চীন-ভারত সম্পর্কে করোনার আঘাত!
ভারত এশিয়ার প্রথম অ-কমিউনিস্ট দেশ হিসেবে ১৯৫০ সালের ১ এপ্রিল চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু ওই ঘটনার ৭০তম বার্ষিকী উদযাপনের পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে গেছে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে।
ওই অনুষ্ঠান বাতিল হওয়া সত্ত্বেও এক সিনিয়র চীনা কর্মকর্তা বলেছেন যে দুই দেশ মহামারিটির পর সম্পর্কের নতুন উচ্চতায় আরোহণ করবে ও তাদের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হবে। উভয় দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীরা শুভেচ্ছা বার্তা বিনিময় করেছেন এবং এশিয়া এবং সেইসাথে বিশ্বে আরো ইতিবাচক দিকে এগিয়ে নিতে এবং দুই দেশ ও জনগণের আরো কল্যান্ডে একসাথে কাজ করার বাগাড়ম্বড়তামূলক বিবৃতি দিয়েছেন।
ভারতে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত সান ওয়েদং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ির পঞ্চশীল মূলনীতির উল্লেখ করে বলেছেন যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ৫ মূলনীতি নতুন ধরনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তোলায় অবদান রাখতে পারে। চীন-ভারত ইতিহাস বিবেচনা করলে পঞ্চশীল হয়তো সর্বোত্তম উদ্ধৃতি মনে হবে না। কারণ ভারতীয় কর্মকর্তারা এর কথা খুবই কম উল্লেখ করেন। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের সাথে এর সম্পৃক্ত আছে বলে তাদের মত, আর তাদের ধারণা, ওই সময় চীন বিশ্বাসঘাকতা করেছিল। তাছাড়া করোনাভাইরাস চীন-ভারত সম্পর্ককে কতটা আক্রান্ত করে, সেটাও দেখার বিষয়।
দৈনন্দিন সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিয়িং বেশ উৎফুল্লই ছিলেন। তিনি উল্লেখ করেন যে চেন্নাইয়ে দ্বিতীয় চীন-ভারত অনানুষ্ঠানিক শীর্ষ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭০ বছর উদযাপনে ৭০টি কার্যক্রম গ্রহণে সম্মত হয়েছিলেন। আইন, ব্যবসা, সংস্কৃতি, প্রতিরক্ষাসহ সব ক্ষেত্রেই এই ৭০টি কার্যক্রম পরিব্যাপ্ত হবে বলে আশা করা হয়েছিল।
উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ২০১৯ সালের অক্টোবরে ওই বার্ষিকী উদযাপনের বিস্তারিত পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন। হুয়া এমনও বলেছিলেন যে ৭০ বছর উদযাপন একটি সযুযোগ, এটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। মহামারি ঠেকাতে ভারতকে বেন্টিলেটর সরবরাহ করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চীনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ হলে তা করা যেতে পারে।
এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস বিস্তারের জন্য চীনকে দোষারোপ করার ব্যাপারে ভারত সরকার বেশ সতর্ক রয়েছে। বস্তুত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর টুইটে বলেছেন যে তিনি চীরে স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে করোনা দমনের উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং এ ব্যাপারে সমন্বিত প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন। আর ভারতকে কাছে টানতে চীনও বলেছে, সে তার মহামারি প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ, চিকিৎসার অভিজ্ঞতা জানাতে চায়, আরো সহায়তা ও সহায্য প্রদান করতে চায়। তবে চীনা সহায়তা গ্রহণের প্রস্তাব ভারত গ্রহণে গররাজিই থাকতে পারে। কারণ ইতালি, চেক প্রজাতন্ত্র, স্পেনে চীন যেসব টেস্টিং কিট দিয়েছে, তাতে করে ভালো ফল আসেনি।
তাছাড়া মহামারিতে চীনা ভূমিকা চীন-ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। চীন স্বচ্ছ থাকলে মহামারিটি আরো কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা যেত। আর ভারতসহ সবার কাছে বিষয়টি পরিষ্কার। চীন কেবল তার দেশে ভাইরাসটির বিস্তার ও মানব দেহে সংক্রমণের বিষয়টিই চেপে যায়নি, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকেও উহান ভাইরাসটি নিয়ে উচ্চবাক্য করা থেকে বিরত রেখেছে।
হু তো এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে। এর মহাপরিচালক টেডরস আধানম ঘেব্রেয়েসাস ‘স্বচ্ছতার’ জন্য চীনের প্রশংসা করে বলেছেন, ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে চীন যা করেছে, তা সবার কাছে মডেল হতে পারে। উল্লেখ্য, চীনের সমর্থন নিয়েই ২০১৭ সালে সংস্থাটির বর্তমান মহাপরিচালক দায়িত্বে এসেছিলেন।
ভারত এখন পর্যন্ত জাতীয় লকডাউন করার মাধ্যমে করোনাভাইরাসটির বিস্তার ঠেকিয়ে রেখেছে। তবে এর অর্থনৈতিক ক্ষতি বিপুল। তাছাড়া ভারত এই ভাইরাসের জন্য চীনকে সরকারিভাবে দোষারোপ না করলেও জনসাধারণের মধ্যে চীন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। আর জনসাধারণের মনোভাব ভারতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রভাব ফেলতে পারে। এখন পর্যন্ত বার্ষিকী নিয়ে বিনীত শব্দ ও পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় হতে থাকলেও মহামারিটি আবারো হয়তো নয়া দিল্লিতে ইঙ্গিত করছে যে চীন সম্ভবত স্বার্থপর। আর এতে এই উদ্বেগ চীনের আচরণ নিয়ে ভারতের মধ্যে থাকা উদ্বেগকেই গভীরতর করতে পারে।