যশোরে ৩ কিশোরের মৃত্যু প্রহারে!
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে কিশোরদের দুপক্ষের সংঘর্ষে নয়, কেন্দ্রটির কর্মচারীদের মারধরে তিন কিশোরের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একই ধরনের অনুমান করছে স্থানীয় পুলিশও। এছাড়া এ ঘটনায় যারা আহত হয়েছে তাদের জখমও সংঘর্ষজনিত নয়। যদিও শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বরাতে পুলিশ প্রথমে বন্দি কিশোরদের দুপক্ষের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি করা আহত কিশোররা বলছে, কেন্দ্রের আনসার সদস্যরা তাদের ১৮ জনকে বেঁধে পেটানোর কারণেই হতাহতের ঘটনা ঘটে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে পেটানো হলেও হতাহত কিশোরদের কয়েক দফায় সন্ধ্যার দিকে স্থানীয় আড়াইশ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। পুলিশ এ হাসপাতাল থেকেই কিশোরদের হতাহতের খবর প্রথমে পায়। উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে তাদের কিছুই জানানো হয়নি। কিশোরদের হতাহতের ঘটনায় কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আবদুল্লাহ আল মাসুদকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। কেন্দ্রটির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন নিহত এক কিশোরের বাবা। এছাড়া এ ঘটনায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তর আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে কিশোরদের হতাহতের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে কেন্দ্রটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে বলে জানিয়েছেন যশোরের পুলিশ সুপার মো. আশরাফ হোসেন। তিনি গতকাল রাতে বলেন, ‘বর্তমানে উন্নয়ন কেন্দ্রের ১০ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং পর্যায়ক্রমে ওই কেন্দ্রে থাকা আনসার সদস্যদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ মামলার পর তদন্ত শুরু করে দায়ীদের গ্রেপ্তার করা হবে বলেও জানান পুলিশ সুপার। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কাউকে আটক বা গ্রেপ্তারের পর্যায়ে আমরা নেই। আমরা শুধু আহত কিশোরদের অভিযোগ এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যে তথ্য পেয়েছি তার ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। সব তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে দায়ীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। ঘটনার সঙ্গে কয়েকটি সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা যুক্ত থাকায় খুব সাবধানে এগোতে হচ্ছে।’
জানা গেছে, যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে হতাহতের ঘটনায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তর আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে হতাহতের অভিভাবকসহ শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে অবস্থানকারীদের অভিভাবকরা কেন্দ্রের সামনে ও যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভিড় করছেন। নিহত কিশোর পারভেজের মা পারভীন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘গত পরশু দিন (বুধবার) ছেলে আমার মোবাইলে ফোন করে বলেছে “ভেতরে স্যারেরা মারছে। খেতে দেয়নি মা, আমারে নিয়ে যাও মা।”’ তার সন্তানসহ কেন্দ্রে আটক থাকা সব শিশুকে নির্যাতন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন পারভীন।
নিহত কিশোর নাইমের বড় ভাই শামীম বলেন, ‘কেউ আমাদের খবর দেয়নি। টেলিভিশনে খবরে মৃতদের মধ্যে আমার ভাই নাইমের ছবি ও নাম দেখে সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়েছি। আমার ভাইকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। আমি বিচার চাই।’ শামীম জানান, তাদের বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জ থানার তালিপপুর পূর্বপাড়ায়।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে মর্মান্তিক ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। আমরা যারা অপরাধ বিষয় নিয়ে কাজ করি, তারা ঘটনার প্রায় ছয় ঘণ্টা পর বিষয়টি অবহিত হয়েছি। যা খুবই দুঃখজনক। সময়ক্ষেপণ করায় মূল ঘটনা জানা জটিল ও সময়সাপেক্ষ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
এ পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘যারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তারাই এ ঘটনার মূল সাক্ষী। মৃত্যুপথযাত্রী কেউই মিথ্যা কথা বলে না। তাদের কথার সত্যতা ও যৌক্তিকতা আছে। আমাদের তদন্তে তাদের জবানবন্দি ও সাক্ষ্য সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে। আমি বলতে চাই, ঘটনা একপক্ষীয়। সেখানে শিশুদের ভিকটিম বানানো হয়েছে।’
যশোর জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা প্রাথমিক তদন্তে দেখেছি, সামান্য অপরাধে শিশুদের বেধড়ক নির্যাতন করা হয়েছে। এমনকি নির্যাতনে তাদের প্রাণহানি হয়েছে। এটা কোনোভাবেই ছোটখাটো অপরাধ নয়। এ ঘটনায় দায়ী কেউ ছাড় পাবে না। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইতিমধ্যে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ১০ জনকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।’
যাদের পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ, প্রবেশন অফিসার মুশফিক আহমেদ ও প্রধান নিরাপত্তাকর্মী নুর ইসলাম। এদের মধ্যে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আবদুল্লাহ আল মাসুদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম।
যশোর আড়াইশ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কিশোর চুয়াডাঙ্গার পাভেল জানায়, গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রের প্রধান নিরাপত্তাকর্মী (হেড গার্ড ও আনসার সদস্য) নুর ইসলাম তার চুল কেটে দিতে বলেন। সেদিন কেন্দ্রের প্রায় ২০০ জনের চুল কাটতে কাটতে তার হাত ব্যথা হয়ে যায়। সে কারণে তার চুল পরে কেটে দেওয়া হবে বলে জানালে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে গালাগাল করতে থাকেন। একপর্যায়ে নুর ইসলামকে কয়েকজন কিশোর মারধর করে।
পাভেল আরও জানায়, ওই ঘটনার পর গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে তাকেসহ বেশ কয়েকজন কিশোরকে অফিসে ডাকা হয় এবং বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। তারা ঘটনা জানানোর একপর্যায়ে আনসার সদস্য নুর ইসলামের নেতৃত্বে কিশোরদের মারধর করা হয়। পরে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ ও প্রবেশন অফিসার মুশফিকসহ অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মারধরে অংশ নেন। পাভেলসহ আহত একাধিক কিশোরের অভিযোগ, প্রবেশন অফিসার মুশফিক মারধরের সময় বলেন ‘তোদের বেশি বাড় বেড়েছে। জেল পলাতক হিসেবে তোদের বিরুদ্ধে মামলা করে ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে।’
তারা আরও জানায়, মারধর করে কিশোরদের কেন্দ্রের খোলা চত্বরে ফেলে রাখা হয়। কাউকে কোনো চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। পরে একজন করে মারা যাওয়ার পর রাত ৮টা থেকে ১১টার মধ্যে চার দফায় হতাহতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তিনজনকে মৃত ঘোষণা করেন।
গতকাল দুপুরে নিহত তিনজনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয় যশোর জেনারেল হাসপাতাল মর্গে। এরপর গতকাল রাতে নিহত কিশোর পারভেজ হাসান রাব্বির বাবা রোকা মিয়া তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে যশোর কোতয়ালি থানায় মামলা করেন। যশোর কোতয়ালি থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, রোকা মিয়া শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কর্র্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। মামলা নম্বর ৩৫।
রোকা মিয়া খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বর পাশার মানিকতলার বাসিন্দা। নিহত পারভেজ হাসানের বাবা রোকা মিয়া তার ছেলেকে হত্যার অভিযোগে গতকাল রাতে যশোর কোতোয়ালি থানায় মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম জানান, কেন্দ্রে হতাহতের ঘটনায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তর আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এর মধ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, একজন সহকারী পুলিশ সুপার ও জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা। আর সমাজসেবা অধিদপ্তর গঠিত কমিটিতে আছেন অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) যুগ্ম সচিব সৈয়দ মো. নূরুল বাসির ও উপপরিচালক এএম মাহমুদুল্লাহ।
পরিবারে শিশুকে নৈতিক শিক্ষাগুলো দিতে হবে : শিশুদের প্রতি কেন রূঢ় আচরণ করা হয়েছে বা শিশুরা কেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও অপরাধবিষয়ক গবেষক ড. সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান বলেন, ‘শিশু-কিশোররা সাধারণত পরিবারে যে ধরনের আচরণ পেয়ে থাকে, সেগুলোর প্রতিফলন তাদের মধ্যে হয়। তাই পরিবারে তাদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষাগুলো দিতে হবে। আপনি যদি আপনার শিশুর সামনেই একজন রিকশাচালক বা হকারের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন শিশু তাই শিখবে। এটা উচ্চ-নিম্নবিত্ত সবার জন্যই প্রযোজ্য।’
যেসব শিশু প্রতিষ্ঠানের অধীনে থাকে তারা কী পরিবেশে বড় হচ্ছে সে বিষয়টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে অপরাধবিষয়ক এ গবেষক আরও বলেন, ‘স্কুল ও সরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে শিশুদের ভদ্রতা, শালীন আচরণ ও সহমর্মিতার বিষয়ক পাঠ্যক্রম খুবই কম। তাই তারা সঠিক শিক্ষা পায় না। তাছাড়া তাদের যারা পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের আচার-আচরণও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে যদি কিশোরদের বেঁধে পেটানোর ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে বিষয়টি খুবই ভয়ানক।’