সরকারি ক্রয় শেষ না হতেই বাড়ছে চালের দাম
নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর দেশের বাজারে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এরপর কয়েক মাসের ব্যবধানে তা সহনীয় হয়ে আসে। তবে দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকার পর আবারো হঠাৎ করেই বাড়ছে চালের দাম। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বন্যা পরিস্থিতির পাশাপাশি সরবরাহ সংকটের কারণ দেখিয়ে এক সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। সরকারিভাবে চাল সংগ্রহ কার্যক্রম শেষ না হতেই পাইকারি দাম বাড়তে থাকায় চালের বাজার নিয়ে অস্থিরতার আশঙ্কা করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোরবানির ঈদের পর থেকেই চালের দাম বাড়তে শুরু করে। উত্তরবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির কারণে চালের সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে মোকামগুলো দামও বাড়িয়ে দেয়। প্রায় ১০ দিনের ব্যবধানে দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে বস্তাপ্রতি বেড়ে যায় সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পর্যন্ত। দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে চালের সরবরাহ কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরাও প্রতিদিন বাড়তি দাম হাঁকছেন।
খাতুনগঞ্জ-চাক্তাই এলাকার বিভিন্ন মোকামে চালের বাজারদর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ সময়ের মধ্যে পাইজাম সিদ্ধ বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ২ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মিনিকেট আতপ ২ হাজার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৩০০ টাকা, মিনিকেট সিদ্ধ ২ হাজার ২০০ থেকে বেড়ে ২ হাজার ৪০০ টাকা, নাজিরশাইল ২ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার টাকা, আতপ বেতি চাল ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার ১০০ টাকা, পারি সিদ্ধ ২ হাজার ২০০ থেকে বেড়ে ২ হাজার ৩৮০ টাকা, পুরনো পাইজাম ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা, ইরি আতপ ১ হাজার ৫০০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৭৫০ টাকা, স্বর্ণা সিদ্ধ ২ হাজার থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২৪০ টাকা, মোটা সিদ্ধ ১ হাজার ৮০০ থেকে বেড়ে ২ হাজার টাকা, সিদ্ধ জিরাশাইল ২ হাজার ৩০০ থেকে বেড়ে ২ হাজার ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সদ্য শেষ হওয়া বোরো মৌসুমে সরকার ১১ লাখ ৫০ হাজার টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এর মধ্যে ১০ লাখ টন সিদ্ধ ও দেড় লাখ টন আতপ চাল। চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে জুনে ৬০ শতাংশ, জুলাইয়ে ৯০ শতাংশ ও ১৫ আগস্টের মধ্যে শতভাগ সংগ্রহ নিশ্চিত করার আশা করেছিল সরকার। তবে ১১ আগস্ট পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে ৭ লাখ ৫৬১ টন, যা লক্ষ্যমাত্রার ৬১ শতাংশ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় রয়েছে। সংগ্রহ করা ধান-চালের মধ্যে রয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭৬ টন ধান, ৪ লাখ ৬০ হাজার ৬৫৬ টন সিদ্ধ চাল ও ৬২ হাজার ১২৯ টন আতপ চাল। গত ২ জুলাই খাদ্য বিভাগ চাল সংগ্রহের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
খাতুনগঞ্জের রাইস মিল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি শান্ত দাশগুপ্ত বলেন, দেশে চালের সংকট নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বন্যা পরিস্থিতির পাশাপাশি সরকারিভাবে চাল আমদানির ঘোষণা দেয়ার পর বাজার হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরাও এ সুযোগে চালের বাজার নিয়ে কৃত্রিম সংকটের চেষ্টা করছে। তবে চাল আমদানি শুরু হলে ও সরকারিভাবে ন্যায্যমূল্যে চাল সরবরাহ দেয়া হলে দাম সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।
চট্টগ্রামের শীর্ষ কয়েকজন আড়তদার বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, সারা দেশে কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে চালের সবচেয়ে বেশি সরবরাহ হয়। তবে আগের মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাল কল ও চাতাল মালিকের হাতে চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণ নেই। সারা দেশে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হাতে চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ায় কৃত্রিম সংকটে দাম বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ধানের উৎপাদন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বা লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতা কিংবা চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাজারে চালের দামের ওঠানামায় ভূমিকা রাখছে। চাল সিন্ডিকেটগুলোকে নজরদারির আওতায় নিয়ে আসার পাশাপাশি সরকারি মজুদ পর্যাপ্ত করা গেলে চালের বাজার ফের সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে বলে মনে করছেন তারা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি বাজারে চালের দাম বাড়লে খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়ে প্রায় দ্বিগুণ। পাইকারিতে প্রতি কেজি চালের দাম ২ টাকা বাড়লে খুচরায় বেড়ে যায় ৩ থেকে ৪ টাকা। এভাবে পাইকারি বাজারের দাম বাড়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয় সাধারণ ক্রেতারা। দেশের পাইকারি বাজারে সাম্প্রতিক চালের দাম বাড়ার পর খুচরায় এর প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। খুচরা বিক্রেতারা আরো দাম বাড়ার আশঙ্কায় পাইকারি বাজারের চেয়ে বেশি দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে দাম আরো বাড়ার আশঙ্কা তৈরির কারণে বাজারে একটি অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, সরকারি চাল সংগ্রহ নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে খাদ্য বিভাগেও। গত ২ জুলাই খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে দেয়া এক পত্রে চাল সংগ্রহ নিয়ে অসন্তোষের পাশাপাশি চাল সংগ্রহের সময়সীমা বাড়িয়ে দেয়া হয়। বিশেষত বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে চাল সংগ্রহের সময়সীমা বাড়িয়ে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত করা হয়। এর পরও লক্ষ্যমাত্রা থেকে এখনো ৪০ শতাংশ পিছিয়ে আছে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা। সম্প্রতি দেশের খাদ্য মজুদ বাড়াতে আমদানির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তবে চাল আমদানিতে এলসি মার্জিন (ঋণপত্র) কত হবে সে বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত নির্দেশনা না পাওয়ায় চালের বাজার বাড়ছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীদের অনেকে।