সত্যিই কি চলে যাচ্ছে করোনা
লোকমুখে একটাই প্রশ্ন, করোনা নাকি বাংলাদেশ থেকে চলে যাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই আবার প্রশ্ন, কোন দেশে যাচ্ছে? নাকি অন্য কোনো গ্রহে? মানুষের এই রসিকতার পেছনে হয়তো স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য কাজ করেছে। তিনি বলেছেন, ভ্যাকসিন আসুক বা না আসুক, কভিড-১৯ বাংলাদেশ থেকে এমনিতেই চলে যাবে। আমরা আনন্দিত, দেশে করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমেছে। রোগীদের হাসপাতাল বিমুখতার একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, মানুষ এখন বাসায় বসেই চিকিৎসা পায় তাই তাদের হাসপাতালে আসতে হয় না।
কী চমৎকার চিকিৎসা ব্যবস্থা এই দেশে। চিকিৎসা পেতে তাদের হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হচ্ছে না। ঘরে বসেই পাচ্ছেন। এমন সুবিধা পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে? স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথাও একদিন সত্যি হতে পারে। চলে যাবে হয়তো করোনা। কিন্তু ততদিনে যে কত মানুষকে লাশ হতে হবে কে জানে! কারণ, মন্ত্রী করোনা ঠিক কবে চলে যাবে সেই টাইমফ্রেম তো বলেননি। কিছুদিন আগেও মন্ত্রী বলেছেন, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীতে সাত লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা করোনার সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে সমালোচনার মুখে পড়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আমরা সফলতার সঙ্গে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করেছি’ (প্রথম আলো, ০৩ আগস্ট ২০২০)। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পথ অনুসরণ করে বলেছেন, ‘বর্তমান সরকার বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস মোকাবিলায় উপযুক্ত নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে এই রোগের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার দুটোই কম (প্রথম আলো, ৪ আগস্ট ২০২০)।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দক্ষতা, দূরদর্শিতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে বিশেষজ্ঞদের সব পূর্বাভাস ভুল প্রমাণ করে সংক্রমণ এখন নিয়ন্ত্রণে’ (প্রথম আলো, ০৩ আগস্ট ২০২০)। ঈদের দিন ও পরের দিন করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ২০ ও ২১ এবং আক্রান্তের সংখ্যা কম দেখে সড়কমন্ত্রী হয়তো এই কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরের দিনগুলোতে সে মৃত্যুর সংখ্যা যথাক্রমে ৩২, ৫০, ৩৩ হয়ে গেছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের করোনা নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ঘোষণা দেওয়ার দুদিন পরেই যেমন করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসাবেই একদিনে অর্ধশত হয়েছিল, তেমনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেদিন ঘোষণা দিলেন বাংলাদেশ থেকে করোনা চলে যাবে তার তিন দিনের মাথায়ই সংবাদমাধ্যমগুলোতে শিরোনাম হয়েছে, ‘দেশে হঠাৎ বেড়েছে করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্ত’। ১৮ আগস্ট দুপুরেই সংবাদমাধ্যমগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য উল্লেখ করে জানায়, ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪৬ জন। আর এ সময়ে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ২০০ জন।
সরকারি দলের সমর্থকরা বাংলাদেশে করোনায় বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা কম হওয়াকে তাদের সফলতা বলে প্রচার করেন। বিশে^র অনেক উন্নত দেশও আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেয়েছে উল্লেখ করে নিজেদের ব্যর্থতাকে লঘু প্রমাণের চেষ্টা করেন। কিন্তু বাংলাদেশে যে আমেরিকা, ব্রাজিল, মেক্সিকো, ইতালি, যুক্তরাজ্যের মতো এত মানুষ মৃত্যুবরণ করেননি, তার কোনো রকম কৃতিত্ব কি সরকারের আছে? কোন পদক্ষেপ এ দেশে করোনায় মৃত্যুহার কমিয়েছে? সরকারের কোনো পদক্ষেপ নাকি প্রাকৃতিক কোনো সুবিধা আমাদের এখনো পর্যন্ত এতটুকু সুবিধাজনক স্থানে রেখেছে সেটার বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা পাওয়া যাবে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন থেকে। ‘বাংলাদেশে করোনায় সক্রিয় প্রোটিন ডি৬১৪জি মহামারী ঘটানোর মতো বিপজ্জনক নয়’ শিরোনামের প্রতিবেদনে লেখা হয় ‘বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ১৬ জুলাই পর্যন্ত ২২২টি করোনা ভাইরাসের সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করেছেন। বাংলাদেশের করোনাভাইরাস ইতিমধ্যে তার জিনোমিক পর্যায়ে ৫৯০টি ও প্রোটিন পর্যায় ২৭৩টি পরিবর্তন ঘটিয়েছে। একটা করোনাভাইরাসে ১ হাজার ২৭৪টি প্রোটিন থাকে। এর মধ্যে ডি৬১৪জি নম্বর প্রোটিনটি বাংলাদেশে সক্রিয়। যে সব দেশে করোনা মহামারী আকারে ছড়িয়েছে, সে সব দেশে ভাইরাসটির জিনে ৩৪৬ নম্বর থেকে ৫১২ নম্বর প্রোটিন মারাত্মকভাবে সক্রিয় ছিল, বাংলাদেশে এখনো এটি দেখা যায়নি।’
করোনাভাইরাসের প্রোটিন এক্সপ্রেশন ও পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে মৃত্যুর সংখ্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করা থেকে দূরে রেখেছে এমন দাবি অবশ্য কোনো নেতা-মন্ত্রী-সমর্থক-গোষ্ঠী করেনি। তবে এই বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা জানার পর তাদের কাছে উল্টো প্রশ্ন করা যায়, প্রাকৃতিকভাবে এই সুবিধাপ্রাপ্ত হওয়ার পরেও বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এত মানুষের মৃত্যু হলো কেন? মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা অনেক দেশের তুলনায় কম হওয়ার পরেও বাংলাদেশে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় মানুষের মৃত্যু হলো কেন? অতিঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ার কারণে করোনা বিস্তারের ঝুঁকি বেশি হওয়া সত্ত্বেও টেস্ট কেন এই অঞ্চলে সব দেশের থেকে কম? এই মহামারীর সময়েও এই দেশে কেন এত দুর্নীতি ও অভিনব জালিয়াতির অভিযোগ?
বাংলাদেশে মেঠো বক্তৃতায় যা খুশি তাই বলার রেওয়াজ আছে। এই সব বাজে কথাকে তারা জয়েজে করেন ‘পলিটিক্যাল রেটোরিক’ বলে। অনেকে আবার মনে করেন, এই সব উল্টাপাল্টা কথা পাবলিক খুব খায়। এই সব নেতাদের কথায় সাধারণ কর্মীরা উজ্জীবিত হয়। এতে নেতা আলোচনায় থাকেন। তিনি পরিচিতি পেতে পেতে জাতীয় নেতা হয়ে ওঠেন। কিন্তু আসলেই কি তা হয়? যারা পচা কথা বলেন, বাজে কথা বলেন তারা মানুষের আলোচনায় আসেন সত্য। কিন্তু তা তো সম্মানের নয়।
এ দেশের মানুষ বরাবরই রাজনীতি সচেতন। দেশের যে কোনো এলাকায় শুধু বিকেল বা সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ একটা চায়ের দোকানের সামনে চুপচাপ বসে অন্যদের কথা শুনলেই বোঝা যাবে তাদের আলোচনায় কী আসে আর তার গভীরতা কতটা। তাই বড়কর্তারা যা খুশি বললেন আর মানুষ তা বিশ্বাস করে নিল সে দিন নেই। বরং যারা অসংলগ্ন কথা বলেন, তাদের নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ কী মন্তব্য করেন সেগুলো শোনার চেষ্টা করলে হয়তো তাদের কাজে লাগতে পারে। তারা হয়তো বেফাঁস কথা বলার আগে একটু হলেও ভাববেন।
লেখক : চিকিৎসক ও কলামনিস্ট