আর্থিক দুর্যোগ সামলানোর সক্ষমতা সবচেয়ে কম বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর
বিশ্বের যেকোনো ব্যাংকের মূলধনের পরিমাপক হলো মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত (সিএআর)। এ অনুপাতকে আমানতকারীদের সুরক্ষা, ব্যাংকের স্থিতিশীলতা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা পরিমাপের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে ব্যাংকের সিএআর যত বেশি, অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সে ব্যাংকের সক্ষমতা ততটাই শক্তিশালী। যদিও এক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো।
পরিসংখ্যান বলছে, মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাতের দিক থেকে উন্নত দেশগুলোর ব্যাংকের তুলনায় বহু পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও এক্ষেত্রে দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থান একেবারেই তলানিতে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী, ২০১৯ সাল শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতের সিএআর হওয়ার কথা সাড়ে ১২ শতাংশ। বাংলাদেশে এটি ১১ শতাংশের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। যদিও প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে এ অনুপাত ১৭, শ্রীলংকায় ১৬ দশমিক ৫০ ও ভারতে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ।
গড়ে দেশের ব্যাংকিং খাতের সিএআর পরিস্থিতি নাজুক হলেও এক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে আছে দেশের বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি ব্যাংক। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর ব্যালান্সশিট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাতের দিক থেকে সবার শীর্ষে আছে প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির সিএআর প্রায় সাড়ে ১৭ শতাংশ। এ তালিকার শীর্ষ অবস্থানে থাকা অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে ডাচ্-বাংলা, ব্র্যাক, শাহজালাল ইসলামী, ব্যাংক এশিয়া, যমুনা, দ্য সিটি ও ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড। অন্যদিকে সিএআর সংরক্ষণে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে এবি ব্যাংক, এক্সিম, রূপালী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।
সিএআরকে ঝুঁকিবারিত সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের অনুপাত বা ক্যাপিটাল টু রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেট রেশিও (সিআরএআর) বলেও অভিহিত করা হয়। বৈশ্বিকভাবে ব্যাংকের সক্ষমতা পরিমাপের অন্যতম মানদণ্ড ধরা হয় এ অনুপাতকে। আর্থিক দুর্যোগ বা বিপর্যয়ের সময় ব্যাংক কতটা শক্ত ও ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারবে, এটি তারই নির্দেশক।
বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর মূলধন সক্ষমতা সবচেয়ে দুর্বল। স্বল্প মূলধন, বিপুল খেলাপি ও দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ নিয়ে টানাপড়েনে আছে দেশের অর্ধেকের বেশি ব্যাংক। ঋণখেলাপিরা অনেক ব্যাংকের মূলধনও খেয়ে ফেলেছে। ব্যাংকিং খাতের এ দুর্বলতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ। এ অবস্থায় সিএআর কম এমন ব্যাংকগুলো আরো বেশি ঝুঁকিতে পড়বে বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এ শীর্ষ নির্বাহী বলেন, দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকের মূলধনের আকার খুবই ছোট। ব্যাংকগুলোর ব্যালান্সশিটের আকারও ছোট ও দুর্বল। অন্যদিকে খেলাপি ঋণের হার বেশি। খেলাপি ঋণের বিপরীতে অনেক ব্যাংকই যথাযথভাবে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে পারছে না। মূলধন সক্ষমতার ঘাটতি নিয়ে কোনো ব্যাংকই আর্থিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারে না। এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলোর প্রধান দায়িত্ব হবে মুনাফায় জোর না দিয়ে মূলধন বাড়ানো। করোনা সৃষ্ট দুর্যোগের ফলে এক-দুই বছরের মধ্যে দেশের ব্যাংকিং খাতকে খেলাপি ঋণের বড় ধাক্কা সামাল দিতে হবে। মূলধন সক্ষমতা না বাড়লে অনেক ব্যাংকই এ দুর্যোগে বিধ্বস্ত হবে।
আর্থিক দুর্যোগ কিংবা পতনোন্মুখ ব্যাংকের আপত্কালীন ক্ষতি সামাল দেয়ার জন্য ব্যাংকিং খাতে প্রবর্তন করা হয় ব্যাসেল-৩। বিপর্যয়ের সময়েও ব্যাংক যাতে নিজের মূলধনে চলতে পারে, সেজন্যই ব্যাসেল-৩-এর প্রবর্তন। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ২০১৫ সালে শুরু হওয়া এ ব্যাসেল বাস্তবায়নের সীমা ধরা হয়েছে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। যদিও বাস্তবায়নের বছরে এসে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রায় সব ব্যাংক ব্যাসেল-৩ তো দূরের কথা, ব্যাসেল-২-এর মানেরও নিচে নেমে গেছে। ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন থেকে ছিটকে পড়েছে বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি ব্যাংকও। এর মধ্যে অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ।
আন্তর্জাতিক এ মানদণ্ড অনুযায়ী ২০১৯ সালের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে হতো ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ছাড়া দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো ব্যাংকই এ মানদণ্ডের ধারেকাছে যেতে পারেনি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খারাপ পরিস্থিতিই দেশের পুরো ব্যাংকিং খাতের গড় সিএআরকে ১২ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের অন্তত ১০টি ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতিও খারাপ।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সিএআরের দিক থেকে সবার শীর্ষে আছে প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির সিএআর ছিল ১৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, যা প্রত্যাশিত অনুপাতের চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ বেশি।
এ বিষয়ে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাহেল আহমেদ বলেন, একটি ব্যাংক অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় কতটা সক্ষম, মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত বা সিএআর থেকে তার ধারণা পাওয়া যায়। দেশের সব বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে প্রাইম ব্যাংক সিএআরের দিক থেকে শীর্ষে আছে। এটি প্রাইম ব্যাংকের জন্য আনন্দ ও গর্বের। আমরা গত তিন বছরে অহেতুক ঋণ প্রবৃদ্ধির দিকে যাইনি। বরং মানসম্মত ঋণ দেয়ার মাধ্যমে খেলাপি ঋণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছি। খেলাপি ঋণ মূলধন ক্ষয় করে। দেশের ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো খেলাপি ঋণের ঝুঁকি।
রাহেল আহমেদের অভিমত, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর মূলধন খুবই কম। মূলধন ভালো থাকা মানে হলো যেকোনো দুর্যোগেও গ্রাহকদের আমানত ফেরত দেয়ার সক্ষমতা রাখা। এদিক থেকে অনেক ব্যাংকই পিছিয়ে পড়ছে। ব্যাংকগুলোর এখন মূলধন সক্ষমতা বাড়ানোর প্রতি জোর দেয়া দরকার।
ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মধ্যে মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাতে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে আছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির সিএআর ছিল ১৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী মো. শহিদুল ইসলাম জানান, সাব-অর্ডিনেন্ড বন্ড ইস্যু করার মাধ্যমে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মূলধন বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে নগদ আদায় ও নিয়মিত করার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। এর সুফল হিসেবে ব্যাংকের মূলধন সক্ষমতা বেড়েছে। একই সঙ্গে যথাযথভাবে ব্যাংকের সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব নির্দেশনা মেনে চলা ও কার্যকর সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুফল আমরা পেয়েছি।
বেসরকারি খাতে বিতরণকৃত দেশের ব্যাংকগুলোর ঋণ অল্পকিছু গ্রাহক ও করপোরেটের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়ার অভিযোগ অনেক পুরনো। বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেস টেস্টিংয়ে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর বড় তিন গ্রাহক খেলাপি হলে ২১টি ব্যাংকের মূলধন খোয়া যাবে। আর শীর্ষ সাত গ্রাহক খেলাপি হলে মূলধন সক্ষমতা হারাবে ৩৫টি ব্যাংক। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশ বাড়লে দেশের তিনটি ব্যাংক মূলধন সক্ষমতা হারাবে। আর খেলাপি ঋণ ৯ শতাংশ বাড়লে মূলধন সক্ষমতা হারাবে ২৯টি ব্যাংক। ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়ার এ ঝুঁকি করোনাকালে আরো তীব্র হয়েছে।