করোনা নিয়ে যতো প্রতারণা
করোনা মহামারিকে ঘিরেও সক্রিয় নানা প্রতারক চক্র। করোনা পরীক্ষা, চিকিৎসা, প্লাজমা দান, করোনা চিকিৎসক, ওষুধ, রোগী সেজে প্রতারণা করে আসছে এসব চক্র। এর বাইরে নকল সুরক্ষা সামগ্রী, স্যানিটাইজার, মাস্ক নিয়েও আরেক শ্রেণির চক্র প্রতারণা করছে। সাধারণ রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে প্রতারণা করে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ। প্রতারক চক্রের কাছে টাকা খুঁইয়ে হয়রানি আর ভোগান্তির শিকার হয়েছেন অনেকেই। সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জালে ধরা পড়েছে এ ধরনের চক্রের অনেক সদস্য।
করোনা পরীক্ষায় প্রতারণা: সোমবার করোনা ডেডিকেটেড রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায় এলিট ফোর্স র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে করোনা নিয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের নানা প্রতারণার বিষয় উঠে এসেছে।
হাসপাতালটি দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা না করেই রোগীদের রিপোর্ট প্রদান, রোগীদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করে আসছিল। বিল করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেও অর্থ হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করছিলো হাসপাতালটি। র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রতিষ্ঠানটির দু’টি শাখা থেকে সাতজনকে আটক করে এবং অসংখ্য ভুয়া রিপোর্টের কাগজ, বিলসহ নানা অনুষঙ্গ জব্দ করা হয়েছে। গতকাল হাসপাতালটির দুটি শাখা সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। এদিকে করোনা পরীক্ষা নিয়ে ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণা করেছে এমন এক দম্পতিকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপি’র তেজগাঁও ডিভিশন। তারা হলেন- হুমায়ুন কবির। এই দম্পতির নেই কোনো নমুনা সংগ্রহের বৈধ অনুমতি। স্যাম্পল পরীক্ষার ল্যাবও ছিল না। শুধুমাত্র একটি কম্পিউটারকে পুঁজি করে অনলাইনে দুটি সাইট খুলে করোনা রোগীদের টার্গেট করতেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে কোথাও ফেলে দিতেন সেই নমুনা। পরে বাসায় এসে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আদলে হুবহু করোনার সার্টিফিকেট তৈরি করে ইচ্ছামতো পজেটিভ নেগেটিভ রেজাল্ট তৈরি করে রোগীর মেইলে পাঠিয়ে দিতেন। বিনিময়ে তারা রোগীর কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিতেন। প্রতারণার শিকার হয়ে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে ডিএমপি’র তেজগাঁও ডিভিশন তদন্ত করে এর সত্যতা পায়।
প্লাজমা সহায়তা প্রতারণা: প্রায় দুই লাখ সদস্যের ফেসবুক গ্রুপ ‘বাংলাদেশ প্লাজমা ব্যাংক’। গ্রুপটিতে প্লাজমা সাহায্যপ্রার্থী ও দাতারাই মূলত সদস্য। এই গ্রুপে প্লাজমা সহায়তা চেয়ে বেশকিছু সদস্য প্রতারিত হয়েছেন। গ্রুপ এডমিন এমন ২২টি মোবাইল নম্বর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দেন। তদন্ত করতে গিয়ে প্লাজমা দানের কথা বলে অর্থ হাতিয়ে নেয়া চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি)। ডিবি জানিয়েছে, প্লাজমা প্রতারণা চক্রের সদস্যরা প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে করোনা রোগীর জন্য প্লাজমার সন্ধান করা ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করে। তারপর তারা নিজেদেরকে করোনা মুক্ত দাবি করে প্লাজমা দানের প্রস্তাব করে। পরে প্লাজমা সাহায্যপ্রার্থীদের কাছে তারা যাতায়াত খরচ, খাবার দাবারের জন্য অর্থ দাবি করে। অর্থ নেয়ার জন্য তারা একটি বিকাশ নম্বর দেয়। সাহায্য প্রার্থীরা অর্থ পাঠানোর পর প্রতারক চক্রের সদস্যরা মোবাইল নম্বর বন্ধ করে দেয় অথবা সাহায্যপ্রার্থীর মোবাইল নম্বর ব্লক করে দেয়। ডিবি জানিয়েছে, প্লাজমার নামে প্রতারণা করে এমন অন্তত ছয়টি চক্রকে তারা শনাক্ত করেছেন। এসব চক্র অসহায় রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে যাদের দুর্লভ নেগেটিভ রক্ত। যারা কোথাও প্লাজমা দাতা খুঁজে না পেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন এমন রোগীদের টার্গেট করে। প্রতারকরা প্রথমে সাহায্যপ্রার্থীর কাছে জানতে চায় তাদের অবস্থান কোথায়। অবস্থান জানার পর প্রতারকরা তাদের অবস্থান আরো দূরে কোথাও জানায়। সেখান থেকে আসা-যাওয়ার খরচ, খাবারের টাকা বাবদ সাহায্যপ্রার্থীর কাছে টাকা দাবি করে। এভাবে পার্টির অবস্থা বুঝে ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে।
করোনা আক্রান্ত মা ফারজানা ইয়াসমিনের জন্য প্লাজমা সহায়তা চেয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন রুশনাল শাহ আদিব। মাকে বাঁচানোর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মতে শেষ ভরসাই ছিল প্লাজমা। পরিচিত কারো কাছেই প্লাজমা সহায়তা না পেয়ে তিনি বি নেগেটিভ প্লাজমা চেয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। এরপরই প্রতারক চক্রের সদস্য আদিবের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। এক প্রতারক তাকে প্লাজমা দেয়ার নিশ্চয়তাও দেয়। তাই আদিব ওই প্রতারককে টাকা দেন। কিন্তু ওই প্রতারক টাকা নেয়ার পর মোবাইল বন্ধ করে রেখে দেয়। বার বার কল করে আদিব তার ফোন সুইচ অফ পায়। এদিকে বাবার জন্য প্লাজমা চেয়ে খোদ এক চিকিৎসকও প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তিনি হলেন- নাফিসা তাবাসসুম। প্লাজমা চেয়ে তিনিও ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। তখন প্রতারকরা সেই পোস্ট দেখে টাকা পাঠানোর কথা বলে। টাকা পাঠানোর পর আর সেই প্রতারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
কার্ড প্রতারণা: একটি বিশেষ কার্ড ‘ভাইরাস শাট আউট’ গলায় ঝুলিয়ে রাখলে এক মাস করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকা যাবে বলে প্রতারণা করে আসছিলো একটি চক্র। ঢাকা জেলা প্রশাসন ও ওষুধ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে এমন বেশকিছু কার্ড উদ্ধার করেছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। পরে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট মাহনাজ হোসেন জানান, কার্ড ঘাড়ে থাকলে এক মাস করোনামুক্ত থাকা যাবে- এমন বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্ষতিকর চিকিৎসা সামগ্রী বিক্রি করা হচ্ছিল। এটা এক ধরনের প্রতারণা। তিন জানান, প্রতিটি ভাইরাস শাট আউট কার্ড ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি করতো তারা। অথচ এই কার্ড করোনা প্রতিরোধে সক্ষম নয় উল্টো মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। কার্ডে এক ধরনের কেমিক্যাল উপাদান ক্লোরাইন ডাই অক্সাইড থাকে। ম্যাজিস্ট্রেট মাহনাজ হোসেন আরো বলেন, এটি আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। একইভাবে ঢাকার উত্তরা থেকে আরো বেশকিছু ভাইরাস শাট আউট কার্ড জব্দ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অকার্যকর কার্ড কিনে এমন শত শত মানুষ প্রতারণার শিকার হয়েছেন। করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত হওয়ার আশায় অনেকেই কার্ড কিনেছেন কিন্তু সেটি তাদের কোনো কাজে আসেনি।
প্রণোদনা পেতে রোগী সেজে প্রতারণা: এদিকে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা পাওয়ার জন্য মিথ্যা করোনা রোগী সেজে কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতারণা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি প্রণোদনা পাবার জন্য করোনা রোগীর জাল সনদ নিয়ে ধরা পড়েছেন রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালের কর্মচারী কুতুবে রাব্বানী। তিনি করোনা আক্রান্ত হয়েছেন বলে তার অফিসকে জানান। সে অনুযায়ী কাগজপত্র ঠিক করে ছুটিতে যান। কিন্তু জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) তদন্ত করে জানতে পারে তিনি করোনা আক্রান্ত হননি। পজেটিভের নকল সনদ জাল তৈরি করে নিজেই মুগদা জেনারেল হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ডা. মৌসুমি সরকারের স্বাক্ষর জাল করেন। এ নিয়ে মুগদা থানায় তার বিরুদ্ধে একটি প্রতারণার মামলা হয়। বর্তমানে তিনি জেলহাজতে আছেন।
এদিকে এসব প্রতারণার বাইরে দেশে করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই নকল সুরক্ষা সামগ্রী, হ্যান্ডস গ্লাভস, স্যানিটাইজার তৈরি করে এক শ্রেণির প্রতারকরা প্রতারণা করে আসছে। এ ছাড়া করোনা রোগের টিকা ও ওষুধের কথা বলেও কেউ কেউ প্রতারণা করে আসছে।