গণপরিবহনে আবারও নৈরাজ্য
করোনাকালে পর্যুদস্ত মানুষের হাতে প্রয়োজনীয় টাকা নেই। সংকুচিত হয়েছে কর্মক্ষেত্র। চাকরি হারিয়েছেন অনেকে। অনেকের বেতন হয়ে গেছে অনিয়মিত। এ দুঃসময়ে ৬৬ দিন বেকার থাকা পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন। বাড়তি ভাড়ার কারণে দৈনন্দিন খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন নিত্যযাত্রীরা। প্রতিবাদ করেও সুফল মিলছে না। অন্যদিকে গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহনের কারণে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
নতুন করে গণপরিবহন চালুর সময় সিদ্ধান্ত ছিল, ১১ দফা শর্ত সাপেক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে গণপরিবহন। দুই সিটে বসবে এক যাত্রী। সিট খালি থাকবে অর্ধেক। কম যাত্রী পরিবহনের এ ক্ষতি পোষাতে ভাড়া বাড়বে ৬০ শতাংশ। কিন্তু সব শর্ত এখন কাগজেই সীমাবদ্ধ। এখন পিক আওয়ারে ভাড়া ডাবল। যাত্রীও দ্বিগুণ। কেউই মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। অফিস শুরু ও শেষের সময় বাসে সিট খালি থাকছে না। বাস-মিনিবাসে পরিচ্ছন্নতার কোনো বালাই নেই। কোথাও যাত্রীদের হ্যান্ড স্যানিটাইজারও দেওয়া হয় না। করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকা এ সময়ে গণপরিবহনই করোনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। পাশাপাশি প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করছে মানুষ। লোভের লাগাম টানতে পারছেন না পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। যাত্রীরা বলছেন, লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধের সময় পরিবহনশ্রমিকরা আর্থিক কষ্টে ছিলেন। সে দুঃসময় ভুলে তারা আগের রূপে ফিরেছেন। অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছেন। জিম্মি করে আদায় করছেন দ্বিগুণ ভাড়া। এ নিয়ে যাত্রীদের ক্ষোভ-হতাশার অন্ত নেই।স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গত ১ জুন থেকে বিদ্যমান বাস-মিনিবাসের ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ৬৬ দিন লকডাউন শেষে ৩১ মে গণপরিবহন চলা শুরু হয়। বলা হয়, বাড়তি ভাড়ার কারণে পরিবহন মালিকদের ক্ষতি পোষানো হবে। কিন্তু করোনা সংকটের শুরুর দিকে বাস ও মিনিবাসে সীমিত যাত্রী বহন ও স্বাস্থ্যবিধি কিছুটা অনুসরণ করা হলেও যাত্রীর চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগের মতোই অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন শুরু হয়েছে। অথচ বাড়তি ভাড়া আর কমানো হয়নি। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬০ শতাংশের পরিবর্তে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। পরিবহনকর্মীরা বাড়তি ভাড়া আদায়ে শতভাগ তৎপর থাকলেও স্বাস্থ্যবিধিসহ প্রজ্ঞাপনের অন্যসব শর্তের দিকে কোনো নজর নেই। বেশি ভাড়ার বিনিময়ে দুই সিটে একজন বসানোর নিয়ম ভেঙে এখন পিক আওয়ারে সিট ভর্তির পর দাঁড় করিয়েও যাত্রী নেওয়া হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে গত ১০ আগস্ট সড়ক নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন পরিচালনার বিষয়ে আবারও সতর্কতা জারি করেছে। বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সড়ক-মহাসড়কে যাত্রীসাধারণের যাতায়াত নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করার নিমিত্ত স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বাস-মিনিবাস চলা অব্যাহত রাখা, দূরপাল্লার গাড়িতে মধ্যবর্তী স্থানে যাত্রী ওঠানো-নামানোর জন্য গাড়ি না থামানো এবং সরকার নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় করা যাবে না মর্মে সিদ্ধান্ত রয়েছে। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, কিছু কিছু যানবাহনে উপরোক্ত নির্দেশ মানা হচ্ছে না। এতে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ছে। ফলে জনসাধারণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘বাস চলা শুরুর সপ্তাহ পরই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন বাস মালিক ও শ্রমিকরা। যাত্রীরাও স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই বাসে ওঠা শুরু করেন। ওই সময় যাত্রী ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে আজকে এমনটা হতো না। এখন অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হচ্ছে। অতিরিক্ত ভাড়াও নেওয়া হচ্ছে। এর যৌক্তিকতা নেই। দ্রুত আগের ভাড়ায় ফেরত আসতে হবে।’
বাস মালিকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব এনা ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘১ জুন শর্ত সাপেক্ষে গণপরিবহন চালু শুরু হয়। কিন্তু ঈদের প্রাক্কালে যখন যাত্রীর চাপ বাড়ে তখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটে। ঢাকা সিটির কিছু কিছু বাস বা আন্তজেলায় বাস পরিবহনে কিছু সমস্যা হয়। সে অভ্যাস এখনো চলছে। অফিস শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে প্রয়োজনের বেশি যাত্রীই উঠে যাচ্ছেন। এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আমরা কয়েকটি বৈঠক করেছি। চিঠিপত্রও দিয়েছি। এ নিয়ে আগামী বুধবার বিআরটিএর সঙ্গেও বৈঠক আছে। ডিএমপি, হাইওয়ে পুলিশও এ ব্যাপারে কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি মনে করি, যাত্রীর চাপ থাকলে এটা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। ভারতের মতো বাসে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে যত সিট তত যাত্রী- এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যদি অনুমতি দেয়, তাহলে অতিরিক্ত ভাড়া না নেওয়ার ক্ষেত্রে মালিকরা সম্মত হবেন। যেহেতু সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে, এটাও এখন চিন্তা করার বিষয়। বাস মালিকদের দুই দিকেই সমস্যা। সারা দেশের রাস্তাঘাটে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন কাজ। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের সহযোগিতা জরুরি। আর যাত্রী বাড়লে তো এটা নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন।’
ব্যাপক হারে গণপরিবহন চালু হওয়ায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মানুষের যাতায়াত বেড়েছে। সরকারি-বেসরকারি সব অফিস-আদালত, কলকারখানা খুলে দেওয়ায় চাপ বেড়েছে যাত্রীপরিবহনে। এ ক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্ব বজায় না রাখা, মাস্ক না পরার প্রবণতাও বেড়েছে। রাজধানীর সায়েদাবাদ, মহাখালী, ফার্মগেট, মিরপুরসহ বিভিন্ন বাস স্টপেজে দেখা গেছে, বাসে ওঠার সময় বেশির ভাগ গাড়িতেই যাত্রীর তাপমাত্রা পরিমাপ ও জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে না। যাত্রীর অধিকাংশই মাস্ক পরছেন না। বাসের হেলপার প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে গায়ে হাত দিয়ে যাত্রী তুলছেন। তাদের হাতে গ্লাভস নেই, অনেকের মুখে নেই মাস্কও। তুরাগ, আকাশ, বিহঙ্গ, বলাকা, রাইদা, শিকড়, বৈশাখী, ফাল্গুন, অনাবিলসহ বিভিন্ন গণপরিবহনে এ চিত্র দেখা গেছে।
বাড্ডা থেকে পল্টনগামী বাসের যাত্রী ব্যাংকার তারেক মাহমুদ বলেন, ‘বাসের ভাড়া দিচ্ছি দ্বিগুণ। কিন্তু অফিস আওয়ারে দেখি সব সিটেই যাত্রী তোলা হচ্ছে। কখনো কখনো যাত্রীরা দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। হেলপার এখন আর মাস্ক পরেন না। হ্যান্ড গ্লাভসও পরেন না। তারা প্রবেশপথে না দাঁড়িয়ে দরজার সামনে প্রথম সিটে বসলে ভালো হতো। এতে শারীরিক দূরত্ব তৈরি হতো।’ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শরিফ হোসেন জানান, তিনি প্রায় প্রতিদিনই শাহজাদপুর থেকে উত্তরায় অফিসে যান। এ পথের অধিকাংশ গণপরিবহনে এখন আর কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। অবশ্য কিছু কিছু পরিবহনে দেখা গেছে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারসহ কিছু বিধি মানতে। শ্যামলীতে ৮ নম্বর বাসের যাত্রী জুবায়ের হোসেন অভিযোগ করেন, করোনার আগে মাজার রোড থেকে ফার্মগেট ১৫ টাকা ভাড়া নিলেও এখন ৩০ টাকা আদায় করছে। এ নিয়ে কথা বললে হেলপাররা দুর্ব্যবহার করেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ খান জানান, দূরপাল্লার বাসেও নৈরাজ্য চলছে। তিনি গত সপ্তাহে এশিয়া সার্ভিসে ঢাকা থেকে কুমিল্লা যান ২৫০ টাকার ভাড়া ৪৫০ টাকা দিয়ে। কিন্তু বাসে স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোনো বালাই ছিল না। ফেরার পথে তিশা সার্ভিসের বাসে অনেক মধ্যবর্তী স্থানে থেমে যাত্রী তোলা হয়।