সরকারের চাঁদাবাজি তথা লাইসেন্স ফি, পকেট কাটা যাবে জনগণের
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠি লিখেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ২ হাজার ৬৬৪ শব্দের ওই চিঠিজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আদ্যপান্ত। চিঠির একাংশ পাঠকদের জন্য হুবুহু ঊল্লেখ করা হলো-
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: প্রত্যেক হাসপাতালের সাথে আলাদা আলাদা ল্যাবরেটরি, আলাদা রোগ নির্ণায়ক (Xray,USG) বিভাগ, দন্ত বিভাগ, আলাদা রক্ত পরিসঞ্চালন (Blood Transfusion) বিভাগের লাইসেন্স নিতে হয়, যার বর্ধিত হার নিম্নরূপ।
ভবিষ্যতে হয়তো বা হাসপাতালের বিভাগের সংখ্যা আরও বাড়বে, যথা- ১) বায়োকেমিষ্ট্রী ২) সেরোলজী ৩) ক্লিনিকেল প্যাথলজী ৪) মাইক্রোবায়োলজী ৫) ইমিউনোলজী ৬) হিষ্টোপ্যাথলজী এবং আরও কত কি!! কেবল হাসপাতালের অনুমোদন থাকলে চলবে না, হাসপাতালের প্রত্যেক বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা অনুমোদন থাকতে হবে। অনুগ্রহ করে সরকারি চাঁদা কত বেড়েছে তা লক্ষ্য করুন। হয়রানি ও দুর্নীতি একত্রে চলাফেরা করে।
উদাহরণ হিসেবে, রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের (Blood Transfusion Department) জন্য অনুমোদন চাইতে হলে রক্ত পরিসঞ্চালন (Blood Transfusion) বিভাগ পরিচালনার জন্য রক্ত পরিসঞ্চালন সংক্রান্ত দুই বৎসর মেয়াদী একটা ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসক থাকতে হবে। বাংলাদেশে ২০০০ এর বেশি রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র আছে। উক্ত বিষয়ে দুই বৎসর মেয়াদী ডিপ্লোমা প্রাপ্ত চিকিৎসক আছেন ৮০ এর অনধিক। এ বিভাগে উচ্চ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অন্ততপক্ষে ১০ জন চিকিৎসক অবসর জীবন যাপন করছেন। ৬০ বৎসর অধিক বয়সী চিকিৎসকদের চাকুরি করার বিধান নেই। চিকিৎসকগণরা তো বিচারপতি বা সিনিয়র সচিব নন। রক্ত পরিসঞ্চালন (Blood Transfusion) বিভাগে ডিপ্লোমা MBBS চিকিৎসকদের জন্য ব্যবসায়িক দিক থেকে আকর্ষণীয় নয় বলে, তরুণ চিকিৎসকরা দুই বৎসর ব্যয় করে এই উচ্চ বিদ্যা অর্জনে আগ্রহী নন। রক্ত পরিসঞ্চালনে তিন মাসের প্রশিক্ষণ অধ্যয়নই যথেষ্ট।
বিগত ২০ বৎসর যাবৎ আমি বলে আসছি MBBS চিকিৎসকদের জন্য তিন মাস মেয়াদী রক্ত পরিসঞ্চালনে সার্টিফিকেট কোর্স এবং ৬ (ছয় মাস) মেয়াদী ডিপ্লোমা কোর্স প্রবর্তন করুন। তিন মাসের অতিরিক্ত এই বিভাগে শিক্ষা গ্রহণ বা অধ্যয়নে ব্যয় সময়ের অপচয় মাত্র। সরকার বিষয়টি গ্রহণ করেন নি। সরকারে বিষয়টি অনুধাবনের কর্মকর্তা নেই। আয়ের সম্ভাবনাও কম। ফলে চোখ বন্ধ করে দুর্নীতি করা সহজ হয়েছে।
অদ্যাপি বাংলাদেশে একটি রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র বন্ধ হয়নি, তবে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালকে সতর্ক পত্রের সংখ্যা বেড়েছে। সরকারের চাঁদাবাজি তথা লাইসেন্স ফি বাবদ সরকারের আয় বাড়বে, পকেট কাটা যাবে জনগণের, তাদের রক্ষার কিছু থাকবে না। থানার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে বিপদ আরও বাড়ে। ল্যাবরোটরী ও রোগ নির্ণায়ক সেন্টার সমেত হাসপাতাল রেজিষ্ট্রেশন ফি বৎসরে একলাখ টাকার বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। মিউনিসিপ্যাল হোল্ডিং ট্যাক্স ও আর এক ধরনের চাঁদাবাজি।
হাসপাতাল অনুমোদনের নিয়মাবলী ৩ সহজ হওয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কেবল নিশ্চিত করবেন প্রত্যেক হাসপাতালে ও ক্লিনিকে চিকিৎসার গুনগত মান- অর্থাৎ ন্যূনতম ইমার্জেন্সী চিকিৎসকের উপস্থিতি এবং চিকিৎসকদের নিয়মিত ব্যবহারের জন্য কয়েকটি অতি প্রয়োজনীয় সচল মেডিকেল যন্ত্রপাতির নিশ্চয়তা যেমন ফ্লোমিটার (Flow Meter) সমেত একাধিক অক্সিজেন O2 সিলিন্ডার, রক্তে অক্সিজেন মিশ্রন নির্ধারক পালস অক্সিমিটার (Pulse Oxymeter), এম্বু (AMBU) ব্যাগ, নেবুলাইজার (Nebulizer), রক্তচাপ মাপার যন্ত্র (BP Set) ও বিভিন্ন পরীক্ষার নির্ণায়ক ডায়াগনষ্টিক (Diagnostic Set), ওজন নির্ণায়ক (Weight Machine) একাধিক মেশিন, একটি ইসিজি (ECG) ও একটি ডিফিব্রলেটর (Defibrillator) মেশিন, মৌলিক রোগ নির্ণায়ক এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রাফী, ক্লিনিকেল প্যাথলজী ল্যাবরোটরী এবং রক্ত পরিসঞ্চালন সুবিধা।
সরকারি অযৌক্তিক অপ্রয়োজনীয় নিয়মাবলীর কারণে রিজেন্ট সাহেদ তৈরি হয়েছে ঢাকায় এবং প্রত্যেক শহরে ও উপজেলায় বহু রিজেন্ট সাহেদ, সাহাবউদ্দিন ও ডা. সাবরিনা তৈরি হচ্ছে এবং আরও হবে। গত বছর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডিপ্লোমা নার্সের নিয়োগ বিজ্ঞাপনে ব্যয় করেছে ৫ লাখ টাকার অধিক। সরকারি হাসপাতাল নীতিমালা পুরনের জন্য আমাদের প্রয়োজন ৫০ জন নার্স, ১০ জন নার্সও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রেচাকুরীর জন্য আবেদন করেনি।
সরকারি হাসপাতালে সেবা না দিয়ে ধবধবে ইস্ত্রি করা সাদা শাড়ী পড়ে ঘুড়ে বেড়ানো যায়, সরকারি চাকুরিতে সেবা না দিয়ে বেতন পাবার সুবিধে আছে। আপনি বলে দিন, আমাদের কি করণীয়? RAB দ্বারা ধৃত হবার পূর্বে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল কি বন্ধ করে দেব? বিগত কয়েক বছরে কয়েকটি সৌজন্যমূলক সতর্কবানী আমাদেরকে দেয়া হয়েছে। অনুগ্রহ করে এমন নিয়ম করুন, যা সহজে পালন করে জনসাধারণের কল্যাণ করা যায়। আইন শৃংখলা বাহিনী এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দালালদের দ্বারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা মালিকগন হয়রানির সম্মুখীন হবেন না, নিয়ম অনুসরন করতে না পারার অজুহাতে।
লেখক: গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি, প্রখ্যাত চিকিৎসক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং মুক্তিযোদ্ধা।