ব্যক্তি নয়, চাই সিস্টেমের পরিবর্তন
সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
বেশ কিছুদিন ধরে ভার্চুয়াল মিডিয়া তো বটেই, দেশের সংবাদমাধ্যমেও প্রাধান্য বজায় রেখেছে সাহেদ-সাবরিনারা। তার সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের মাস্ক কেলেংকারির সঙ্গে যুক্ত সাবেক ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেত্রী, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার শারমিন জাহান আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন মহাপরিচালক নিয়োগের বিষয়টি। সারা দেশ ভেসে যাচ্ছে বন্যায়। করোনার ছোবলে কাবু নিরন্ন মানুষ ভেসে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে, ছিন্নমূল হয়ে যাচ্ছে প্রায় গোটা দেশজুড়ে। তাদের খবর নেওয়ারও যেন কেউ নেই। অন্য সময়ে এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে তাতে এগিয়ে আসত অনেক স্বেচ্ছাসেবী ব্যক্তি ও সংগঠন। এমন বন্যায় খাদ্য ও খাবার পানির সংকট হয়ে থাকে সব সময়। পানিবাহিত রোগ বাড়ে। তাই বিশুদ্ধ পানি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, শুকনো খাবার নিয়ে বন্যার্তদের কাছে ছুটে যেত অনেকেই। ব্যানার টানিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দিনরাত রুটি বানিয়ে তা তুলে দিত বানভাসি মানুষের মুখে।
এবারের বন্যায় সে চিত্র অনুপস্থিত। করোনা সেই মানবিক উদ্যোগকেও বাধাগ্রস্ত করেছে। অথচ এইবার দেশে বন্যার প্রকোপ গত তিন দশকের মধ্যে ভয়াবহ ও দীর্ঘমেয়াদি বলে ধারণা করা হচ্ছে। বন্যা যত দীর্ঘমেয়াদি হবে, বন্যাদুর্গত এলাকায় খাদ্যাভাব তত প্রকট হবে, পানিবাহিত রোগ তত বেশি হবে। কিন্তু এবার সেই সব বানভাসি মানুষের শুধুই সরকারি সাহায্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। তবে সরকারি সাহায্য কতটুকু তাদের কাছে পৌঁছবে আর কতটা দলীয় নেতাকর্মীরা লোপাট করে দেবে সেটার ধারণা করোনাকালে সরকারি ত্রাণ বিতরণেই পাওয়া গেছে।
রাজধানী ঢাকা দুই-তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতেই কেন পানির নিচে ঢাকা পড়ে যায় সে নিয়েও আলোচনার সুযোগ মিলছে সামান্যই। গত পাঁচ বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে খরচ দেখিয়েছে ১ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা। আর ওয়াসা এ কাজে তিন বছরে খরচ দেখিয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা (প্রথম আলো, ২৭ জুলাই ২০২০)। তারপরও সামান্য বৃষ্টি হলেই ঢাকায় নৌকার কদর বেড়ে যায়। অনেকেই ঠাট্টা করে বলেন, এটাও সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ। সরকার হয়তো অচিরেই ঢাকায় দেশের চতুর্থ সমুদ্রবন্দর গড়ে তুলতে যাচ্ছে। কিন্তু ফেইসবুকে ট্রল করা ছাড়া এ আলোচনা বেশিদূর এগোতে পারেনি।
এমনকি ২০১৩ সাল থেকে অব্যাহতভাবে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে অন্তত ৪ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার মতো ভয়াবহ ঘটনা সিআইডি ও সংবাদমাধ্যম উন্মোচিত করলেও তা নিয়ে আলোচনা ডালপালা মেলতে পারেনি। এই ৪ হাজারের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে চিকিৎসক হিসেবে সনদও পেয়ে গেছেন। এমন গুরুতর জালিয়াতির পথ ধরে যারা চিকিৎসকের মতো মহান পেশায় ঢুকে গেছেন বা পাইপলাইনে আছেন, তাদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে সে বিষয়েও আমরা অন্ধকারেই রইলাম এখনো। আর সে সময় আমরা কিছু সংখ্যক মানুষ যখন টিভি টকশোতে প্রশ্নফাঁস রোধে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা করছিলাম, দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি করছিলাম, তখন সরকারের পক্ষে সাফাই গাওয়ার লোকেরও অভাব ছিল না। তারা অবলীলায় বলে দিতেন, আমরা সরকার বিরোধিতার নামে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার উদ্দেশ্যে সমালোচনা করছি। এখন এই ভয়াবহ জালিয়াতির বাক্স উন্মুক্ত হওয়ার পরে তাদের কাউকে একটু শরমিন্দা হতেও দেখলাম না। হয়তো এ নিয়ে আলোচনা উঠলে তারা সেখানেও সরকারের কৃতিত্বই দেখবেন। সাফ জানিয়ে দেবেন, এ জালিয়াতি তো সরকারই ধরেছে, অন্য কেউ তো ধরেনি। যেমনটি বলছেন সাহেদ-সাবরিনা-শারমিন গ্রেপ্তারের পর। সংবাদমাধ্যমে বিশ^াসযোগ্য প্রমাণ ও ব্যাপক সমালোচনা আসার পরও প্রশ্নফাঁসের জালিয়াতি ধরতে তাদের এতটা সময় লাগল যে ততদিনে অনেকে ডাক্তার হয়ে রোগী দেখা শুরু করে দিয়েছে! এই ব্যর্থতার দায় তারা আড়াল করবেন স্বভাবজাতভাবেই। মেডিকেল-ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল পরীক্ষায়ও এই দশা হলে অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষা এবং জুনিয়র সমাপনী, মাধ্যমিক সমাপনী, এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় যে কী স্তরের জালিয়াতি হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
করোনা সংক্রমণ অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকা অবস্থায় টেস্ট কমিয়ে দিয়েছে, পৃথিবীতে এমন একটা দেশই পাবেন। সেটা এই বাংলাদেশ। অন্য দেশগুলো যখন করোনা টেস্ট করতে আসার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করছে, এমনকি আর্থিক সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে করোনা টেস্টের জন্য ফি ধার্য করে হতদরিদ্রদের টেস্টবিমুখ করা হলো। কোরবানির পশুর হাট ব্যবস্থাপনায় সরকারের অব্যবস্থাপনার ধারাবাহিকতাই প্রকট হচ্ছে। রোজার ঈদের সময়ে সরকারি অব্যবস্থাপনার খেসারত যেমন দেশবাসীকে দিতে হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলকে দীর্ঘ করে, কোরবানির ঈদেও এই অব্যবস্থাপনার খেসারত সেভাবেই দিতে যাচ্ছি আমরা। অথচ সে বিষয়ে আলোচনাও মৃদু। আমরা পড়ে আছি রাঘব-বোয়াল ডাকাতদের পোষ্য ছিঁচকে চোরদের নিয়ে। এখানেও জালিয়াত চক্রটি বরাবরের মতোই রয়ে গেল অধরাই।
দেশের প্রতিটা সেক্টরে চলছে চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতির মহোৎসব। তার সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে সংশ্লিষ্ট সরকারি দল বা সরকারের লোকজন। এই দেশে সরকারি কেনাকাটায় ৩২০ টাকার বইয়ের দাম ধরা যায় ৮৩ হাজার টাকা, একটা আইসিইউ’র পর্দার দাম দেখানো যায় সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা, একটা বালিশ বিল্ডিংয়ের ওপরে বাসায় ওঠাতে খরচ দেখানো যায় সাত হাজার টাকা, করোনা মহামারীর কালে একটা ৫০০ টাকার গগলসের দাম ধরা যায় ৫ হাজার টাকা, একটা বঁটি-দায়ের দাম হয় ১০ হাজার টাকা। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা ভাগবাটোয়ারায় বনিবনা না হলে ভেতরের কোনো সোর্স সংবাদমাধ্যমে জানিয়ে দিলে সেইটুকুই কেবল আমরা জানতে পারি। আমরা যেটুকু জানতে পারি তা আইসবার্গের ওপরের একবিন্দু বরফ মাত্র।
দেশের সব সেক্টরে একই অবস্থা। কিন্তু বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অনিয়ম, জালিয়াতি নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে করোনার কারণে। সে কারণেই আমরা মেতে আছি সাহেদ-সাবরিনা-শারমিনকে নিয়ে। আমরা উল্লসিত হই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদত্যাগে। আমরা আবার অশাবাদী হই একজন নতুন ডিজি পেয়ে। কিন্তু চোর-বাটপার-লুটেরা-দুর্নীতিবাাজ-জালিয়াত তৈরির সিস্টেম অক্ষুণœ রেখে দুই-চারজন ছিঁচকে জালিয়াত ধরে, দুয়েকজন ব্যক্তির পরিবর্তন ঘটিয়ে কি কোনো লাভ হয়?
ধরা যাক, একটা পুকুরে মাছের মড়ক লেগেছে। সেই পুকুর থেকে দু’চারটা মাছ তুলে আনলে, সেগুলো ডাঙায় এসে ছটফট করে মরে যেতে পারে। আবার অনুকূল পরিবেশ পেলে বেঁচেও যেতে পারে। কিন্তু ওই পুকুর কি তাতে পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে? বাকি মাছের পচন থামবে? বরং বাইরে থেকে এনে সেখানে যে মাছ ছাড়া হবে, সেগুলোও অসুস্থ হয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে পচন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার, মানবাধিকার, সুশাসন, সুবিচার, আইনের শাসন, রাজনীতি, শিক্ষা কোথায় পচন ধরেনি? বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো বাতাস কোথায় আছে এই দেশে? ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, দরিদ্ররা যাচ্ছে আরও নিচে। কোথায় ভারসাম্য?
কিন্তু কে টেনে তুলবে এই দেশটাকে? সে আশার বিন্দু কি আদৌ আছে এদেশে? হয়তো নেই। নেই বলেই শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে দেশত্যাগের হিড়িক। একটা প্রজন্মের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকরা নিজ পরিবারের পরের প্রজন্মকে দেশে রাখার চেয়ে বিদেশে রাখাই শ্রেয় মনে করেন। এই দেশে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না করে লেখাপড়ার জন্য তাদের সন্তানদের পাঠিয়ে দেন বিদেশে। সেখানে গিয়ে তাদের কতজন লেখাপড়া করেন আর কতজন দেশ থেকে পাচার করা অঢেল অর্থ দিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করেন সে হিসাব কতটুকুই-বা জানি আমরা! বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বড় একটা অংশ যে এদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ সেটা বোঝা যায় তাদের বিদেশে টাকা পাচার ও সেকেন্ড হোম করার প্রবণতা দেখে।
আমাদের সামনে যখন কোনো বড় দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা বা অঘটনের খবর আসে, তখন সেটা নিয়ে কিছুদিন আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। আরেকটি বড় ঘটনা এসে ঢেকে দেয় পুরনোটাকে। এভাবে ইস্যু দিয়ে ইস্যু ঢেকে দেওয়া হয়। আমরা ইস্যুর পেছনে দৌড়াতে থাকি। ঘটনার মূলে যেতে চাই না। সিস্টেমের গোড়ায় হাত দিতে মানা। কখনো লোকদেখানো টোটকা ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এই টোটকা ব্যবস্থা বা ব্যক্তির পরিবর্তন যে কোনো স্থায়ী সুফল বয়ে আনে না সে বিষয়ে কি আর কোনো সন্দেহ আছে?