প্রধান প্রকৌশলী ব্যস্ত নিজের সিন্ডিকেট নিয়ে
তিনি যেখানেই যাবেন, সেখানেই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়বে এবং টাকার পরিমাণ বাড়বে। মানুষের দুর্ভোগের জন্য নেওয়া প্রকল্পগুলো আলোয় আসবে না। নিজের পছন্দের লোকের পকেট ভারী হবে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটছে না। চার মাসেও তিনি চলমান ১৪ প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করতে পারেননি। ফলে কাজ এগোচ্ছে না। এরই মধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছেন। আবার নতুন কাজ পাইয়ে দিতে নিজের পছন্দের প্রতিষ্ঠানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছেন। কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে কৌশলে কাজ পাইয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না এই কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, প্রকল্পের কাজ ধীরগতি করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর অভিযোগেরও অন্ত নেই। দুদকেও জমা পড়ছে অভিযোগ। কাজের জায়গায় না থেকে ঢাকায় থেকে নিজের সিন্ডিকেট ঠিক রাখতে ব্যস্ত থাকা এই কর্মকর্তা হলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রধান প্রকৌশলী অখিল কুমার বিশ্বাস।
পাউবোর একাধিক কর্মকর্তা ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডে এ রকম অনেক ভূত রয়েছে। এসব ভূতের দখল থেকে পাউবোকে মুক্ত করতে না পারলে প্রকল্পের পর প্রকল্প হবে মানুষের দুর্ভোগ যাবে না। অখিল কুমারদের মতো কর্মকর্তা ও তাদের সিন্ডিকেটের পকেট ভারী হবে কিন্তু কাজ শেষ হবে না। নদী নাব্য পাবে না। জলাবদ্ধতা আরও বাড়বে। চট্টগ্রাম ও এর আশপাশে নদীর নাব্য ও শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে আরও প্রকল্পের প্রস্তাব আসবে। এসব কর্মকর্তার পছন্দের কোম্পানি কাজ পাবে। জানা গেছে, এর আগে ২০১২ সালে এবং ২০১৫ সালে কয়েক দফা ঘুষ গ্রহণ ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তিনি জোর তদবির করে পার পেয়ে যান।
পাউবো ও স্থানীয় পর্যায় থেকে অভিযোগ উঠেছে, গত ১৯ মে তিনি যোগদান করলেও এখন পর্যন্ত সেখানে চলমান একটি প্রকল্পের কাজেরও অগ্রগতি নেই। এখন তিনি ব্যস্ত আছেন তার পছন্দের কালো তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানিকে ২৫ কোটি করে ৬টি ভাগে দেড় শ কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে। আর নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে তিনি, তার কর্মস্থলে নিজের বিশ্বস্ত লোককে বদলি করে আনার চেষ্টা করছেন। এমনকি এখন যারা আছেন, তাদের জন্য বরাদ্দকৃত বাসাও তারা দিচ্ছেন না। তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না কেউ। পাউবোর ঠিকাদার ও ওই অঞ্চলে কর্মরতরা বলছেন, তার নিজের লোক দিয়ে তিনি অনিয়ম ও দুর্নীতি নির্বিঘেœ করার জন্য বলয় করার চেষ্টা করছেন। গত চার মাসেই সেখানে শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম নগর ও ওই অঞ্চলের পানি ও জলাবদ্ধতা সংক্রান্ত সমস্যা দূর করতে প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার কাজ চলমান। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এসব কাজ বাস্তবায়ন করছে। অভিযোগ উঠেছে, যথাযথ তদারকির অভাবে সময়মতো এসব কাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি হয়েছে। পাউবোর ওই অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী অখিল কুমার বিশ^াস যোগদানের পর থেকে ঢাকা সফর ও ব্যক্তি কাজ নিয়েই ব্যস্ত আছেন। অভিযোগ রয়েছে, তার পছন্দের একটি কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিতেই নাকি তিনি ঢাকায় দৌড়ঝাঁপ করছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য গতকাল রবিবার দুপুরে পাউবো চট্টগ্রাম দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে গিয়ে অখিল কুমার বিশ^াসকে পাওয়া যায়নি। এ সময় দপ্তরে থাকা প্রধান প্রকৌশলীর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) পুষ্পিতা ঘোষ বলেন, ‘স্যার ঢাকায় গেছেন। আজ অফিসে আসার কথা থাকলেও আসেননি। মন্ত্রণালয়ে মিটিং আছে হয়তো।’
অখিল কুমারের সরকারি বাংলোয় তার খোঁজ নিতে গেলে নিরাপত্তাকর্মী মো. জামাল বলেন, ‘স্যার বাসায় নেই। অফিসের কাজে বর্তমানে ঢাকায় আছেন।’ এর বেশি কোনো কথা না বলে তিনি ভেতরে চলে যান। অখিল এখন কোথায় এবং কর্মস্থল ছেড়ে রাজধানীতেই বা কী করছেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে অখিল কুমার বিশ^াস বলেন, ‘আমি বৃহস্পতিবার ঢাকায় এসেছি। এর আগেও যে কয়বার ঢাকায় এসেছি তা পাউবোর কাজেই। এখানে দাপ্তরিক কিছু কাজ ছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাউবোর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, অখিল প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে যোগদানের পর প্রথম দিকে কর্মতৎপরতা দেখান। এটা ছিল তার একটা কৌশল। পরে প্রকল্পসহ বিভিন্ন কাজের দিকে মনোযোগী না হয়ে কৌশলী হয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের দিকেই সময় বেশি দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায়ে স্বয়ং কর্মচারীরাই স্থানীয়দের কাছে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হন।’
পাউবো সূত্রে জানা যায়, গত ১৯ মে অখিল কুমার বিশ্বাস পাউবোর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি চলমান ১৪টি প্রকল্পের সবগুলো পরিদর্শন করতে পারেননি। যেসব প্রকল্প পরিদর্শন করেছিলেন, সেগুলোও এখন স্থবির হয়ে আছে। ইতিমধ্যে দুটি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু কাজের অগ্রগতি হয়নি। ওই প্রকল্প দুটির মেয়াদ আবারও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
অখিল কুমার যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালনকালে কপোতাক্ষ নদ খনন প্রকল্পে ২৬২ কোটি টাকার প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। সে সময় সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বিস্তীর্ণ জনপদের জলাবদ্ধতা নিরসন এবং এই অঞ্চলকে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য কপোতাক্ষ নদ খনন প্রকল্প শুরু হয়েছিল। কিন্তু অনিয়মের কারণে নদটি নাব্য হারায়। সৃষ্টি হয় নতুন জলাবদ্ধতা। এ সময় তার বিরুদ্ধে সভা-সেমিনারও হয়েছিল। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দকৃত টাকার বেশির ভাগই মাদারীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ভাগাভাগি করে নিয়েছেন বলে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী যোগদানের পর শ্রমিক-কর্মচারীদের ওয়াপদা কলোনি পরিদর্শন করার রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু নানা অজুহাত দেখিয়ে এখন পর্যন্ত তিনি সেখানে যাননি। এতে শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যেও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তিনি বর্তমান কর্মস্থলে যোগদানের পর আগের কর্মস্থলের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি করে নিজ দপ্তরে একটি শক্তিশালী বলয় তৈরি করার চেষ্টায় আছেন। তার আনুগত্য না করায় আবাসন ফাঁকা থাকার পরেও অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আবাসন সুবিধা দিচ্ছেন না তিনি। পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে ঢাকা টু চট্টগ্রাম দৌড়ঝাঁপে ব্যস্ত থাকেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অখিল কুমার বিশ্বাস গতকাল বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ আনার পেছনে রয়েছে একটি চলমান টেন্ডার। দরপত্রে চতুর্থ স্থানে থাকা একটি কোম্পানি কাজ পেতে চায়। কিন্তু কীভাবে তাদের কাজ দেব? এ জন্য এসব মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
চলমান কাজের ধীরগতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি চট্টগ্রামে যোগদান করেছি দুই মাসের বেশি কিছু সময়। নিজে সবগুলো প্রকল্প পরিদর্শনে যেতে না পারলেও আমি কিন্তু নিয়মিত খোঁজখবর রাখছি। এই করোনাকালে এমনিতেই সব কাজ ধীরগতিতে চলছে। এ জন্য হয়তো কিছু প্রকল্পের মেয়াদ বাড়তে পারে। কিন্তু এক টাকাও বরাদ্দ বাড়বে না। এ বছরের মধ্যে ৯টি প্রকল্প পুরোপুরি সম্পন্ন করার চেষ্টায় আছি।’
দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে আমি আগের কর্মস্থলের লোকজনকে বদলি করে আনার চেষ্টা করছি। এটা পুরোপুরি বানোয়াট। আর আমার বিরুদ্ধে দুদকেও কোনো অভিযোগ নেই। আমার কোনো পছন্দের কোম্পানিও নেই যাকে আমার কাজ দিতে হবে। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা দূর করার কাজ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে হচ্ছে। তাই সেখানে আমাদের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। যশোরের কপোতাক্ষ প্রকল্প নিয়ে আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।