২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পাস বিএনপির পরবর্তী প্রতিক্রিয়া

0

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

তারিখঃ ০২ জুলাই, ২০২০

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল – বিএনপি’র সংবাদ সম্মেলন

প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,

আসসালামু আলাইকুম।

সংসদে গত ৩০ শে জুন, ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকার একটি অপরিণামদর্শী ও বাস্তবতাবিবর্জিত গতানুগতিক বাজেট পাশ হয়েছে। যাকে অর্থনীতিবিদরা স্বপ্নবিলাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। করোনার কারণে সংক্ষিপ্ত করার খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে এবারের বাজেট বরাদ্দ নিয়ে প্রত্যাশিত দীর্ঘ আলোচনা ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের কোন সুযোগ দেয়া হয়নি। ১৫ ই জুন অনির্ধারিতভাবে ২৩ শে জুন বর্তমান অধিবেশন মুলতবী করে মাত্র একদিন (২৩ জুন) বাজেটের সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে যা অকল্পনীয়। অথচ ভার্চুয়াল অধিবেশন চালিয়ে হলেও বাজেট আলোচনা দীর্ঘায়িত করে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করা যেত। বাজেটের সমালোচনা এড়াতেই অধিবেশন সংক্ষিপ্ত করে তড়িঘড়ি করে বাজেট পাশ করেছে সরকার।

এই সরকার বাংলাদেশকে একটি লুটেরা আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চলেছে। এ বাজেটে লুটপাটকারী, ধনিকশ্রেণি ও আমলাতন্ত্র-নির্ভর অর্থনৈতিক দর্শনের আলোকে প্রস্তুত হয়েছে এবং তাদেরই স্বার্থরক্ষা করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা নানা রকমভাবে সরকারকে পথ দেখাতে চেষ্টা করেছেন। জাতির এই সংকটে বিএনপি তার ওপর সরকারের নানামুখী অত্যাচারের কথা ভুলে করোনা সংকট মোকাবেলায় যেমন ৮৭ হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ প্রস্তাবনা দিয়েছিল, একি ভাবে এবারের বাজেট কেমন হওয়া উচিৎ সে বিষয়ে গত ৯ জুন আমরা সুনির্দিষ্ট পুনরুদ্ধার পরিকল্পণা সমৃদ্ধ তিন বছরের একটি মধ্য মেয়াদী বাজেট রূপরেখা দিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার আমাদের সুপারিশ ও অর্থনীতিবিদদের মতামত উপেক্ষা করে একটি গতানুগতিক অবাস্তব বাজেট পাশ করলো।

২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের চিত্র হচ্ছে, ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অনুদান ব্যতীত ঘাটতি ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি জিডিপির ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এই ঘাটতি ৫ শতাংশ। সংখ্যানির্ভর মোহাবিষ্ট এই বিরাট বাজেটের ৬৬ শতাংশ আসবে রাজস্ব আয় থেকে৷ যা একেবারেই অসম্ভব। অবশ্য বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘টাকা কোথা থেকে আসবে সে চিন্তা আমরা করিনি৷’’ তিনি বলেছেন আগে টাকা খরচ করি তারপর দেখা যাবে। তাই এবারের বাজেট ধুম্রজাল সৃস্টির তামাশার বাজেট ছাড়া আর কিছুই নয়।

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, খসড়া বাজেট পেশের পর গত ১২ জুন আমরা বিএনপি’র পক্ষে বাজেট প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলাম। সে সময়ে আমরা বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছি এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত কর আরোপের বিষয়ে আমাদের অভিমত জানিয়েছিলাম। কিন্তু অর্থমন্ত্রী পাশকৃত বাজেটে সাধারণ জনগণের আশা আকাংখা, চাওয়া-পাওয়া এবং আমাদের সুপারিশের কোন মূল্যায়ন করেনি। সরকারের বিগত বাজেটগুলোর মত এ বাজেটেও লুটেরা সরকারের ধনিকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে। যেমন-

Ø কালো টাকার মালিকদের কথায়ই শুনলেন অর্থমন্ত্রী। কালো টাকার মালিকদের টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হন এমন সমালোচনা থাকলেও তা তোয়াক্কা করেনি সরকার। খসড়া বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছিল কালো টাকার মালিকেরা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করলে ঐ টাকা ৩ বছর বাজারে ধরে রাখতে (Lock in) হবে। অর্থবিল পাশের দিন এ সুযোগ কালো টাকার মালিকদের পক্ষে আরেকটু ঢেলে দেওয়া হল। এটা কমিয়ে এখন করা হয়েছে ১ বছর। সকলেই বিশ্বাস করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সরকারের সুবিধাভোগী দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের টাকা সাদা করে তা পুনরায় বিদেশে পাচারের সুযোগ করে দেয়ার জন্য। তাছাড়া এ বাজেটে কোন প্রশ্ন ছাড়াই ফ্ল্যাট ও এপার্টমেন্ট কেনা, দালান নির্মাণ এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে যে কেউ কালো টাকা সাদা করতে পারবে এবং এ জন্য কোন জরিমানা গুনতে হবেনা। সবচেয়ে বড়কথা NBR বা সরকারের অন্যকোন কর্তৃপক্ষ এই টাকার উৎস নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলতে পারবেনা। অথচ একজন সৎ করদাতাকে ৩০% পর্যন্ত কর দিতে হবে। এ বাজেট মানুষকে অসৎ হবার প্ররোচনা দেবার বাজেট।

Ø এ বাজেটে মোবাইল সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনা হলেও তা পরিবর্তন করা হয়নি। অর্থাৎ মোবাইল ফোনে কথা বলা, মেসেজ পাঠানোসহ অন্যান্য সেবায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ১ শতাংশ সারচার্জ, ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ বহাল থাকছে। এতে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সরকারের পকেটে যাবে ২৫ টাকা। এ দেশের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষও যে মোবাইল ফোনে কথা বলে তার কর বাড়ানো হলো, কিন্ত শুল্ক কমানো হয়েছে ধনিকশ্রেনীর ব্যবহার্য স্বর্ণালংকারের।

Ø প্রস্তাবিত বাজেটে জিরো কুপন বন্ডের বিদ্যমান কর সুবিধা প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাজেট পাসের সময় তা আবারও আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

Ø এ বাজেটের মাধ্যমে উপকরণ কর রেয়াতের শর্ত বাতিল করা হয়েছে। অর্থাৎ আগের নিয়মেই শিল্প মালিক ও উদ্যোক্তারা উপকরণ কর রেয়াত নিতে পারবেন। প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছিল, আমদানির চার মাসের মধ্যে উপকরণ ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করতে না পারলে রেয়াত বাতিল করা হবে।

Ø এ বাজেটে কৃষি ও কৃষক উপেক্ষিত থেকে গেছেন। অথচ এ করোনায় দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে এই কৃষি ও কৃষক। শুধু ভাতের সংস্থান করা নয়, সবজি, মাছ, ডিম, মুরগি, দুধ, মাংস ও ফল কোনো কিছুরই অভাব বোধ করতে দেয়নি যে খাত, গত বাজেটেও তার জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ধান উৎপাদন খরচের চেয়ে বিক্রয় মূল্য কম হওয়ায় ক্ষোভে-দুঃখে কৃষক কর্তৃক তার ফসলের মাঠে আগুন ধরিয়ে দেয়া, পাটের মূল্য না পেয়ে গলায় পাট পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করা, বিক্রয়যোগ্য সবজি জমিতেই নষ্ট করে ফেলা, মৌসুমি ফল নিয়ে পরিবহনসহ নানা জটিলতায় উৎপাদকদের বিড়ম্বনা, পোলট্রি খামারির দুর্ভোগ, দুগ্ধ চাষী বিপাকে; বছরজুড়ে এসব ছিল পত্রিকার নিয়মিত হেডলাইন।

Ø গত ৪ জুন, ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা যায় পোল্ট্রির দাম কমেছে প্রায় ৪৪ শতাংশ, দুধের দাম কমেছে ২২ শতাংশ। সবজির ৩৮-৯০ শতাংশ দাম কমেছে। ৬৬ শতাংশ কৃষক জানিয়েছেন তাদের কম দামে পণ্য বিক্রি করতে হয়েছে। কৃষকরা জানিয়েছেন, বাজার বন্ধ থাকায় আড়তদার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি। ৫২ শতাংশ কৃষক জানিয়েছেন পণ্য বিক্রির জন্য মার্কেটে পৌঁছাতে পারেননি। ফলে তারা যতটুকু দাম পেয়েছেন, সেই দামে পণ্য ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এই সংকটের সময়ে ৯৫ শতাংশ কৃষকই সরকারি অথবা বেসরকারিভাবে কোনো ধরনের সহায়তা পাননি। এই পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত বাজেটেও কৃষকের জন্য কোনো সুখবর নেই। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে দেশের কৃষি খাতের জন্য ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে মাত্র ৫০০ কোটি টাকা বেশি। আমরা দাবি করেছিলাম কৃষি ও খাদ্য খাতে চলতি অর্থবছরের জিডিপি ও বাজেটের যথাক্রমে ০.৯৭ এবং ৫.৪ শতাংশের পরিবর্তে কমপক্ষে ১.৫ এবং ৫.৭৯ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে।

Ø এমনিতেই ব্যাংকে আমানত কমে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী প্রস্তাব করেছেন, ব্যাংকে ১০ লক্ষ টাকার উপরে রাখলেই ৩,০০০ টাকা কর দিতে হবে। এক কোটি টাকার উপরে থাকলে ১৫,০০০ টাকা ট্যাক্স দিতে হবে। এতে আমানত ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ আমানত কারীরা নিরুৎসাহিত হবে।

Ø এই বাজেটে ব্যাংক খাতের ক্যান্সার হয়ে পড়া খেলাপি ঋণ কমানোর কোন পদক্ষেপ নেই, বরং ২% ডাউন পেমেন্ট দিয়ে বিরাট ঋণখেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিল করার পদক্ষেপকে কৃতিত্ব হিসাবে দাবি করা হয়েছে। অথচ এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ওই সব খেলাপিদের আবার নতুন ঋণ নেবার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে যেটা আবারও খেলাপি হবে। ব্যাংক খাত সংস্কার এবং ব্যাংক কমিশন গঠনের কিছুই বলা হয়নি এ বাজেটে।

Ø বাজেটে প্রস্তাবিত ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেসরকারি বিনিয়োগ অর্জন করতে হলে অতিরিক্ত ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। ব্যাংক খাত থেকে সরকারের গৃহীত ঋণ ইতিমধ্যে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। গত অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে আগের বছরের তুলনায় ১৩৮ শতাংশ বেশি ঋণ নিয়েছে। ফলে অর্থসংস্থানের পরিসর (ফিসক্যাল স্পেস) সংকুচিত হবে; ফলে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি ইত্যাদি খাতে প্রস্তাবিত যৎসামান্য বরাদ্দ সংস্থান করাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

Ø এই বাজেটে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার কথা নেই। অথচ এক ওয়াট বিদ্যুৎ না কিনে গত ১০ বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ দেয়া হয়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকা। অথচ করোনার এই চরম সংকটের সময় হাজার হাজার শ্রমিককে বেকার করে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করে দিতে যাচ্ছে সরকার ভর্তুকি দিতে হয়, এই অজুহাতে।.

এই বাজেটে তেলের দাম তলানিতে পড়ে গেলেও তেলের দাম কমানো হয়নি,আয়করের নতুন নিয়মের ক্ষেত্রে কম আয়ের মানুষের কর যেখানে কমবে ৫ হাজার টাকা সেখানে একজন ধনীর কমবে আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত, এই বাজেটে মোট রাজস্বে আয়করের হিস্যা বাড়েনি বরং ১ শতাংশ কমেছে,করোনার কারণে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে আসা নিশ্চিত হওয়া প্রায় ১৫ লক্ষ কর্মীর ভবিষ্যতের জন্য রাখা হয়েছে অতি তুচ্ছ বরাদ্দ, বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য নেই কোন উল্লেখযোগ্য কর্মসূচী, করোনা সংকটের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতের একটা পর্যটন খাত নিয়ে দেয়া হয়নি একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও।.

সরকার তার তথাকথিত মেগা প্রকল্পগুলোতে এবারও বরাদ্দ কমায়নি। মেগা লুটপাটের এই লোভ করোনাকালীন সময়ে মাত্র এক বছরের জন্য সম্বরণ করতে পারেনি সরকার। অথচ করোনার এই ক্রান্তিকালীন সময়ে একটা কল্যাণমুখী সরকার থাকলে তারা অবকাঠামোর যে প্রকল্পগুলো ছিল সেগুলো অনেকটা ধীরগতিতে নিয়ে বরাদ্দ অনেক কমিয়ে দিত উল্লেখযোগ্যভাবে। সেই টাকা করোনা মোকাবেলায় সবচেয়ে জরুরি ক্ষেত্রগুলোতে ব্যয় করতো। এছাড়াও আরও কী কী পদক্ষেপ নিলে সরকার এই সঙ্কটকালীন সময়ে বাড়তি আয় করতে পারতো, সেটার স্পষ্ট রোড-ম্যাপ আছে আমাদের বাজেট প্রস্তাবনায়।·

২০২০-২১ অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বাজেট ধরা হয়েছে ৩,৮৩৯ কোটি টাকা। অথচ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বিএনপি সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বাজেট ছিল মাত্র ৪০২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিএনপি সরকারের শেষ অর্থবছরের তুলনায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে খরচ বেড়েছে সাড়ে নয় গুণ। অর্থমন্ত্রী সরকারি ব্যয় হ্রাস করার যে ঘোষণা বাস্তবায়ন করছে এটি তার একটি ক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত মাত্র।·

সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’ এক গবেষণায় দেখিয়েছে, করোনার কারণে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ কমে যাবে। বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা বা জিডিপির ২ দশমিক ৪০ শতাংশ আসবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রকৃত বাজেটের হিসাব অনুযায়ী গড়ে বৈদেশিক ঋণ এসেছে জিডিপির শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশ। এভাবে কর আদায় কমে যাওয়ায় এ বাজেট পুরো বাস্তবায়িত হতে হলে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং অতিমারি প্রলম্বিত হলে আরও বাড়বে। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা বা জিডিপির ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ থেকে অনেক বেশি ঋণ করতে হবে। এভাবে ঋণ নির্ভর বাজেট করে সরকার পুরো জাতিকে ঋণের ফাঁদে আটকে দিচ্ছে।·

প্রস্তাবিত বাজেট ঘাটতির ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা সংস্থান করতেও শেষ পর্যন্ত দায়ভার এসে পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। কেননা প্রস্তাবিত বাজেটে এনবিআরসহ সরকারের পক্ষ থেকে বিশাল অঙ্কের কালো টাকা, অপ্রদর্শিত অর্থ সম্পদ, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে বিশেষ কোনো তৎপরতা নেই।·

এমতাবস্থায় ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৮.২% নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমেই বোঝা যায় এই বাজেট স্রেফ একটা সংখ্যানির্ভর মোহাবিষ্ট ধুম্রজাল সৃষ্টিকারী বাজেট।·

খসড়া বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে গত অর্থবছরের তুলনায় ৩,৫১৫ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২৯,২৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। অথচ জাতি আশা করেছিল বিরাজমান করোনা পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যখাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। খসড়া বাজেটের পর এই খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন মহলের জোরালো সুপারিশ সত্ত্বেও সরকার এ বিষয়ে কোন কর্ণপাত করেনি। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ আগের মতই থেকে গেছে যা জিডিপির মাত্র ০.৯ শতাংশ। যা জনগণকে হতাশ করেছে।·

সরকার বলেছিল কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে “সে একজন সরকারি রোগী। ধনী গরীব নির্বিশেষে প্রত্যেককে বিনামূল্যে করোনা টেস্ট করা হচ্ছে” (দি ডেইলি স্টার- ০১-০৭-২০) । বেসরকারি ল্যাবরেটরিগুলোতে বিনামূল্যে পিসিআর পরিক্ষা করতে দেয়া হয়েছে এ শর্তে যে তারা রোগীদের কাছ থেকে কোন ফি নেবে না। অথচ সংক্রমণ যখন বৃদ্ধি পেল এমন এক মোক্ষম সময়ে এসে সরকার করোনা টেস্ট ফিস ২০০ ও ৫০০ টাকা নির্ধারণ করেছে। সরকার পরিচালনাধীন ল্যাবরেটরিতে এ জাতীয় ফি আদায় সারা বিশ্বেই বিরল। দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশই সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে করোনা পরিক্ষার জন্য কোন ফিস নেয় না। এমনকি নেপালে সরকারিভাবে পরিক্ষার ব্যয় বহন করা হচ্ছে। শুধু তাই নয় বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিটি করোনা টেস্টের জন্য নেপাল সরকারই ৫৫০০ টাকা পরিশোধ করছে। অথচ আমাদের দেশে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা টেস্ট ব্যয় জন প্রতি ৩৫০০ টাকা; বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে ৪৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়। কি অমানবিক সরকার এটি তার একটি উদাহরণ মাত্র।·

করোনার প্রেক্ষিতে লকডাউনের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় ৭৮.৩% পরিবারের উপার্জন কমেছে। অথচ সে বিবেচনায় সামাজিক সুরক্ষার যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা নিতান্তই অপ্রতুল। দিন এনে দিন খায় এ শ্রেণীর হতদরিদ্র মানুষের কাছে নগদ অর্থ পৌঁছে দেওয়ার যে গণদাবী উত্থাপিত হয়েছে সে বিষয়ে বাজেটে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। যে সামান্য ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে তাও দুর্নীতির কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ আগের তুলনায় কমেছে। পেনশন ভাতা, সঞ্চয়পত্রের সুদ ইত্যাদি বাদ দিলে এ বরাদ্দ ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৭ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়ায়। এ বরাদ্দ নতুন দারিদ্র্য পরিস্থিতি সামাল দিতে কতটুকু সক্ষম হবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবারের আয় আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে; অসমতা বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হবে। চলমান কর্মসূচিগুলো সর্বজনীন নয়; বরং কিছু নির্দিষ্ট দল, গোষ্ঠীকে লক্ষ করে গৃহীত। এভাবে মূলত রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বণ্টন করে গোষ্ঠীতন্ত্র লালন হচ্ছে।·

বাংলাদেশের ইনফরমাল খাতটি জনসংখ্যার বিরাট অংশ জুড়ে। নানা তথ্যমতে জানা যায়, শুধু ঢাকা শহরেই হকার ও ফেরিওয়ালার সংখ্যা তিন লাখের বেশি। দরজির সংখ্যা কয়েক লাখ। রিকশাচালকের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। লবণশিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন কয়েক লাখ শ্রমিক। এক লাখের বেশি জেলে ও শ্রমিক জড়িয়ে আছেন শুঁটকি শিল্পের সঙ্গে। সারা দেশে পরিবহনশ্রমিকের সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০ লাখ। ঢাকা শহরে ‘ঠিকা বুয়া’র সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখের বেশি । অথচ কোভিড–১৯এর ফলে এই শ্রমজীবী মানুষের সকলেই বেকার। বাজেটে তাদের নূন্যতম চাহিদা মেটানোর বিশেষ বরাদ্দ নাই।·

করোনার সময়ে দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘকাল যে মন্দা থাকবে তাতে মানুষের আয় এবং অভ্যন্তরীন ভোগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়ে রাজস্ব আয়ে চরম ঘাটতি তৈরি হবে। তাই বলা যায়, এই ঘাটতি গিয়ে ঠেকবে প্রায় ৪ লক্ষ কোটি টাকায়। ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকারের মূল পদক্ষেপ হবে ঋণ করা। বাজেটেই উল্লেখ করা হয়েছে ব্যাংক থেকে নেয়া হবে ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যেটা শেষ পর্যন্ত দ্বিগুনে গিয়ে দাঁড়াবে (এই অর্থবছরেও তাই হয়েছে)। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের এই অকল্পনীয় পরিমাণ টাকা ধার করার ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ একেবারে শুন্যের কোঠায় চলে আসবে যা কর্মসংস্থানের পথ একেবারেই বন্ধ করে দেবে। এতেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না, তাই সরকারকে বিপুল পরিমানের নতুন টাকা ছাপাতে হবে। এই টাকা ছাপানো উচ্চ মূল্যস্ফীতি তৈরি করে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে প্রচন্ডভাবে দুর্বল করে দেবে, যার ফল হবে মারাত্মক।

এই বাজেট করোনার সময়ে বীভৎস স্বাস্থ্য সংকটে পড়া মানুষের নাভিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দেবার বাজেট, এই বাজেট করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া কোটি কোটি অনাহারী মানুষকে দুর্ভিক্ষের মধ্যে ঠেলে দেয়ার বাজেট, এই বাজেট কৃষিকে ধ্বংস করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে ফেলার বাজেট, এই বাজেট দেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার না করে আরও গভীর মন্দায় ফেলে দেয়ার বাজেট, এই বাজেট দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে ফেলার বাজেট, এই বাজেট দেশের কর্মক্ষম বেকার মানুষকে এবং নতুন করে বেকার হওয়া মানুষকে বেকার রেখে দেয়ার বাজেট, এই বাজেট গরীব মানুষের সুবিধা কমিয়ে ধনীদের সুবিধা বাড়িয়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বৃদ্ধির বাজেট, সর্বোপরি এই বাজেট রাষ্ট্রীয় সম্পদ লূটপাটকারীদের আরও সুযোগ বৃদ্ধির বাজেট।

এ বারের বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি, এসএমই, গ্রামীণ অর্থনীতি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জীবন-জীবিকা রক্ষায় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম ব্যয় বরাদ্দের ফলে এদেশের জনগণের মাঝে সীমাহীন হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে । যদিও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের কারণে জনগণের কাছে দায়বদ্ধতাহীন একটি একদলীয় সরকারের আচরণে কাল্পনিক সাফল্যের দিবাস্বপ্ন দেখানোর অপপ্রয়াসই স্বাভাবিক। জনগণের কাছে ন্যুনতম জবাবদিহিতাহীন, আমলাচালিত, ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট সরকারের কাছে এমন বাজেটই প্রত্যাশিত। এই বাজেট আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।

আল্লাহ হাফেজ।

বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

মহাসচিব

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com