আধুনিক শিক্ষার দৌড়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ
সময়ের হাত ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আসছে নতুনত্ব। শিক্ষার্থীদের আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা দিতে কাঁধ থেকে নামানো হচ্ছে বইয়ের বোঝা, কমছে পরীক্ষার চাপ। জোর দেওয়া হচ্ছে দক্ষতা আর কর্মমুখী শিক্ষার ওপর। করোনা মহামারির মধ্যেই পাশের দেশ ভারতে নতুন শিক্ষানীতির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সেখানে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ১৫ বছরে মাত্র পাঁচটি পরীক্ষা রাখা হয়েছে। অর্থাৎ বছর বছর পরীক্ষার টেবিলে বসতে হচ্ছে না দেশটির শিক্ষার্থীদের। অথচ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেন উল্টো পথে হাঁটছে। আধুনিক শিক্ষার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। মাসে মাসে পরীক্ষা আর বইয়ের বোঝায় খাবি খাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা সারা দিন-রাত ছুটছে স্কুল, প্রাইভেট, কোচিং আর নোট-গাইডের পেছনে। ফলে মুখস্থনির্ভর পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকছে তারা। অভিভাবকরাও থাকছেন ‘জিপিএ ৫’ স্বপ্নে বিভোর। এর ফলে বেশির ভাগ অভিভাবকই সন্তানদের পড়াশোনায় চাপ দিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই হয়ে গেছে পরীক্ষানির্ভর। মনে করা হয়, পরীক্ষায় বেশি জিপিএ পেলেই শিক্ষার মান বাড়বে। কিন্তু এটা মোটেই ঠিক নয়। পড়াশোনাটা শ্রেণিকক্ষে নিয়ে আসা উচিত ছিল। যাতে গাইড, কোচিং ও প্রাইভেটের প্রয়োজন না হয়। পরীক্ষার চাপে আমাদের শিক্ষার্থীদের ঘরের জীবন ও স্কুলের জীবন দুটোই নিরানন্দ হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, স্কুল শেষে একটাই পরীক্ষা থাকা উচিত ছিল। সৃজনশীল আমাদের শিক্ষাকে অপরিচ্ছন্ন করে ফেলেছে। অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী—কেউ তা বোঝে না। সবাই নোট-গাইডনির্ভর হয়ে পড়েছে।’
ভারতের নতুন শিক্ষানীতিতে সব স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষা, স্থানীয় বা আঞ্চলিক ভাষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিদেশি ভাষা শিক্ষা শুরু হবে মাধ্যমিক স্কুল থেকে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ইন্টার্নশিপসহ কারিগরি শিক্ষার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ১২ বছরের স্কুলশিক্ষার আগে তিন বছরের প্রাক-স্কুল রাখতে বলা হয়েছে। স্কুল শিক্ষার্থীদের প্রতি বছর পরীক্ষার বদলে তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে তিনবার পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে। বোর্ড পরীক্ষা আগের মতোই দশম ও দ্বাদশ শ্রেণিতে অনুষ্ঠিত হবে। পরীক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর বিশ্লেষণ, চিন্তার সক্ষমতা এবং ধারণা স্পষ্টকরণের সক্ষমতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
ভারতের শিক্ষানীতি অনুযায়ী, চার বছর মেয়াদি স্নাতক প্রগ্রামগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের বেরিয়ে যাওয়ারও একাধিক সুযোগ দেওয়া হবে। দুই বছর পর শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে যেতে চাইলে পাবে ডিপ্লোমা ডিগ্রি। আর এক বছরের মাথায় বেরিয়ে গেলে ভোকেশনাল বা পেশাজীবী কোর্সের ডিগ্রি দেওয়া হবে।
বাংলাদেশে ২০১০ সালে প্রণীত হয় সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি। কিন্তু ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও তেমন একটা বাস্তবায়ন হয়নি শিক্ষানীতি। ফলে কাগজে-কলমেই বন্দি শিক্ষার আধুনিকায়ন।
এ ব্যাপারে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চার-পাঁচটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন হয়েছে। কিন্তু একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। তবে ২০১০ সালের শিক্ষানীতি জাতীয় সংসদে পাস হয়েছিল। এ জন্য এটা ছিল জাতীয় শিক্ষানীতি। কিন্তু এটা বাস্তবায়ন না হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা, অভিন্ন কারিকুলাম, শিক্ষা কমিশনের মতো বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের সুপারিশ ছিল। এগুলো বাস্তবায়ন হলে শিক্ষার চেহারা কিছুটা হলেও পাল্টে যেত। এমনকি নীতি বাস্তবায়নের জন্য যে শিক্ষা আইন দরকার, সেটিও ৯ বছরেও হয়নি।’
জাতীয় শিক্ষানীতিতে দুই বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছিল। এ ছাড়া অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা এবং দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। শিক্ষক নিয়োগসহ তাঁদের উন্নয়নের জন্য আলাদা কমিশন গঠন ও কারিগরি শিক্ষায় জোর দেওয়া হয় শিক্ষানীতিতে। আর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তৃতীয় শ্রেণি থেকে পরীক্ষা শুরু করতে বলা হয়। অষ্টম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়।
জানা যায়, দেশে এখন প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা এক বছরের। আগামী বছর থেকে দুই বছরের প্রাক-প্রাথমিকের পাইলটিং শুরু হবে। প্রাথমিকের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বাংলার পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পাঁচটি ভাষায় পাঠ্য বই প্রণয়ন হলেও তা ঠিকমতো পড়ানোর মতো শিক্ষক নেই। প্রাথমিক শিক্ষা এখনো রয়ে গেছে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণি শেষে শিশুদের বসতে হয় বড় দুটি পরীক্ষায়। এরপর দশম ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা তো আছেই। প্রত্যেক শ্রেণি শেষে অনুষ্ঠিত হয় বার্ষিক পরীক্ষা।
কারিগরি শিক্ষায়ও শিক্ষার্থীদের আগ্রহ তেমনভাবে তৈরি করা যায়নি। কাগজে-কলমে শিক্ষার্থীর হার বাড়লেও বাস্তবে রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। দক্ষতা অর্জন ছাড়াই কারিগরি শিক্ষা শেষ করছে শিক্ষার্থীরা। বেশির ভাগ কারিগরি প্রতিষ্ঠানেই ব্যাবহারিকের সুযোগ নামকাওয়াস্তে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যাবহারিকের সুযোগ নেই বললেই চলে। তবে শিক্ষানীতি অনুযায়ী, আগামী বছর থেকে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাইলটিং হিসেবে দুটি করে ট্রেড কোর্স চালুর কথা রয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে শিক্ষা আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে ২০১১ সাল থেকে কাজ শুরু করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর চারবার এই আইনের খসড়া করা হয়। তার পরও সেটি চূড়ান্ত হয়নি। এখনো সেই আইন নিয়ে কাজ চলছে। খসড়া নিয়ে সর্বশেষ আলোচনায়, সন্ধ্যার পর কোচিং সেন্টার চালু রাখার বিধান রাখা ও নোট-গাইড বন্ধের ব্যাপারে অনেকটাই একমত হয়েছে সংশ্লিষ্ট কমিটি।
দেশে প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী বাড়ছে। তবে সেই তুলনায় বাড়ছে না গবেষণা। বছরে প্রায় আট লাখ শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েশন শেষ করছেন। দেশে অদক্ষ গ্র্যাজুয়েট বাড়ায় দিন দিন বেড়েই চলেছে বেকারসংখ্যা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘শিক্ষানীতির যে কাজগুলো বাকি আছে সেগুলো শেষ করার ব্যাপারে কাজ চলছে। আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার কাজও শেষের পথে।’
সূত্র : কালের কণ্ঠ