সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প : ব্যয় বাড়ছে ৩১১৭ কোটি টাকা
বিদেশী ঋণনির্ভরতার কারণেই অনেক প্রকল্প থমকে গেছে। উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে টানাপড়েনের কারণে গুরুত্বপূর্ণ সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্পটির কাজ পাঁচ বছরেও শুরু হয়নি। পুরো ৫টি বছরই মাটি হলো। যে প্রকল্পটি পাঁচ বছরে শুরুই করা গেল না, অনুমোদিত মেয়াদে যার অগ্রগতি মাত্র ৫ শতাংশ সেই প্রকল্পটির ব্যয় এখন এক লাফে ৩ হাজার ১১৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের অগ্রগতিই নেই, অথচ পরামর্শক খাতে খরচ বাড়ছে ২১২ কোটি টাকা। এখন ঋণদাতাদের পরামর্শেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকা ওয়াসার প্রস্তাবনার তথ্যানুযায়ী দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার উৎপাদনক্ষমতা সম্পন্ন সার্ফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের নির্ভরতা কমানো, ফেজ-১ ও ফেজ-২ এর মাধ্যমে স্থাপিত প্ল্যান্ট-১ ও প্ল্যান্ট-২সহ প্রস্তাবিত প্ল্যান্ট-৩ এর জন্য স্লাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন, বিদ্যমান প্ল্যান্ট-১ ও প্ল্যান্ট-২ এ ৪৫ কোটি লিটার দৈনিক এবং প্রস্তাবিত প্ল্যান্ট-৩ এ ৪৫ কোটি লিটার দৈনিক অর্থাৎ ৯০ কোটি লিটার দৈনিক অপরিশোধিত পানি সরবরাহের জন্য টুইন র’ওয়াটার ট্রান্সমিশন লাইনসহ ইনটেক পাম্পিং স্টেশন নির্মাণ করা এই প্রকল্পের কাজ।
প্রকল্পের পটভূমি : পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে ঢাকা ওয়াসা মূলত ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে প্রতি বছর পানির স্তর ২ থেকে ৩ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে; যা শুধু পরিবেশের জন্যই হুমকি নয়, বরং ভবিষ্যতে খাবার পানি সরবরাহের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এই বিবেচনায় ঢাকা ওয়াসা ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
বর্তমানে ঢাকা শহরে সরবরাহকৃত ভূ-গর্ভস্থ এবং ভূ-উপরিস্থ পানির অনুপাত ৭৮:২২। ঢাকা ওয়াসার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ঢাকা সিটির জন্য পানির মাস্টার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী ২০৩৫ সালের মধ্যে ভূ-গর্ভস্থ ও ভু-উপরিস্থ পানির অনুপাত ৩০:৭০ এ উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। প্রকল্পটি চার হাজার ৫৭৯ কোটি ৩৬ লাখ ৫ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়। তাতে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে ঋণ নেয়া হবে ৩ হাজার ৫৩ কোটি ৫৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা। যা ডানিডা, এএফডি, কেএফডব্লিউ ও ইআইবি থেকে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ঋণদাতাদের সাথে টানাপড়েনের কারণে প্রকল্প খরচ ৬৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৭ হাজার ৭১৪ কোটি ৩ লাখ ৯৩ হাজার টাকায় উন্নীত হলো।
প্রকল্পের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, ডিজাইন ও সুপারভিশনের জন্য পরামর্শক সেবা, ৪৫ কোটি লিটার দৈনিক ক্ষমতাসম্পন্ন সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণ, ইনটেক র’ওয়াটার পাম্পিং স্টেশন নির্মাণ, ৩টি ফেজের জন্য কর্দমা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন, ৫২ দশমিক ৮ কিলোমিটার ট্রান্সমিশন লাইন, প্রায় ৫৪ কিলোমিটার সরবরাহ লাইন স্থাপন, যানবাহন ও কম্পিউটার কেনা।
সংশোধনের কারণ : প্রকল্পটি ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাঠপর্যায়ের কাজই শুরু করা সম্ভব হয়নি। কারণ, প্রকল্প সাহায্যের মধ্যে এএফডি কর্র্তৃক সাড়ে ১১ কোটি ইউরো সমতুল্য ১২ কোটি ৯৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার ও ইআইবি ৮ কোটি ৫৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পাশাপাশি ডানিডাও ২০ কোটি ডরার প্রদানের আশ্বাস দেয়। তবে ডানিডা ঋণ শুধুমাত্র প্রকল্পে পানি শোধনাগার ও স্লাজ শোধনাগার বাস্তবায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। আর এএফডি ও ইআইবি অংশের ঋণ দিয়ে প্রকল্পের ইনটেক টুইন র’ওয়াটার টান্সমিশন লাইন ও পরিশোধিত পানি বিতরণ লাইন বাস্তবায়নের বিষয়টি ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ঋণদাতা তিনটি সংস্থার মধ্যে একটি সভা হয় প্যারিসে। সেখানে অর্থায়ন নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। তারা সবাই এই প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করে। এ দিকে, ডানিডার প্রতিশ্রুত ঋণ প্রস্তাবটি বাধা পাওয়াতে ডিপিপি অনুমোদনের পর ইআইবির পক্ষ থেকে প্রকল্পে অর্থায়নে অপারগতা প্রকাশ করে। পরে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইআইবি তাদের অভ্যন্তরীণ কারণে প্রকল্পে অর্থায়ন ৭ কোটি ৬০ লাখ ইউরো থেকে কমিয়ে ৪ কোটি ইউরোর বেশি অর্থায়ন সম্ভব হবে না বলে জানায়। আর এপ্রিল মাসে মিশন বাতিল করে ইআইবি।
পরে সরকার নতুন করে উন্নয়ন সহযোগী খোঁজার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) অনুরোধ জানায়। দীর্ঘ আলোচনার পর কেএফডব্লিউ ৯ কোটি ইউরো ঋণ দিতে সম্মত হয়। তারা ২০১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ইনটেক সাইট পরিদর্শন করে। প্রকল্পের এলাকায় মেঘনা নদীর পাড়ে আমান ইকোনমিক জোনসহ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কল-কারখানার দূষিত বর্জ্যরে কারণে নদীদূষণ ইস্যুতে ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর চার রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বরাবর পত্র লিখেন। এতে করে এক সময় ঋণচুক্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পরে মেঘনা নদী দূষণমুক্ত রাখা হবে বলে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। এরপর ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে বিভিন্ন সময়ে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আর ২০১৯ সালের ৩ অক্টোবর ডানিডার সাথে আর্থিক সম্মতিসম্পন্ন হয়। ২০১৩ সালের রেট শিডিউলের ভিত্তিতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় প্রকল্পে। এখন ২০২০ সালে নতুন রেট শিডিউল হওয়াতে নতুন করে প্রাক্কলন করতে হচ্ছে।
ঢাকা ওয়াসা বলছে, ঢাকা শহরের চার পাশের নদী যেমন বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগে পানির দূষণমাত্রা অনেক বেশি। যার কারণে সেসব নদীর পানি পরিশোধনের অযোগ্য। তাই মেঘনা নদী থেকে পানি নিয়ে আসা ছাড়া এখন অন্য কোনো বিকল্প নেই। উন্নয়ন সহযোগীদের নিয়োগকৃত পরামর্শকদের সুপারিশের কারণে ১০ কিলোমিটার পানির লাইনের এলাইনমেন্টসহ বেশ কিছু কাজ নতুন করে যুক্ত হয়েছে। তারা বলছে, প্রকল্পের আওতায় পরামর্শক ও ঠিকাদার নিয়োগের জন্য কমপক্ষে দেড় থকে ২ বছর সময় লাগবে। এ ছাড়া নির্মাণকাজের জন্য সাড়ে তিন বছরের মতো সময় প্রয়োজন হবে। তাই মেয়াদ ৫ বছর বাড়ানোর জন্য বলা হয়েছে।
প্রস্তাবিত ব্যয় পর্যালোচনায় পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের উইং বলছে, ডিজাইন ও নির্মাণকাজ সুপারভিশনের জন্য পরামর্শক খাতে খরচ ২১২ কোটি ৩১ লাখ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। যেখানে প্রকল্পের মূল কাজ এখনো শুরুই হয়নি সেখানে এই খাতে এত ব্যয়? বিদেশী ঋণে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে সেগুলো অনুমোদনের আগেই তাদের সাথে ঋণচুক্তি সম্পন্ন করা হলে এই ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হতে হতো না। আগামীতে এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই প্রকল্প প্রস্তাব প্রেরণ করা উচিত।