দ. এশিয়ায় পরিস্থিতি সামলাতে সফল শ্রীলঙ্কাসহ ৪ দেশ
মার্চ মাসে সাধারণ ছুটি, সান্ধ্য আইন প্রভৃতি নামে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশে লকডাউন (অবরোধ) ঘোষণার পরও এ অঞ্চলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থামছে না। ভারত ও পাকিস্তানের মতো অত্যধিক জনগোষ্ঠীর দেশগুলোতে সংক্রমণের হার বেড়ে চলেছে। রোগ সংক্রমণের ওই হার ভাইরাসের সংক্রমণ দ্বিতীয় ধাপ থেকে তৃতীয় ধাপে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। অর্থাৎ ভাইরাস সংক্রমণের তৃতীয় ধাপটা হচ্ছে বিদেশ থেকে ফেরা লোকজনের মাধ্যমে জনগোষ্ঠীর মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়াতে থাকা।
দক্ষিণ এশিয়ার বড় দুই দেশে (ভারত-পাকিস্তান) ভাইরাসের সংক্রমণের বিস্তারের চিত্র পরিসংখ্যানে থাকলেও পুরো অঞ্চলের চিত্রটা মিশ্র। শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তান এ দুই দেশে অন্তত দেড় শ করে মানুষের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হলেও মৃত্যুর সংখ্যা ৫ জনেরও কম। তবে আফগানিস্তানে গত ২৪ ঘণ্টায় ২২ জন নতুন শনাক্ত হওয়ায় দেশটির সংক্রমণের হার বাড়ার ইঙ্গিত দেয়। আবার বাংলাদেশে করোনায় এ পর্যন্ত ৬ জন মারা গেলেও আক্রান্তের সংখ্যা ৫৪ জন। অন্যদিকে নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ—এই তিন দেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যায়নি। অর্থাৎ এই তিন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখন পর্যন্ত প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে এ মুহূর্তে করোনার সংক্রমণ ঘটা প্রধান দেশ যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইতালির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। আবার চীন ও ইতালিতে করোনাভাইরাসের বিস্তারের মাঝপথে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নাগরিকেরা নিজেদের দেশে ফিরেছেন।
নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ফরেন রিলেশন্সের গত সপ্তাহের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, রোগের নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় জনস্বাস্থ্য ও পয়োনিষ্কাশনের সুবিধা পর্যাপ্ত নয়। এর পাশাপাশি এ অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব খুব বেশি। এ বিষয়গুলো দক্ষিণ এশিয়ায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকিতে রাখছে বলে মত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
ভারতে ২১ দিনের লকডাউনের প্রসঙ্গ টেনে ওই বিশ্লেষণে মন্তব্য করা হয়েছে, ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণের প্রমাণ নেই বলে দাবি করছে। অথচ অন্য দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, এই ভাইরাস দ্রুত একটি এলাকায় সংক্রমিত হয়ে থাকে।
পাকিস্তানের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাকিস্তানে ফেরা লোকজনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা যথাযথভাবে হয়নি এবং তাঁদের কোয়ারেন্টিনেও পাঠানো হয়নি। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর এক খবরে বলা হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি এলাকার সমগ্র জনগোষ্ঠীকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে। আবার সামাজিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কায় কেউ কেউ গা ঢাকা দিয়েছেন।
আট দেশের পরিসংখ্যান
বুধবার পর্যন্ত সবশেষ তথ্য অনুযায়ী ভারতে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৩৭ জন করোনাভাইরাস সংক্রমণের শিকার হয়েছে আর মারা গেছে ৪৫ জন। এদের মধ্যে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ২৪০ জন ও মারা গেছে ১০ জন।
পাকিস্তানে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৪২ জন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়েছে আর মারা গেছে ২৬ জন। তাদের মধ্যে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ১০৪ জন, কেউ মারা যায়নি।
আফগানিস্তান ২২ জন নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার পর এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ১৯৬ জন। আর মারা গেছে ৪ জন। শ্রীলঙ্কায় নতুন করে ৩ জন আক্রান্ত হওয়ার পর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১৪৬ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ২ জন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৫৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এদের মধ্যে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ৩ জন। আর একজন মারা যাওয়ায় বাংলাদেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৬ জন।
অন্যদিকে মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটানে এখন পর্যন্ত যথাক্রমে ১৮, ৫ ও ৪ জন শনাক্ত হলেও এখন পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি।
জানুয়ারির ২৬ তারিখ শ্রীলঙ্কায় করোনাভাইরাসের প্রথম ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দেশটি। সাধারণ ছুটির নামে ১৪ মার্চ থেকে প্রথম ধাপে লকডাউনের দুই সপ্তাহ আগে কূটনীতিকদের নিয়ে ব্রিফিং করেন শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীনেশ গুনাবর্ধানে। করোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি সামাল দিতে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর প্রধানকে প্রধান সমন্বয়কারী করা হলেও সেনাবাহিনী মূলত সমন্বয়ের কাজটি করেছে। তবে লোকজনের ঘর থেকে বের হওয়া প্রতিহত করাসহ সব ধরনের নজরদারি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থেকেছে পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনী। ১৫ মার্চ সাধারণ ছুটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়। ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে অনির্দিষ্টকালের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেন।
শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কলম্বোতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ এই প্রতিবেদককে বলেন, শ্রীলঙ্কা বিদেশফেরত লোকজনকে যথাযথভাবে কোয়ারেন্টিনে নিতে পুলিশকে কার্যকরভাবে কাজে লাগিয়েছে। মার্চের ১ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত চীন, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়াফেরত লোকজনকে বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে যাওয়ার পাশাপাশি নাম-ঠিকানা দিয়ে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বলে শ্রীলঙ্কার পুলিশ। ওই ঘোষণার পরও বিদেশফেরত লোকজনের সবাই পুলিশের কাছে নিবন্ধন না করায় পরে আরেকটি নির্দেশ জারি করে পুলিশ। ওই নির্দেশে বলা হয়, যাঁরা পুলিশের কাছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধন করছেন না, তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ক্রোক করা হবে। এর পরই বাকি লোকজন পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে নাম-ঠিকানা দিয়ে কোয়ারেন্টিনে গেছেন।