একবিংশ শতাব্দীর সর্ববৃহৎ ভূরাজনৈতিক চুক্তি বেইজিং ও তেহরানের

0

ইরান একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে মূলত চীনের সাথে, পাশাপাশি আছে রাশিয়াও। প্রায় ৪০০০০ কোটি ডলার মূল্যের এই বিশালায়তনের চুক্তি অনুযায়ী ইরানে চীনা বিনিয়োগ ও সামরিক সহায়তা চলবে। বিনিময়ে চীনে হাইড্রোকার্বন সরবরাহ করা হবে ২৫ বছরের জন্য। এই চুক্তি বিশ্বে এক নতুন ভূরাজনৈতিক যুগ উন্মোচন করলো। শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে নয়, পুরো প্রাচ্যের ক্ষেত্রে।

এই সপ্তাহে এই চুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রায় ৪ বছর ধরে আলোচনা ও দরকষাকষি চলছিল। প্রথম দিকে বেশ সন্তর্পনে আলোচনা চলছিল, কেননা ইরান তাদের স্বার্বভৌমত্বে ছাড় দিতে রাজি ছিল না। কিন্তু চুক্তির যে রূপরেখা ফাঁস হয়েছে, সে অনুযায়ী, ইরানের বিভিন্ন খাতে ৪০০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগে সম্মত হয়েছে চীন।
অবকাঠামো, অর্থাৎ সড়ক ও রেলপথ, বাণিজ্যিক জাহাজের আধুনিকায়ন, টেলিযোগাযোগ খাত এবং তেল ও গ্যাস খাতে এসব বিনিয়োগ আসবে। বিনিময়ে চীন ইরানের গ্যাস ও তেল খাতে ছাড় পাবে। অর্থ বিনিময়ের ক্ষেত্রে দুই দেশের নিজ নিজ মুদ্রা ব্যবহৃত হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, চীন ও রাশিয়াকে নিজ দেশে ঘাঁটি গড়তে দেবে ইরান।

দুই দেশের পার্লামেন্টকেই এই চুক্তি র‍্যাটিফাই করতে হবে। দুই কারণে বিশ্বের জন্য এই চুক্তি বিস্ময়ের ব্যাপার। প্রথমত, বিপুল অংকের চীনা বিনিয়োগ, যা আগামী ২৫ বছর নাগাদ ৪০০০০ কোটি ডলার সমপরিমাণ হবে। অর্থাৎ প্রতি বছর ১৬০০ কোটি ডলার সমপরিমাণ। এই পরিমাণ বিনিয়োগ অন্য কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়। দ্বিতীয় কারণ হলো এই চুক্তির বিশাল ভূরাজনৈতিক পরিণতি।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মোকাবিলা

বর্তমানে ভয়াবহ এক মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বা অবরোধের কবলে রয়েছে ইরান। দেশটির অর্থনৈতিক সামর্থ্য পঙ্গু হয়ে গেছে, উন্নয়ন থমকে গেছে। কৃষি, ফার্মাসিউটিক্যালস সহ কিছু শিল্প খাতে নিজেরাই অনেকটা এগিয়ে গেছে ইরান। তবে বর্তমানে যোগাযোগ খাতে ব্যাপক প্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রয়োজন ইরানের। সেই তুলনায় বর্তমান উন্নয়নকে সীমিত বলা চলে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুদৃঢ় পরিবহণ অবকাঠামো না থাকলে দেশের উন্নয়ন হয় না। চীন যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিশেষ করে পঞ্চম প্রজন্মের টেলিযোগাযোগ, মহাসড়ক, রেলপথ ও বিমানবন্দরে নির্মানে অগ্রগামী। আগামী বছর থেকে যদি চুক্তি বাস্তবায়ন শুরু হয়, এক দশকের মধ্যে ইরানের চেহারাই পাল্টে যাবে। দেশটির অবকাঠামো চীন বা দক্ষিণ কোরিয়া বা পশ্চিমা দেশগুলোর পর্যায়ে চলে যাবে। চীনের মধ্যেও শক্ত ইচ্ছা যে ইরানকে তারা সাফল্যের প্রতীক বানাবে। ইরান যদি সফল উদাহরণ হয়, তাহলে অন্যান্য দেশও চীনের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে উৎসাহ পাবে।

পাশাপাশি ইরানের জ্বালানী, তেল ও গ্যাস খাতের যাবতীয় উৎপাদনের একমাত্র ক্রেতা চীনই হতে পারবে। এতে করে আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক অর্থ হারানো ও মার্কিন অবরোধ – দুই থেকেই বাঁচবে ইরান। চীনও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মার্কিন কৌশলের হাত থেকে সুরক্ষিত থাকবে।

বেইজিং ও তেহরানের মধ্যকার এই ভূরাজনৈতিক চুক্তির মূল বিষয় হলো সামরিক বাহিনী এবং ইরানে চীনা ও রাশিয়ান উপস্থিতি। এই চুক্তির অধীনে, ইরানে সামরিক কিছুটা ছাড় পাবে চীন। পারস্য উপসাগর অর্থাৎ বিশ্বের প্রধান তেল সমৃদ্ধ অঞ্চলের দিকবর্তী দেশ হলো ইরান।

এর ফলে একদিকে এখন ইরানকে কেউ সামরিকভাবে আক্রমণ করতে চাইবে না, কারণ সেখানে সরাসরি রাশিয়ান ও চীনা স্বার্থ জড়িত। রাশিয়ার সর্বাধুনিক আকাশ-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সহ আধুনিক সমরাস্ত্রের কারণে ইরানিয়ান সামরিক বাহিনীর সামর্থ্যও বৃদ্ধি পাবে। অপরদিকে, আরব উপসাগরে ও মূলত সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে এক ধরণের প্রবেশাধিকার পাবে চীন ও রাশিয়া।

পাকিস্তান হয়ে চীন ও ইরানের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে, একে বলা হবে সিল্ক রোড। চীনের বেল্ট অ্যান্ড সিল্ক রোড প্রকল্পে নৌ ও স্থল খাতে মোট ১৫টি কমন সীমান্ত পয়েন্ট রয়েছে ইরানের। ফলে চীনা উচ্চাবিলাশ থেকে লাভবান হবে ইরানও। আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, ইরাক, পাকিস্তান, তুরস্ক ও তুর্কমেনিস্তানের সাথে সড়ক যোগাযোগ রয়েছে ইরানের। পাশাপাশি নৌ বা সমুদ্রপথে ইরানের সীমান্ত রয়েছে রাশিয়া ও কাজাখস্থান ও সমগ্র আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে। অপরদিকে এসব দেশের সঙ্গে চীনের সংযোগ রয়েছে ১৫টি দেশের সাথে। অর্থাৎ ইরান ও চীনের এই চুক্তি কয়েক ডজন এশিয়ান দেশ ও রাশিয়াকেও সম্পৃক্ত করছে। রাশিয়া, চীন ও ইরান গত ডিসেম্বরে আরব সাগর ও পারস্য উপসাগরে সামরিক মহড়া দিয়েছে। পশ্চিমের কাছে সেটি ছিল বিস্ময়কর, তবে তাদের অগোচরেই এই মহড়াই এখন বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক চুক্তিতে রূপ নিচ্ছে।

ডলারের ওপর আঘাত

এই চুক্তির একটি বড় দিক হলো, রাশিয়ার পাশাপাশি বেইজিং ও তেহরান নিজ নিজ দেশের মুদ্রা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনকি পাকিস্তানও হয়তো এই উদ্যোগে শামিল হবে, কারণ চীন ও ইরানের সঙ্গে দেশটির নৈকট্য রয়েছে। বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হবে এটি। ইরান ডলারের একাধিপত্য অবশেষে কাটিয়ে উঠতে পারবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রয়োজনমাফিক ডলার সংগ্রহ করতে পারে না দেশটি। অপরদিকে চীনও তার নিজস্ব মুদ্রা ইউয়েন ঠিক করার বড় সুযোগ পেল। ডলারের একাধিপত্য খর্ব করার সুযোগ পেলো। চীন বিশ্বের কাছে একটি বড় দাবি করে রেখেছে, সেটি হলো, তারা ইউয়েনকে বৈশ্বিক বাণিজ্যে ব্যবহৃত হতে দেখতে চায়।

এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানও এই চুক্তিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। চীনের সাথে চুক্তির কারণে পশ্চিমা বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে ইরানে। বিশেষ করে ইউরোপ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। সব চুক্তি পাবে চীন। এতে করে অন্যান্য দেশও চীনের সাথে চুক্তি করতে আগ্রহী হবে, কারণ এতে করে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আর ঋণ চাইতে হবে না। নিজেদের জাতীয় মুদ্রা ও জাতীয় সম্পদের বিনিময়ে অর্থ পরিশোধ করতে পারবে।

ইসরাইলের জন্য আঘাত

এই কৌশলগত চুক্তির কারণে মার্কিন ও ইসরাইলি কৌশলও ধরাশয়ী হবে। সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল কয়েক দশক ধরে ইরানকে দুর্বল করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। সর্বশেষ ওয়াশিংটন যখন মার্কিন পারমাণবিক চুক্তি থেকে বের হয়ে এলো, সেটি ছিল ওই চেষ্টারই অংশ।

আমেরিকার গোয়েন্দা ব্যর্থতা

যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসছে, তখনই এই চুক্তি হলো চীন ও ইরানের মধ্যে। প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প, যিনি চীনকে মোকাবিলা করা নিজের অগ্রাধিকারে পরিণত হয়েছেন, তার শক্তি যাচাই হবে আসছে নির্বাচনে। তবে এই চুক্তি সবচেয়ে বড় আঘাত সিআইএ-এর প্রতি। অনেকেই বিস্মিত হচ্ছেন যে, কীভাবে সিআইএ’র মতো একটি সংগঠন, যাদের রয়েছে হাজার হাজার বিশ্লেষক, তারা এই ভূরাজনৈতিক চুক্তির বিষয়টি পূর্বানুমান করতে পারলো না?

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com