জয় শ্রী রাম: এই তিন শব্দ ব্যবহার করে ভারতে আপনাকে পিটিয়ে হত্যা করা হতে পারে

0

রাত তখন গভীর হচ্ছে। উত্তর-পূর্ব দিল্লির গোকুলপুরি পামে ভাগিরথি বিহারে মোটরবাইকে প্রায় ৩০ যুবক প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের টার্গেট মোশাররফ নামের এক স্থানীয় মুসলিমের বাড়ি। ২৪ ফেব্রুয়ারি আশপাশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর তার পরিবারটি বাড়ির ভেতরেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

যুবকেরা মোশাররফের দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে জয় শ্রী রাম ধ্বনি দিতে লাগল। কেউ যখন দরজা খুলতে এলো না, তখন দুর্বৃত্তরা বাড়িটিতে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিলো। তাদের থামাতে বের হয়ে এলেন মোশাররফ। তাকে সাথে সাথে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। মিডিয়ার খবরে এসেছে, তার লাশ ড্রেনে ফেলে দেয়া হয়।

গত ১৫ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জাতীয়তাবাদী সরকারের পাস করা একটি আইনের বিরুদ্ধে দিল্লির রাজপথে বিক্ষোভ শুরু হয়। কারণ ওই আইনে ভারতের মুসলিমদের ভোটাধিকার হরণ করে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানোর ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু ২৩ ফেব্রুয়ারি দিল্লির উত্তর-পূর্ব অংশে যে ধর্মীয় উত্তেজনার আগুন ছড়িয়ে পড়ে, তাতে প্রায় ৫০ জন নিহত হয়, আহত হয় ২৫০-এর মতো।

মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা কেবল দিল্লিতেই সীমিত নয়, কয়েক বছর আগে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিষয়টি স্বাভবিক ঘটনা হয়ে পড়েছে।

মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যা করার বেশির ভাগ ঘটনা ঘটিয়েছে আরএসএসের সমর্থনপুষ্ট সংগঠনগুলো। 

অর্থ বিকৃতি

একসময় জয় শ্রী রাম ধ্বনি ছিল ধর্ম-নির্বিশেষে সবাইকে শুভেচ্ছা জানানোর পরিভাষা। শুরুতে এর অর্থ ছিল ‘শুভেচ্ছা প্রভু রাম।’ কিন্তু হিন্দু মৌলবাদীদের কাছে এর অর্থ হলো ‘প্রভু রামের বিজয়!’

আর মুসলিমদের প্রতি যখন জয় শ্রীরাম ধ্বনি উচ্চারণ করা হয়, তখন তার অর্থ দাঁড়ায়, ভারত হলো কেবল হিন্দুদের দেশ, এখানে যদি মুসলিমরা টিকে থাকতে চায়, তবে তাদেরকে অবশ্যই হিন্দু দেবতাদের প্রশংসা করতে হবে।

অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, মুসলিমদেরকে কোণঠাসা করার জন্য মোদি সরকারের নীতির কারণেই এই বিশ্বাস জোরদার হয়েছে। ১৯৯২ সালে হিন্দু মৌলবাদীরা চার শ’ বছরের পুরনো বাবরি মসজিদ ভেঙ্গেছিল সেটিকে রামের জন্মস্থান হিসেবে অভিহিত করে।

গত বছর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট উল্লেখ করে যে মুসলিমটি ভাঙ্গা উচিত হয়নি। তবে বিতর্কিত এলাকায় রাম মন্দির নির্মাণের জন্য হিন্দু সংগঠনকে অনুমতিও দেয় আদালত।

মুম্বাইভিত্তিক সেন্টার ফর স্টাডি অব সোসাইটি অ্যান্ড সেক্যুলারিজমের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০১৯ সালে দাঙ্গাবাজদের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১০৭টি। এতে প্রাণ গেছে ৬৮ জনের, মারাত্মক আহত হয়েছে ১২০ জন। ২০১৮ সালের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০ ভাগ, ওই বছর ঘটনা ঘটেছিল ৮৪টি।

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, গত বছরে ঘটা ১৬টি ঘটনায় দেখা যায়, দাঙ্গাবাজেরা ভিক্টিমের কাছে জয় শ্রী রাম স্লোগান দেয়ার দাবি করেছে।

বিধ্বস্ত ব্যবস্থা

ভারতে পিটিয়ে মারার একটি ঘটনারও বিচার হয়নি।

সেন্টার ফর স্টাডি অব সোসাইটি অ্যান্ড সেক্যুলারিজমের প্রতিবেদনটির যৌথ প্রণেতা ইরফান ইঞ্জিনিয়ার বলেন, শাস্তি পাওয়ার কোনো ভয় না থাকায় হামলাকারীদের কেবল সাহসীই করে তুলছে না, সেইসাথে পুরো ব্যবস্থাই যে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে, সেটিও প্রমাণ করছে।

মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যার প্রথম বড় ধরনের ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে। উত্তর প্র্রদেশে দাঙ্গাবাজেরা মোহাম্মদ আখলাক নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে ঢুকে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি গোপনে গরু জবাই করে তার ফ্রিজে এর গোশত রেখে দিয়েছেন। প্রায় ১৫০ জনের একটি দল তাকে পিটিয়ে হত্যা করে।

এই ঘটনা নিয়ে ভারতে বিপুল ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

ইঞ্জিনিয়ার বলেন, এ ধরনের ঘটনা অতীতে ঘটেছে। লোকজন রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু কারো বিচার হয়নি।

একটি আদালত পরে জানায় যে আখলাকের ফ্রিজে রাখা গোশত ছিল ছাগলের। ওই ঘটনায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হলেও সবাই জামিনে মুক্তি পায়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের সময় যোগী আদিত্যনাথের নির্বাচনী প্রচারণায় ওই হামলাকারীদের একজনকে সামনের সারিতে দেখা যায়।

আখলাকের ঘটনার পর থেকে পিটিয়ে হত্যার খবর প্রায়ই আসতে থাকে। আর অসহায় পরিবারগুলোর দুর্দশা থেকে মুক্তির কোনো পথ থাকে না।

মোশাররফের পরিবারও অসহায় হয়ে পড়েছে। তার ভাই মুনজিদ জানান, তারা এখন উত্তর প্রদেশে তাদের পৈত্রিক গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, যে নগরীতে আমরা নিরাপদ বোধ করি না, সেখানে থাকতে পারি না। তাছাড়া এই নগরী আমাদের মোশাররফের কথাই মনে করিয়ে দেয়।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com