কিছুই তো দিলো না সরকার, এভাবে আর চলে না সংসার
বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে বিপাকে পড়েছে মুচি সম্প্রদায়। করোনায় করুণ অবস্থা তাদের সংসারে। একবেলা খেলে আরেক বেলা না খেয়ে দিন কাটছে তাদের। রাস্তার পাশে বসে রোদ-বৃষ্টি, ধুলোবালির মধ্যে জুতো সেলাই করে মানুষকে সেবা দেন মুচি ভাইয়েরা। করোনাকালে তাদের খোঁজ রাখেনি কেউ। ধারদেনা করে সংসারের হাল ধরে রাখলেও স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের সাধারণ রোগের চিকিৎসার পয়সাও জুটাতে পারছে না। বাড়ি ভাড়ার চাপ তো মাথার ওপরে রয়েছেই। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ভাসমান মুচিদের সঙ্গে কথা বলে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে।
গোপীবাগ থেকে বিজয়নগর এসে জুতো সেলাইয়ের সরঞ্জাম নিয়ে বসে বসে অলস সময় পার করছেন রবি দাস। অন্যের পায়ে জুতো সেলাই করে পেটে ভাত জুটে তার। পারিবারিক কর্ম হিসেবে জুতো সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালান। করোনাকালে আয় রোজগার কেমন জানতে চাইলে রবি দাস বলেন, ‘বলার মত কিছু নেই। সারাদিনে ১০০ টাকার কাজও জুটছে না। কাস্টমার নেই। বাজারের টাকাও তুলতে পারছি না। খুব কষ্ট করে সংসার চলছে। তার ওপরে ৫ মাসের বাসা ভাড়া বাকি। বাড়িওয়ালা প্রতিদিনই ভাড়ার জন্য দুর্ব্যবহার করছে।’
দয়াগঞ্জে দুটি দোকানের মাঝে সামান্য ফাঁকা জায়গায় জুতো সেলাইয়ের সরঞ্জাম নিয়ে বসেন স্বপন দাস। করোনার কারণে সব কিছু যখন বন্ধ ছিলো তখন বাড়িতে ছিলেন। প্রায় ৪ মাস পর বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরেন তিনি। স্বপনের সংসারে মা-বাবা, স্ত্রীসহ ২ মেয়ে রয়েছে। আয়-রোজগারের দুর্দশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো দিন ১০০ আবার কোনো দিন ১৫০ টাকা, এমন দিনও আছে শূন্য হাতে ফিরতে হয়। আবার বৃষ্টির দিন দোকান বন্ধও রাখতে হয়। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কিছুই দেয়নি। এভাবে আর সংসার চলে না…।’
সূত্রাপুর থানাধীন ঢালপট্টিতে জুতো সেলাই করে সংসার চালান চন্দন দাস। করোনার সময় ভয়াবহ কষ্টে কাটছে তার দিন। স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে তার সংসার। চন্দন দাস জানান, ‘করোনাকালে কাস্টমারের আগমনের সংখ্যা কমে যাওয়ায়, আয় রোজগারের পথ বন্ধ। এ অবস্থায় অনেকটা কর্মহীন হয়ে পড়েছি। পরিবার পরিজন নিয়ে কোনমতে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। বড় মেয়ে অসুস্থ, চিকিৎসা করাবো পয়সা নেই হাতে। একবেলা খেলে আরেক বেলা না খেয়ে থাকার মধ্য দিয়ে দিন যাচ্ছে। এই সময় কোনো দিন ৪০ টাকা আবার কোনো দিন ৮০ টাকার কাজ হচ্ছে। এতে তো আর সংসার চলে না।’
৭০ বছরের বৃদ্ধ কালু রবি দাস। জুতো সেলাইয়ের সরঞ্জাম নিয়ে বসে আছেন রাজধানীর পাটুয়াটুলীতে। যৌবনে পূর্বপুরুষের কাজ হিসেবে জুতো সেলাইকেই কর্ম বেছে নেন তিনি। পাটুয়াটুলীতে বসেই কাটিয়েছেন জীবনের সবটা বসন্ত। জুতো সেলাই করে ভাগ্য ফেরাতে পারনেনি তিনি। স্বামী পরিত্যক্ত এক মেয়ে, স্ত্রী, ৭ বছরের এক বাকপ্রতিবন্ধী নাতনি রয়েছে সংসারে। এক ছেলে বকুল রবি দাস। ছেলের আলাদা সংসার। সেও গুলিস্তান সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের পাশের রাস্তায় জুতো সেলাই করে।
কালু রবি দাস বলেন, ‘পৃথিবীতে এমন অভিশাপ নেমে আসবে কখনও ভাবিনি। করোনার সময় যখন সবকিছু বন্ধ ছিলো তখন বাসার পাশে মুদি দোকানি ছিলো ভরসা। বাকি খেয়ে খেয়ে দেনা বাড়িয়েছেন অনেক। টাকা পরিশোধ করতে না পারায় দোকানির ধমকও হজম করতে হয়। সরকারি কোনও ত্রাণ সহায়তা পাইনি আমরা। সরকারের কাছ থেকে কখনও আমরা কিছু পাই না।’
কাঠেরপুলের কসমোপলিটান স্কুলের পাশে জুতো সেলাই সরঞ্জাম নিয়ে বসা ৩০ বছরের স্বপন রবিদাসও শোনালেন কষ্টের কাহিনি। করোনা আসার আগে তার আয় রোজগার ভালো ছিলো। করোনাকালে নিজের খাবারের পয়সা জোগাতেই কষ্ট হচ্ছে। তার ওপরে বউ-বাচ্চা তো রয়েছেই।
সঞ্জয় দাসের বয়স পয়তাল্লিশের মতো। একরামপুর স্কুলের পশ্চিম দিকে বসেন তিনি। কষ্টের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের খেয়াল রাখার মতো কোনও লোক নেই। আমাদের খবর কেউ রাখে না। আমরা মুচি, জুতো সেলাই করে খাই। বাপ-দাদার কর্ম হিসেবে আমি এই কাজ শুরু করেছিলাম। আমি চাই না আমার সন্তান এই কাজে আসুক। কষ্ট হলেও সন্তানকে লেখাপড়া করাচ্ছি। যাতে সে অন্য কাজ করতে পারে। দেশে আমাদের জন্য কোনও কোটা বরাদ্দ নেই।’