ভারতের রোহিঙ্গাদের আর্তি: করোনার আগে ক্ষুধাই আমাদের মেরে ফেলবে
করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করার জন্য ভারত সরকার তিন সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করার পর দিন মোহাম্মদ তার পরিবার ও দেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সুস্থ রাখার জন্য তার আয়ত্বে থাকা সম্ভব সব শক্তি ব্যবহার করছেন।
তিনি তার স্ত্রী ও ৫ সন্তানকে নিয়ে রাজধানী দিল্লির মদনপুর খাদর উদ্বাস্তু শিবিরে থাকেন। গত সপ্তাহে ৫৯ বছর বয়স্ক দিন মোহাম্মদ বস্তিগুলোতে ঘুরে ঘুরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, তাদের কুঁড়েঘরগুলোর কাঠ ও প্লাস্টিক শিটগুলো পরিষ্কার রাখার পরামর্শ দেন।
তবে তিনি জানেন, তারা যেসব ঘিঞ্জি উদ্বাস্তু শিবিরে থাকেন, সেখানে এ ধরনের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা কঠিন। টয়লেট ও পরিষ্কার পানির মতো মৌলিক সুযোগও যেখানে তাদের নেই, সেখানে কিভাবে তারা এসব করবেন।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, আমরা আক্ষরিক অর্থেই বারুদের স্তুপে বসে আছি। এটি বিস্ফোরিত হতে বেশি সময় নেবে না।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম উদ্বাস্তু বাস করে। তাদেরকে করোনাভাইরাস মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কোনো সম্বল ছাড়াই ছেড়ে দেয়ায় তারা মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত ২৪ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি করোনাভাইরাস বিস্তার ঠেকাতে কঠোর লকডাউনের কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তা একটি ‘হিউম্যান ট্রাজেডিতে’ পরিণত হয়েছে। লাখ লাখ অভিবাসী শ্রমিক নগরীগুলো থেকে পালাচ্ছেন, তাদের অনেককে শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বাড়িতে যেতে হচ্ছে। তারা যেসব কারখানা বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করত, সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
সমালোচকেরা বলছেন, সরকার কোনো যথার্থ পরিকল্পনা ছাড়াই লকডাউন করে ফেলেছে।
ক্যাম্পগুলোতে করোনাভাইরাস ছড়ানোর শঙ্কা
রাজধানীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে প্রায় ৪০০ রোহিঙ্গা পরিবার হরিয়ানার নুহ জেলার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের একটি উদ্বাস্তু ক্যাম্পে বাস করে। তাদের কাছে সাবান একটি বিলাস পণ্য। মাস্ক ও স্যানিটাইজার তো কল্পনায়ও আসে না।
সবাই ভাইরাসটি নিয়ে চিন্তিত, কিন্তু কিভাবে নিজেদের রক্ষা করবে, সে সম্পর্কে জানে সামান্যই। একটির সাথে আরেকটি লাগোয়া অস্থায়ী বস্তিগুলোতে দূরত্ব বজায় রাখা অসম্ভব। সার্বিক পয়োঃপ্রণালী খুবই খারাপ অবস্থায় আছে, টয়লেটগুলো অপরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুবিধা দুর্লভ বিষয়।
কম্পিউটার শিক্ষক জাফর উল্লাহ এসব বস্তির একটিতে বাস করেন। ২৯ বছর বয়স্ক শনিবার তার সাবানের শেষ টুকরাটি খরচ করে ফেলেছেন। এখন হাত ধোয়ার আর কিছুই নেই।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, আমাদের বস্তিতে মাত্র কয়েকটি পরিবারে সাবান আছে। বেশির ভাগেরই কেনার সামর্থ্য নেই।
স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল কর্মীরা আশপাশের আবাসিক এলাকায় জীবাণুনাশক ছিটিয়ে গেলেও এখানে আসেনি। গত কয়েক দিনে উদ্বাস্তুদের কয়েকজনের জ্বর দেখা গেছে বলেও জানান জাফর।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, আমি জানি না তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিনা। তবে লোকজন তেমনই সন্দেহ করছে। তবে হাসপাতালের বহির্বিভাগ বন্ধ থাকায় তারা সেখানে যেতে পারছে না। আমাদের দেখার জন্য প্রশাসনের কেউ আসেনি।
বেশির ভাগ হাসপাতালেই ২৪ মার্চে লকডাউনের পর থেকে বহির্বিভাগ বন্ধ রেখেছে।
গত বৃহস্পতিবার দিল্লির অমুনাফামূলক এনজিও রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ মদনপর খদর ক্যাম্পে ঘরে ঘরে গিয়ে জরিপ চালিয়ে ৩৭ জনের মধ্যে সর্দি ও জ্বরে আক্রান্ত দেখতে পেয়েছে। এগুলো করোনার লক্ষণ।
সংগঠনটির সাব্বার কিয়াও মিন আল জাজিরাকে বলেন, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বস্তিগুলোতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ভয়াবহ ঝুঁকি আছে। ভারত সরকার তার নিজের লোকজনকে রক্ষা করছে, আর ইউএনএইচসিআরের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো আমাদের দিকে চোখ বন্ধ করে আছে। আমরা আক্ষরিক অর্থেই অসহায় হয়ে আছি।
খাদ্যের অভাব
নুহ উদ্বাস্তু ক্যাম্পের বদর আলম একটি নির্মাণ সাইটে দিনমজুরের কাজ করেন। কিন্তু লকডাউনের ফলে তিনি বেকার হয়ে পড়েছেন। ৩১ বছর বয়স্ক এই তরুণ বলেন, তার স্ত্রী ও তিন সন্তানের মুখে এক সপ্তাহ ধরে তেমন কিছুই দিতে পারছেন না।
তার কাছে আছে দুই কেজি চাল, আড়াই শ’ গ্রাম ডাল, আর আড়াই শ’ রুপি। অথচ আগামী দুই সপ্তাহ তার কাজ থাকবে না। তিনি সন্তানদের কী খাওয়াবেন? পাথর?
কাশ্মির অঞ্চলের জম্মুতে প্রায় ১২ শ’ রোহিঙ্গা পরিবার মূলত আখরোট কারখানায় কাজ করে চলত। এখন তাকে উপোস করে থাকতে হচ্ছে।
রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য একটি মাদরাসা পরিচালনা করেন হাফিজ মুবাশ্বের। এক সপ্তাহ আগে তিনি সেটি বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে গত তিন দিন ধরে তিনি ছাত্রদের কাছ থেকে সাহায্যের আবেদন পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, লকডাউন আমাদের খাবার সমস্যা প্রকট করেছে।
তিনি বলেন, আমাদের অনেকে এখনই না খেয়ে আছে। অনেকে দিনে এক বেলা খাচ্ছে।
তিনি মনে করেন, আগামী সাত দিন রোহিঙ্গাদের জন্য সত্যিই কঠিন সময়। প্রায় কোনো পরিবারের কাছেই খাবার থাকবে না।
তিনি বলেন, আমাদের ওপর একসাথে আক্রমণ করেছে ক্ষুধা ও করোনাভাইরাস। তবে আমার মনে হয়, ভাইরাসের আগে আমরা ক্ষুধাতেই মারা যাব।