ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি ডিইউজের
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং এই আইনে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দাবি জানিয়েছে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।
বৃহস্পতিবার ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের এক সভায় এ দাবি জানানো হয়। সভায় ডিজিটাল কালো আইন পাসের দিন “১৯ সেপ্টেম্বর : মুক্তসাংবাদিকতার অন্তর্ধান দিবস” হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাংবাদিক সমাজ এখন থেকে প্রতি বছর এ দিবসটি পালন করবে।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ শহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সভায় অন্যদের মধ্যে নুরুল আমিন রোকন, কায়কোবাদ মিলন, শাহীন হাসনাত, ডিএম অমর, খন্দকার আলমগীর হোসাইন, আবুল কালাম, দেওয়ান মাসুদা সুলতানা, শহিদুল ইসলাম, জেসমিন জুঁই, আবুল হোসেন খান মোহন, মো: আব্দুল হালিম, শামসুল আরেফিন, আলমগীর শিকদার, আবু বকর, আবু হানিফ ও তাসরিন প্রধান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
সভায় বলা হয়, করোনাকালে যেখানে রাষ্ট্রকে মানবিক হওয়ার কথা ছিল, সেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক নিপীড়ন আরো বেড়েছে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় অব্যবস্থাপনার সমালোচনা করায় সম্প্রতি সম্পাদকসহ সাংবাদিক, লেখক, কার্টুনিষ্ট, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনা একের পর ঘটেই যাচ্ছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অবাধ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ বিনষ্ট এবং গণমাধ্যমের কর্মীদের ওপর পুলিশের ক্রমবর্ধমান নিপীড়নমূলক পদক্ষেপে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অবিলম্বে আইনটি বাতিলের দাবিলের দাবি জানায় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নে।
সভায় সাংবাদিক নেতারা বলেন, গত কয়েক মাসে প্রায় ৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে ৩৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব গ্রেফতারের ঘটনা এমন এক ভীতির পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে স্বাভাবিক সাংবাদিকতার কাজও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সভায় বলা হয়, ‘আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে অন্য আইনের তুলনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এখন অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি ব্যবহার হচ্ছে। এর কারণ হলো, এই আইনের আওতায় পুলিশ পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে এবং এই আইনের বেশির ভাগ ধারাই অজামিনযোগ্য। ফলে এই আইনে গ্রেফতার হওয়ার পর একজন ব্যক্তিকে কারাগারেই রয়ে যেতে হয়।
সাংবাদিক নেতারা বলেন, নিপীড়নমূলক এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পুলিশকে কোনো প্রকার পরোয়ানা ছাড়াই স্রেফ সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গ্রেফতারের ক্ষমতা দিয়েছে। এর ২০টি ধারার ১৪টিই অজামিনযোগ্য এবং যখনই মামলা হয়, পুলিশ দ্রুত গ্রেফতার করে। আসামিকে বিচারকের সামনে হাজির করার পর স্বাভাবিকভাবেই তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। আর জেলে পঁচতে হয় এ মামলার আসামিদের।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতারা বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে শাসকগোষ্ঠী জনগণের কন্ঠ রোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তাই অনিয়ম ও দুর্নীতির অনেক খবর অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে।
সভায় বলা হয়, অন্যান্য আইনে দায়েরকৃত মামলার তুলনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিতৎপরতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। শুধু সাংবাদিকরাই নয়, এমামলা থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছে না। সরকারের সমালোচনা করলেই গ্রেফতার করা হচ্ছে।সম্প্রতি রংপুর ও রাজশাহীতে দুজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে, যাদের একজন নারী, মামলা দায়েরের পর পরই কোনো রকম তদন্ত ছাড়াই মধ্যরাতে গ্রেফতার করা হয়। অথচ হত্যাচেষ্টা ও দুর্নীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলার আসামিরা চার্টার্ড ফ্লাইটে দেশত্যাগ করেছেন; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিষয়ে কোনো তৎপরতা দেখায়নি। আইন প্রয়োগের এই বৈষম্যমূলক প্রবণতা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি বিরাট হুমকি হয়ে উঠেছে। স্থিতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা ও টেকসই উন্নয়নের স্বার্থেই স্বাধীন মতপ্রকাশের চর্চা নির্বিঘ্ন হওয়া প্রয়োজন। সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে বারবার আহ্বান সত্ত্বেও, সরকার বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সংশোধন করতে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না।
সাংবাদিক নেতারা বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে কারাবন্দিদের জামিনে মুক্তি দেয়া হচ্ছে। ভার্চ্যুয়াল আদালতে ৩০ দিনে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত ৪৫ হাজার ব্যক্তির জামিন হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় অভিযুক্তরা খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো ভয়ঙ্কর কোনো মামলার আসামি নন। তবুও তাদের জামিন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক, প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদ, পক্ষকাল ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল এবং দৈনিক কক্সবাজার বাণীর সম্পাদক ফরিদুল মোস্তফা খানের জামিন আবেদন বার বার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আমরা আবুল আসাদ, শফিকুল ইসলাম কাজল, ফরিদুল মোস্তফা খানসহ মতপ্রকাশের কারণে এই আইনে গ্রেফতার অন্য অভিযুক্তদের অবিলম্বে মুক্তি ও সংশ্লিষ্ট মামলাগুলো প্রত্যাহারের আহ্বান জানাচ্ছি।
সভায় গৃহীত অন্যান্য সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে
১. গণমাধ্যমে ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে এবং করোনাকালে চাকরিচ্যূতদের চাকরিতে পুনর্বহাল করতে হবে।
২. অবিলম্বে বকেয়া বেতন পরিশোধ করতে হবে।
৩. সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এ লক্ষ্যে মিডিয়ার স্বাধীনতা বিরোধী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে।
৪. প্রবীণ সাংবাদিক, দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদ, ফটোসাংবাদিক শহিদুল ইসলাম কাজল, দৈনিক কক্সবাজার বাণীর সম্পাদক ফরিদুল মোস্তফা খানসহ গ্রেফতারকৃত সকল লেখক সাংবাদিকদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে এবং বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজি, সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদসহ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
৫. দৈনিক আমার দেশ, চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, সিএসবি টেলিভিশনসহ সকল বন্ধ মিডিয়া খুলে দিতে হবে।
৬. সাংবাদিক দম্পতি সাগর- রুনিসহ সকল সাংবাদিক হত্যার বিচার করতে হবে।
৭. পক্ষপাতহীনভাবে বেকার সাংবাদিকদের তালিকা করে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।
প্রেস বিজ্ঞপ্তি