পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদের উত্থান বাংলাদেশকে হুমকিতে ফেলেতে পারে
বাংলাদেশে অফিস খুলে হিন্দুদের দেশত্যাগে সাহায্য করছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের উপর গভীর নজর রাখছেন প্রতিবেশী বাংলাদেশের সিলেটের ভাস্কর চৌধুরী অরূপ আর টাঙ্গাইলের মধুপুরের মো. মোজাম্মেল হোসেন। তারা উদ্বেগের সাথে দেখছেন যে, ওপার বাংলায় এখন যেটা ঘটছে, সেটা আগে কখনও ঘটেনি। তারা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে হিন্দু ডানপন্থীরা দ্রুত প্রধান্য বিস্তার করছে।
এই দুজনের ধারণার কারণ হলো উগ্র জাতীয়তাবাদী হিন্দু ডানপন্থীদের কারণে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক উত্তেজনা বেড়ে যাওয়া। ভারতের সেক্যুলার রাজনীতি হুমকির মুখে পড়ে গেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সাধারণভাবে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের উপর এর প্রভাব পড়েছে। ২০১৯ সালে ভারতের পার্লামেন্ট নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টি পেয়েছে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।
স্ত্রীর ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা যেতে হয় ভাস্কর চৌধুরীকে। অন্যদিকে হোসেনের নিজেরই ক্যান্সার রয়েছে। চৌধুরী আর হোসেনের মতো হাজার হাজার বাংলাদেশী চিকিৎসা, ব্যবসায় এবং পর্যটক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলোতে যান। এদের সবাই আশঙ্কার মধ্যে আছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের ২০২১ সালের অ্যাসেম্বলি নির্বাচনের আগে হয়তো হিন্দু ডানপন্থীরা মুসলিম-বিরোধী এবং বাংলাদেশ-বিরোধী কার্ড খেলার চেষ্টা করবে।
পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি প্রধান দিলিপ ঘোষের বিতর্ক সৃষ্টির প্রবণতা রয়েছে। সম্প্রতি তিনি এক বক্তৃতায় বলেছেন: “বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসলে এখানে বসবাসরত ১০ মিলিয়ন অবৈধ বাংলাদেশী মুসলিমকে ফেরত পাঠানো হবে”। ঘোষের এই বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলার মুসলিম এবং বাংলাদেশী – যারা পর্যটন বা চিকিৎসার জন্য এসেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা অবশ্য এই ধরনের আশঙ্কাকে বিবেচনায় নিচ্ছেন না।
রাজ্যের উপজাতীয় জঙ্গলমহল এলাকায় আরএসএসের প্রচারক ছিলেন দিলিপ ঘোষ। সেখান থেকে তাকে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী করা হয়। কলকাতার সিনিয়র সাংবাদিক সমির কে পুরকায়স্থ বলেন, তার উত্থান বিজেপির বর্ণভিত্তিক সামাজিক কৌশলের প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদী ঢোল পেটানো এবং ভোটারদের বিভক্ত করার ক্ষেত্রে ঘোষ একজন উপযুক্ত ব্যক্তি”।
বাংলাদেশ বিষয়ক পর্যবেক্ষক সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত বলেন, “বিজেপির নতুন প্রচারণা হলো পশ্চিমবঙ্গের কিছু এলাকায় মুসলিমদের কারণে হিন্দুরা বিপদের মধ্যে রয়েছে – এই গ্রামীণ এলাকার বিপদ হলো এগুলো মুসলিম প্রধান”।
কলকাতার বাংলা দৈনিকের জন্য তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করেছিলেন দাসগুপ্ত। তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের দেশ ভাগ পরবর্তী ইতিহাসে রাজনৈতিক মানচিত্রের অধিকাংশ জায়গাতেই ধর্মীয় মেরুকরণের কোন স্থান ছিল না, যেটা বাংলাদেশে ছিল”।
বিজেপির উত্থান ও হিন্দু শরণার্থী ফ্যাক্টর
এক দশক আগেও যে দলটির কোন নির্বাচনী উপস্থিতি ছিল না, এটা উল্লেখযোগ্য যে, সেই বিজেপিই এখন পশ্চিমবঙ্গে বিগত কয়েক বছরে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবীর্ভূত হয়েছে। কিন্তু হিন্দু ডানপন্থীদের নজর সবসময় পশ্চিমবঙ্গে এবং ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর উপর ছিল।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “হিন্দু ডানপন্থীরা এমনকি স্বাধীনতার আগে থেকেই গ্রামীণ বাংলায় সক্রিয় ছিল। কিন্তু এখন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ জুটি এটাকে বাংলার শহর এলাকাতেও টেনে এনেছে। বিজেপি হিন্দু অভিবাসীদেরকে মুসলিমদের থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছে। বিজেপি বাংলার হিন্দুদেরকে কট্টর করে তুলতে পেরেছে – বিশেষ করে দেশভাগের সময়ের শরণার্থীদের, আগে যারা কমিউনিস্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে এসেছে – এদেরকে দিয়ে হিন্দু আর মুসলিমদের আলাদা করেছে তারা। সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) পাস করে বিজেপি এটা প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, বাংলাদেশের হিন্দুরা অভিবাসী আর মুসলিমরা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী”।
দাসগুপ্ত বললেন, “বহু বছর ধরে হিন্দু ডানপন্থীরা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে পশ্চাদপদ নমশুদ্র সম্প্রদায়ের হিন্দুদের পশ্চিমবঙ্গে আসতে সাহায্য করেছে”।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সাংস্কৃতিক ভাষ্যকার জওহর সরকার লিখেছেন: “বাংলায়, বিজেপি এখন বেপরোয়া বামপন্থী, কংগ্রেস এবং এমনকি সাবেক তৃণমূল সমর্থকদের সম্মেলনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে যারা এই দলের পতাকার নিচে জড়ো হয়েছে। কারণ, তারা ভাবছে এই দলের হাতে কেন্দ্রীয় সরকার এবং আধাসামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থাকায় তারা দায়মুক্তি পেয়ে যাবেন”।
সাবেক এই আমলা লিখেছেন, বিজেপির এই চোখ ধাঁধাঁনো নির্বাচনী বিজয়ের কারণ “শুধু নরেন্দ্র মোদি ফ্যাক্টর নয়, বরং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কিছু মারাত্মক ভুল”।
হিন্দু ডানপন্থীরা অবশ্য সবসময় অবিভক্ত বাংলার পক্ষে ছিল। চল্লিশের দশকে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মতো আরএসএস-সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো বাংলায় ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের মতে, বাংলার অধিকাংশ হিন্দুবাদী সংগঠনকেই মারোয়ারি এবং অন্যান্য ব্যবসায়ী সম্প্রদায় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে।
দাসগুপ্ত বলেন, দেশভাগের সময় যদিও বাংলায় খুব সামান্যই অভিবাসন ঘটেছে, কিন্তু পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত বেড়ে গেলে মূলত উচ্চ বর্ণের বিপুল সংখ্যক হিন্দু পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় পাড়ি জমায়।
হিন্দু ডানপন্থীদের সামনে এখন বাংলাদেশ থেকে আসা তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের দেশভাগকালীন শরণার্থীরা রয়েছে, যাদেরকে তোষণ করাটা খুবই সহজ। দাসগুপ্ত বলেন, “আরএসএস-সংশ্লিষ্ট বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এখন বাংলাদেশের সবগুলো জেলায় তাদের অফিস খুলেছে এবং বাংলাদেশের নিম্নবর্ণের হিন্দুদের তারা পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়ার জন্য সাহায্য করছে”।
দাসগুপ্ত বলেন, মমতা ব্যানার্জি আর তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামি দলের কট্টর মুসলিমদেরকে আশ্রয় দিয়েছে। তিনি বলেন, জানা গেছে শেখ হাসিনা সরকার জামায়াতে ইসলামি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টি ভারতকে তদন্ত করতে বলেছে।
বিজেপি একটা বিষাক্ত পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছে, যেখানে এরই মধ্যে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয়েছে এবং সহিংসতা উসকে দেয়া হয়েছে। বিজেপির প্রভাবে, বাংলার হিন্দু সংস্কৃতি বদলে যাচ্ছে। ‘কাউ বেল্ট’ নামে পরিচিত মূল হিন্দু ভূখণ্ডের কট্টর সংস্কৃতি এখন বাংলার হিন্দুদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলার হিন্দুরা উত্তর আর পশ্চিমের ভারতীয় সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে ধান্তেরার সময় স্বর্ণ কিনতে শুরু করেছে। বাঙালি পরিবারগুলো ‘সাংগিত’ অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করেছে, যেটা সাধারণভাবে কখনই বাঙালি বিয়ের অংশ ছিল না।
পূজার রাজনীতি ও মমতা ব্যানার্জি
গত ছয় বছরে পশ্চিমবঙ্গে এমন অনেক উৎসব বেড়ে গেছে, যেগুলো আগে দেশের অন্যান্য জায়গাতে ছিল – যেমন রাম নবমী এবং অতি সম্প্রতি এসেছে গনেশ চতুর্থী। ২০১৪ সাল থেকে বিজেপির শক্তি বেড়ে যাওয়ায় সেটা এখানে প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে। সরকার বলেন, বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নতুন উৎসব আর দেবতাদের নিয়ে আসার পেছনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসেরও একটা ভূমিকা রয়েছে।
সাবেক এই আমলা বলেন, বাংলায় দুর্গাপূজা ছিল সবসময় বড়। কিন্তু এখন রাম নবমী বা হনুমান জয়ন্তির যাত্রা আরও বড় হতে শুরু করেছে।
সরকার লিখেছেন, ব্যানার্জিকে একইসাথে মুসলিমপন্থী হিসেবে বেশি এগিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে হবে, কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় এটাকে ভুল বুঝছে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মুসলিমদের তুষ্ট রাখার ক্ষেত্রে কট্টর অবস্থানে চলে যান, এবং এটা বাংলায় সেক্যুলারিজমের ক্ষতি করছে। তাছাড়া, বিজেপির হিন্দু-হিন্দি চেহারার মোকাবেলার জন্য ব্যানার্জি সম্প্রতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ উসকে দেয়ার যে প্ররোচনা দেখিয়েছেন, সেটাও তাকে ছাড়তে হবে”।
বাঙালি রাজনীতিবিদরা ঘন ঘন দল বদলায় না বলে যে ধারণা রয়েছে, সেটাকেও নাকচ করে দেন দাসগুপ্ত। অসন্তুষ্ট নেতা এবং রাজনৈতিক কর্মীরা রাজ্যে ঘন ঘন দল বদল করেছে। সিপিআই (এম) দলের যারা ছিলেন তারা তৃণমূল কংগ্রেসে গেছেন এবং কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে গেছেন অনেকে আবার এর উল্টোটাও হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাংলায় যে বিজেপির একসময় কোন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না, তাদের এখন গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের দেশভাগকালীন শরণার্থীদের অনেকেই এখন সিপিআই (এম) ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছে।