করোনাভাইরাস: লকডাউন তুলে নেয়া নিয়ে রাজ্যগুলোর সাথে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরোধ
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস লকডাউন তুলে নেবার ব্যাপারে নিজের কর্তৃত্বকেই ‘চূড়ান্ত’ বলে দাবি করেছেন। বিভিন্ন রাজ্যের গভর্নর এবং আইন বিশেষজ্ঞদের তিনি উপেক্ষা করতে পারেন বলেও তিনি দাবি করেন। এক বাকবিতণ্ডাপূর্ণ সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।” ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে তার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বলা আছে আইন শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব অঙ্গরাজ্যগুলোর। দেশটির পূব ও পশ্চিমের দশটি রাজ্য ঘরের ভেতর থাকার কঠোর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার পরিকল্পনা করছে। বিশ্বে করোনাভাইরাস মহামারির এপিসেন্টার এখন আমেরিকা। সেখানে নিশ্চিতভাবে ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা ৫৫ লক্ষ ৪,৬৮৪ এবং মারা গেছে ২৩,৬০৮ জন।
কী চাইছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প?
হোয়াইট হাউসে প্রতিদিনের করোনাভাইরাস ব্রিফিংয়ে সোমবার রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট মি. ট্রাম্প বলেন যে, আমেরিকায় ব্যবসা বাণিজ্য খুলে দিয়ে অর্থনীতিকে আবার সচল করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করছে তার প্রশাসন। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ব্যবসা বাণিজ্য প্রধানত বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
ট্রাম্প প্রশাসন ইঙ্গিত দিয়েছে বিধিনিষেধ শিথিল করার সম্ভাব্য তারিখ পয়লা মে। হোয়াইট হাউসের বর্তমান নির্দেশ অনুযায়ী রেস্তোঁরায় যাওয়া বন্ধ রাখা, অপরিহার্য কারণ ছাড়া বাইরে না বের হওয়া এবং একসঙ্গে দশ জনের বেশি জমায়েত না হবার যে বিধান এখন চালু আছে তার মেয়াদ ৩০শে এপ্রিল শেষ হচ্ছে।
সাংবাদিকরা যখন প্রশ্ন করেন বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের প্রশাসন আলাদা আলাদাভাবে ঘরের ভেতর থাকার যে নির্দেশ জারি করেছে, তা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের আছে কিনা, তখন উত্তরে মি. ট্রাম্প বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যিনি প্রেসিডেন্ট তার ক্ষমতাই পুরোটা।”
“তার ক্ষমতাই চূড়ান্ত। গর্ভনররা সেটা জানেন।”
তিনি আরও বলেন: “তার পরেও আমরা রাজ্যগুলোর সঙ্গেই একসাথে কাজ করবো।”
প্রেসিডেন্ট জোর দিয়ে বলেন আমেরিকার প্রথম চার্টারের “বিভিন্ন অনুচ্ছেদে” প্রেসিডেন্টকে এই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যদিও কোন্ অনুচ্ছেদগুলোর কথা তিনি বলছেন তা তিনি স্পষ্ট করেননি।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন রাজ্য বা স্থানীয় পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কোনরকম নিষেধাজ্ঞা বা নির্দেশ বদলানোর এখতিয়ার প্রেসিডেন্টের নেই।
বিবিসির সাংবাদিক জন সোপেল প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমেরিকায় করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় দফা প্রাদুর্ভার শুরু হলে অর্থনীতি আবার বন্ধ ঘোষণার সম্ভাবনা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন কিনা। উত্তরে মি. ট্রাম্প বলেছেন: “আমার মাথার মধ্যে সে হিসাব আছে।”
তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন আমেরিকায় মৃত্যুর হার স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছাতে শুরু করেছে। তিনি বলেছেন এই সাফল্যের জন্য দায়ী সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রয়াস।
ব্রিফিংয়ের সময় হোয়াইট হাউস একটি সংকলিত ভিডিও পরিবেশন করে যাতে মিডিয়ার রিপোর্টিংয়ের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়, এই মহামারি মোকাবেলায় প্রেসিডেন্টের উদ্যোগের প্রশংসা করা হয় এবং বিভিন্ন রাজ্যের গভর্নরদের মুখে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রশংসাবাণী শোনানো হয়।
রাজ্যের গভর্নররা কী বলছেন?
বিভিন্ন রাজ্যের গভর্নররা বলছেন তাদের রাজ্যে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে সেগুলো কখন তুলে নেয়া হবে সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। মি. ট্রাম্প এ ব্যাপারে সব কর্তৃত্ব এককভাবে নিজের হাতে নিতে চান বলে দিনের আগের দিকে এক টুইটে যে দাবি করেছিলেন তার জবাবে পেনসিলভেনিয়া রাজ্যের গভর্নর টম উলফ বলেন: “আমার রাজ্যে সব কিছু বন্ধ করা হয়েছে যেভাবে আমাদের প্রশাসনিক দায়িত্বে, সেভাবে সব কিছু খোলার প্রাথমিক দায়িত্ব আমাদেরই।”
বিভিন্ন রাজ্যের গভর্নররা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবার শুরু করার পরিকল্পনা নিয়ে কথাবার্তা বলছেন ট্রাম্প প্রশাসনকে কোনভাবে জড়িত না করে। নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, রোড আইল্যান্ড, কানেকটিকাট, ডেলাওয়্যার, ম্যাসাচুসেটস্ এবং পেনসিলভেনিয়া এ ব্যাপারে সবদিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে বিধিনিষেধ তোলার দিনক্ষণ তারা দেননি।
যে দশটি রাজ্যের গভর্নর এ নিয়ে কথা বলেছেন তার মধ্যে ম্যাসাচুসেটস ছাড়া সবগুলো রাজ্যের গভর্নর ডেমোক্রাটিক পার্টির। চল্লিশটির বেশি রাজ্যের গভর্নর তাদের রাজ্যগুলোতে সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। নিউ ইয়র্কে করোনাভাইরাস শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৯০ হাজার। সেখানে মারা গেছে দশ হাজারের বেশি মানুষ। বিশ্বে মৃত্যুর হার সেখানে সবচেয়ে বেশি।
নিউ ইয়র্কের গভর্নর বলেছেন তার বিশ্বাস তার রাজ্যে “সবচেয়ে ভয়াবহ পর্যায় শেষ হয়েছে”।
বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টার সঙ্গে মিটমাট?
মি. ট্রাম্প তার ব্রিফিংয়ে বলেছেন আমেরিকায় সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ক প্রধান ড. অ্যান্টনি ফউসিকে তিনি বরখাস্ত করছেন না। একদিন আগেই মি. ট্রাম্প #firefauci #বরখাস্তফউসি এই হ্যাশটাগ দিয়ে টুইট করেছিলেন।
আমেরিকার এই শীর্ষ বিশেষজ্ঞ সিএনএন টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সরাসরি এক সম্প্রচারে বলেছিলেন আমেরিকা করোনাভাইরাসে প্রাদুর্ভাব শুরু হবার পর আরও আগে লকডাউন জারি করলে আরও প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হতো। তার এই মন্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান ট্রাম্প সমর্থকরা।
তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার সোমবারের ব্রিফিংয়ে বলেন তিনি ড. ফউসির মতকে সমর্থন করেন এবং এই বিজ্ঞানীকে তিনি শ্রদ্ধা করেন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ কী কৌশল নিয়েছে?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন শিথিল করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। চীনের উহানে, যেখানে গত ডিসেম্বরে প্রথম কোভিড নাইনটিনের সংক্রমণ ধরা পড়ে এবং যেখান থেকে এটা বিশ্ব জুড়ে ছড়ায়, সেখানে মানুষজনকে দুই মাসের ওপর বিচ্ছিন্ন রাখার পর শহরের বিভিন্ন জায়গা আংশিকভাবে খুলে দেয়া হয়েছে।
স্পেন জরুরি সেবার সাথে যুক্ত নয় এমন তিন লাখ মানুষকে কাজে ফেরার অনুমতি দিয়েছে। ইউরোপে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের দেশ ইতালি এ সপ্তাহে অল্প কিছু ব্যবসা বাণিজ্য আবার খুলে দিচ্ছে।
ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ঘোষণা করেছেন দেশটিতে কার্যত যে লকডাউন চলছে তা ১১ই মে পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
ব্রিটেনের সরকার বলেছে দেশটিতে লকডাউনের যে বিধিনিষেধ জারি রয়েছে তাতে এ সপ্তাহে কোন পরিবর্তন আনা হবে না। সূত্র : বিবিসি