ে আরও জানার চেষ্টা করতে হবে। আশা করব, খুব দ্রুত এই মিউটেশন বিষয়ে করা গবেষণা আমরা কোনো আন্তর্জাতিক জার্নালে দেখতে পাব।’

নতুন এই মিউটেশন বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেন্ট্রাল ফর মেডিক্যাল বায়ো-টেকনোলজি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মারুফুর রহমান অপু গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পি৬৮১আর মিউটেশনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কেননা ৬৮১ পজিশনটি স্পাইক প্রোটিনের ফিউরিন ক্লিভেজ সাইটের অংশ। এখানে পি অর্থাৎ প্রোলিন থাকলে এই জায়গাটিতে ভেঙে যাওয়া সুবিধাজনক হয়। ফলে ভাইরাসটি সহজে দেহকোষে ঢুকে যেতে পারে। তাই এখানে কোনো পরিবর্তন হলে ভাইরাসটির কার্যকারিতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘এছাড়াও এই জায়গাটি সিডি৮+ ইমিউন এপিটোপ’র অংশ এবং আইজিএম অ্যান্টিবডির একটি বাইন্ডিং সাইটও এটি। ফলে এখানে কোনো পরিবর্তন হলে অ্যান্টিবডির বাইন্ডিং পরিবর্তিত হতে পারে এবং সেটি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এই ছোট একটি পরিবর্তন আসলে কত বড় ভূমিকা রাখবে সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়। এজন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের জন্য তাই মাস্ক পরিধান ও সোশাল ডিসটেন্সিংয়ের কোনো বিকল্প নেই।’

ভ্যাকসিনের কার্যকারিতায় নতুন এই মিউটেশনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা কম জানিয়ে প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী  বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ গবেষণা পত্র না দেখে আসলে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে যদি কোনো মিউটেশন পাওয়া গিয়ে থাকে আশা করি খুব দ্রুতই কোনো জার্নালে প্রকাশ হবে। তবে যে মাত্রার মিউটেশন বলা হচ্ছে হতে পারে তা এন্টিজেন্সিটি পরিবর্তন করতে পারে এমনটি নাও হতে পারে। হতে পারে এটি এক ধরণের সাইলেন্ট মিউটেশন। তাই পূর্ণাঙ্গ গবেষণা ফলাফল না দেখে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’

ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) অন্যতম উপদেষ্টা ও প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসা সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যেকোনো গবেষণা কাজকেই আমাদের স্বাগত জানানো উচিত। যত বেশি গবেষণা হবে, ততই এই ভাইরাসের ধরণ সম্পর্কে জানা যাবে। বিসিএসআইএর’র যে নতুন মিউটেশন পাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটি পূর্ণাঙ্গভাবে জার্নালে প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত কোনো মন্তব্যে যাওয়া ঠিক হবে না। তবে গবেষকরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে আমি তাদের সাধুবাদ জানাই।’

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com