মেধাবী থেকে ওরা খুনি!
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে দোষী হিসেবে আটক হন ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ মুন্না। ১২ বছর আগে মুন্নার বাবা মারা গেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর কাছে থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। পরে ঢাকার ক্যামব্রিয়ান কলেজ থেকে পাস করে বুয়েটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পান। তিন ভাইবোনের মধ্যে মুন্নাই সবচেয়ে মেধাবী। একসময় নিজের গ্রাম চুনারুঘাটের কৃতী সন্তান মেধাবী মুন্না আজ তার সহপাঠী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত। আরবার খুনের আসামি মো. আকাশ হোসেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তার পিতা আতিকুল ইসলাম জয়পুরহাট সদরে ভ্যান চালান। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে এবং প্রতিবেশীদের সাহায্যে ছেলেকে বুয়েটে ভর্তি করান। কষ্টের জমানো টাকা মাসে মাসে আকাশকে পাঠাতেন। আতিকের অভাবের সংসারে আকাশ একসময় সংসারের হাল ধরবেনÑ এ আশায় ছিল পরিবারটি। কিন্তু বুয়েটে পড়তে এসে ছেলে যে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে তা জানতেন না আতিক। ছেলেকে রাজনীতিতে না জড়ানোর জন্য বার বার নিষেধও করেন। আবরার হত্যাকাে গ্রেফতারের ঘটনায় আতিকের পুরো পরিবার এখন দুশ্চিন্তায় পড়েছে। এসএসসি ও এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া আকাশের মেধায় মুগ্ধ এলাকাবাসী যেখানে একসময় তার সুনাম করছিল এখন সেই তারা আবরার হত্যায় আকাশের সম্পৃক্ততায় লজ্জিত।
আরেক আসামি ইফতি মোশাররফ সকাল বুয়েটের বায়ো মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সকাল বুয়েট ছাত্রলীগের উপসমাজসেবা সম্পাদক ছিলেন। তিনি নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি ও রাজবাড়ী গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। বিদ্যালয়ে পড়াকালে সকাল সব সময় মেধা তালিকায় থাকত। রাজবাড়ী শহরের ধুঞ্চি গ্রামের আটাশ কলোনি এলাকার সকাল দুই ভাইয়ের মধ্যে বড়। বাবা মোকলেছুর রহমান ও মা রাবেয়া খাতুন জানান, তাদের সন্তান খুব মেধাবী। ছোটবেলা থেকে কারও সঙ্গে তেমন একটা মিশত না। পড়ালেখার পাশাপাশি গণিত অলিম্পিয়াড ও বিতর্কে অংশ নিত সকাল।অন্য আসামি বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল। ছোটবেলা থেকেই নম্র ও মেধাবী প্রকৃতির রাসেল বুয়েটে ভর্তি হওয়ার আগে কখনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না হলেও ভালো চাকরির আশায় বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন বলে মন্তব্য তার মামাতো ভাই রনির। আসামি মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন বুয়েট ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। তিনি বুয়েটে নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। জিয়ন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার দুর্গাপুর ধলারপাড় গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছেলে। ২০১৩ সালে মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ী বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে নটর ডেমে ভর্তি হন। এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পান তিনি। জিয়নের বাবা শহিদুল ইসলাম জানান, তার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় ছেলে রংপুরের এমবিবিএস কোর্সে ইন্টার্নি করছেন আর ছোট মেয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী। তবে মেধাবী জিয়নই ছিল তার পরিবারের সবচেয়ে উচ্চাশার পাত্র। কিন্তু আবরার হত্যায় এখন পরিবারটির স্বপ্ন ভেঙে গেছে। মুহতাসিম ফুয়াদ বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও বুয়েট ছাত্রলীগের সহসভাপতি। ফুয়াদের বাবা সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোর থেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। বর্তমানে চট্টগ্রামে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তিনি। ফুয়াদের বাড়ি ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলায়। ফুয়াদের এক বড় বোন আছেন। ফুয়াদ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টেই বেড়ে ওঠেন। শান্ত প্রকৃতির ফুয়াদও বুয়েটে ভর্তির আগে কখনো ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। আবরার হত্যার ৩ নম্বর আসামি হচ্ছেন অনীক সরকার। বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অনীকের বাবা আনোয়ার হোসেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও মা শাহিদা বেগম গৃহিণী। রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার বড়ইকুড়ি গ্রামে তাদের বাড়ি। দ্ইু ভাইয়ের মধ্যে অনীক ছোট। আবরারের ওপর নৃশংসতা চালানোর ক্ষেত্রে অনীকই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন। কিন্তু ছোটবেলায় যে ছেলে সহজে কারও সঙ্গে মিশতেন না সেই ছেলেই তার সহপাঠীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন জানতে পেরে ছেলের অপরাধ প্রমাণ হলে প্রচলিত আইনেই তার শাস্তি চান বাবা-মা। অনীক পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি আর এসএসসি ও এইচএসসিতে পেয়েছেন জিপিএ-৫। আসামি অমিত সাহা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক। তার বাবা রঞ্জিত সাহা ধানের আড়তদার আর মা দেবী রানী সাহা গৃহিণী। অমিত নেত্রকোনা শহরের আখড়ামোড় এলাকার বাসিন্দা। শৈশব থেকেই মেধাবী অমিত পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছেন। জেলা শহরের আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন অমিত। তার মা-বাবা বর্তমানে ভারতে আছেন। সেখানে তারা তীর্থে গিয়েছেন। অমিতের ছোট বোন উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী।
আবরার হত্যা মামলার ৪ নম্বর আসামি মেহেদী হাসান রবিন। তার বাবা মাকসুদ আলী। গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার চৌমুহনীর কাপাসিয়ায়। ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির আবরার হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামি। দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ভাঙাড়িপাড়ার মাহতাব আলীর ছেলে মনির। তিনি পানিসম্পদ বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। মামলার ৮ নম্বর আসামি মাজেদুল ইসলাম ম্যাটারিয়াল অ্যান্ড ম্যাটারলজিক্যাল বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। মামলার ৯ নম্বর আসামি মোজাহিদুর রহমান বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সদস্য। তিনি ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। মামলার ১০ নম্বর আসামি তানভীর আহম্মেদ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। ১১তম আসামি হোসেন মোহাম্মদ তোহা।
এ হত্যা মামলার অন্য আসামিরা হলেন মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ), মো. তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৭তম ব্যাচ), মো. জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মো. শাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মো. মোর্শেদ (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মো. মোয়াজ (সিএসই ১৭ ব্যাচ)। এজাহারে নাম না থাকা চারজনও গ্রেফতার হয়েছেন। এর মধ্যে অমিত সাহা ছাড়া আরও আছেন ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ), মিজানুর রহমান (ওয়াটার রিসোর্সেস ১৬তম ব্যাচ) ও শামসুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং)। বুয়েটের সাবেক শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বুয়েটের ঘটনাটি সার্বিকভাবেই দুঃখজনক। ঘটনার শিকার ও ঘটনায় দায়ী দুই পক্ষের জন্য ঘটনাটি দুঃখজনক। তারা দুর্বৃত্ত বা সন্ত্রাসী হয়ে জন্ম নেয়নি। পরিবেশ তাদের ওই পথে ঠেলে দিয়েছে। দেখলাম, ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের পরিবারগুলো সচ্ছল নয়। অনেক কষ্ট করে পরিবার তাদের এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল। ওইসব ছাত্রের কার্যকলাপে তাদের পরিবারের স্বপ্নসৌধ ভেঙে গেছে। সমাজ ও দেশকে তারা অনেক কিছু দিতে পারত। সেই সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন মামলায় আদালতের মাধ্যমে বিচার হবে।’ গবেষক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বুয়েটের ঘটনায় অভিযুক্তরা অতীতে দুর্বৃত্ত ছিল না। তারা যে সংগঠনের নেতা-কর্মী, সেই সংগঠন তাদের ওই পথে নিয়ে এসেছে। তারা দলের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে সব দায় ছাত্র সংগঠন ও সরকারের লেজুড়বৃত্তি করা বা শিক্ষকদের ওপরও চাপানো সংগত হবে না। ওইসব ছাত্রের বাবা-মা কিংবা অভিভাবক যত দূরেই থাকুন; তাদেরও দায় রয়েছে। সন্তান ঢাকায় কে কী করছে, সে সম্পর্কে তাদের কোনোই ধারণা ছিল না এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাদের সন্তানরা যখন দলের নেতা হিসেবে পরিচিত সুতরাং সে খবরও তাদের জানা ছিল। অর্থাৎ ছাত্রসমাজের একটি অংশের এই যে সন্ত্রাসী তৎপরতা এর জন্য সমাজের অনেকেই কমবেশি দায়ী। তারা যে এ পথে গেছে, তাদের যে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে, এ পথে না গিয়ে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হলে পরিবার ও সমাজ তাদের নিয়ে গর্ব করতে পারত।’