ভেঙে পড়েছে সংক্রমণ প্রতিরোধের সব ব্যবস্থা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুসারে রোগতাত্ত্বিক সপ্তাহ ৩৪ অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। সংস্থাটির গত পরশু প্রকাশ করা ৩৩তম সাপ্তাহিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের সপ্তাহের (৩২তম) তুলনায় বাংলাদেশে শনাক্ত বেড়েছে ১২.৫ শতাংশ এবং মৃত্যু বেড়েছে ৫.৩ শতাংশ। সুস্থতা কমেছে ৮.২৫ শতাংশ। অন্যদিকে আক্রান্ত বহাল থাকার হার বেড়েছে ৭.৪ শতাংশ।
অর্থাৎ সার্বিকভাবেই সূচকগুলোর বিশ্লেষণে পরিষ্কার বার্তা মিলছে—দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের গতি এখন ঊর্ধ্বমুখী। এ সত্ত্বেও করোনা প্রতিরোধে নতুন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ তো নেওয়া হয়ইনি বরং আগে নেওয়া কৌশলগুলো একে একে সবই যেন ভেস্তে যাচ্ছে। পরীক্ষা, শনাক্ত, আক্রান্তের উৎস বের করা এবং আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা—এই চার মূল কৌশলের মধ্যে পরীক্ষার হার এখনো সীমিত রয়ে গেছে, আবার যতটুকু পরীক্ষা হচ্ছে তার ভিত্তিতে যারা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হচ্ছে তাদের প্রায় ৮০ শতাংশই থেকে যাচ্ছে আইসোলেশনের বাইরে। সেই সঙ্গে প্রতিরোধের আরেক অপরিহার্য বিষয় হিসেবে আক্রান্ত হওয়ার উৎস খুঁজে বের করায় রয়ে গেছে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। হাসপাতালগুলোর অবস্থা মাঝখানে কিছুটা উন্নত হলেও হাসপাতালমুখী পজিটিভ রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক কমই থেকে যাচ্ছে। জটিলতা নিয়েও অনেকেই থেকে যাচ্ছে বাসাবাড়িতে।
অন্যদিকে লকডাউন, রেড জোন, কোয়ারেন্টিন কিংবা আইসোলেশন প্রক্রিয়াগুলো চাপা পড়ে গেছে নানা ডামাডোলের আড়ালে। স্বাস্থ্যবিধি-সামাজিক দূরত্ব মানার কথা বলা হলেও বাস্তবে এগুলোও এখন আর কার্যকর নেই বললেই চলে। অফিস-আদালত, সরকারি-বেসরকারি সব আর্থ-সামাজিক কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় চলে এসেছে; কিন্তু মানা হচ্ছে না বিধি-বিধান। এমনকি পরীক্ষায় পজিটিভ হয়েও উপসর্গহীন আক্রান্তরা চলাফেরা করছে স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ্যেই। তাদের আইসোলেশনে নেওয়ারও এখন আর কোনো ব্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে না। বিদেশ থেকে মানুষ আসার সংখ্যাও বেড়েছে। প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে বিমান চলাচলের সংখ্যা। স্থলবন্দর হয়েও মানুষ আসছে বাইরে থেকে। তাদের ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থাও পালন হচ্ছে না ঠিকমতো। হোম কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন এখন নামমাত্র অবস্থায় রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেহেতু সংক্রমণ পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে তাই আগের মতো সব পদক্ষেপ এখন আর কার্যকর হচ্ছে না, সব ক্ষেত্রেই একধরনের ঢিলেঢালা ভাব এসে গেছে। লকডাউন বা রেড জোনের বিষয়ে আমরা নতুন করে কোনো নির্দেশনাও পাইনি। ফলে মনে হচ্ছে, প্রক্রিয়াটি থেমে গেছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত দেশে মোট শনাক্ত হয়েছে দুই লাখ ৮৫ হাজার ৯১ জন। এর মধ্যে তিন হাজার ৭৮১ জন মারা গেছে, এক লাখ ৬৫ হাজার ৮৩৮ জন সুস্থ হয়েছে এবং চার হাজার ৬১৪ জন আছে হাসপাতালে। বাকি এক লাখ ১০ হাজার ৯৫৮ জন পজিটিভ রোগীর আইসোলেশনে থাকার কথা। এ ক্ষেত্রে যারা বাসায় নিজ তত্ত্বাবধানে আইসোলেশনে থাকবে বা সরকারি তত্ত্বাবধায়নে কোনো সরকারি আইসোলেশন সেন্টারে থাকবে তাদের সবার তদারকির কথা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। তবে অধিদপ্তরের গতকাল বুধবারের তথ্য অনুসারে বর্তমানে আইসোলেশনে রয়েছে মাত্র ২০ হাজার ২৮০ জন। ফলে বাকি ৯০ হাজার ৬৭৮ জন পজিটিভ রোগীর আইসোলেশনের খোঁজ নেই অধিদপ্তরের কাছে।
ডা. নাসিমা সুলতানা এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনের তথ্য দিয়েছি। অন্যরা হোম আইসোলেশনে থাকার কথা। এখন অনেকেরই উপসর্গ নেই। তবে সব কিছু ঠিকমতো মানা হচ্ছে কি না সেটা দেখার ব্যাপার। এ ছাড়া সংক্রমণ যে খুব বেড়ে গেছে সেটা কিন্তু নয়। আমরা কোরবানি ঈদ ঘিরে যে পরিস্থিতি দেখেছি, তাতে অনেক বেশি সংক্রমণের আশঙ্কা করেছিলাম গত দুই সপ্তাহে। কিন্তু তত বড় সংক্রমণ এখনো ঘটেনি। এক দিন বাড়ে তো আরেক দিন কমে যায়। যদিও মৃত্যুটা দুই দিন ধরে কিছুটা বেশি।’
জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের সব কৌশল কাঠামোই যেন ভেঙে পড়েছে। জীবন-জীবিকার অজুহাতে সব কিছু স্বাভাবিক করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউ এর মূল শর্ত—স্বাস্থ্যবিধি কিংবা সামাজিক দূরত্ব মানছে না। এর ফল হচ্ছে, আমরা যারা আশা করছিলাম এই মাসের শেষ বা আগামী মাস নাগাদ দেশে করোনার দাপট অনেকটাই কমে যাবে; এখন সেটা তো হচ্ছেই না, উল্টো আরো দীর্ঘমেয়াদি হবে আমাদের করোনাকাল।’ এই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘এমনিতেই দেশে এখন যে হারে সংক্রমণ ছড়িয়েছে সেই হারে পরীক্ষার সংখ্যা খুবই কম। আবার যারা শনাক্ত হচ্ছে তাদের কোনো ফলোআপ হচ্ছে না। আইসোলেশনও খুবই দুর্বল আর কন্টাক্ট ট্রেসিং (পজিটিভ রোগীর সংস্পর্শে কারা কারা এসেছে) তো একেবারেই নেই। এমন হলে ক্ষতি তো আরো বাড়বে।’
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এখানে সংক্রমণের গতি ধীর হলেও এখনো তা ঊর্ধ্বমুখীই আছে। ঝুঁকি তো কাটেইনি বরং আরো বাড়ছে। মাঝে যতটুকু কমেছিল সেই অবস্থা আমরা ধরে রাখতে পারিনি বাস্তবায়নজনিত ব্যর্থতার জন্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কৌশল অনুসারে আমরা যে পরিকল্পনা নিয়েছিলাম শুরুর দিকে, সেটা আমাদের বড় সুফল দিয়েছে সংক্রমণের গতি ধীর করে দেওয়া ক্ষেত্রে। যদি আমরা সেটিতেও ব্যর্থ হতাম তাহলে পরিস্থিতি আরো অনেক বেশি ভয়ানক হতো।’ তিনি বলেন, ‘আইসোলেশন ও কন্টাক্ট ট্রেসিং কিছু হচ্ছে না। অথচ এ ক্ষেত্রে কমিউনিটিকে যুক্ত করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যেত। এখন যারা পজিটিভ হচ্ছে তারা ইচ্ছামতো অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিচ্ছে। যেহেতু এখন উপসর্গহীন রোগী বেশি তাই আক্রান্তরাও আইসোলেশনে গুরুত্ব দিচ্ছে না আবার সরকারের জায়গা থেকেও এ ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।’