কারফিউতে অভ্যস্ত কাশ্মিরিরা ‘করোনা লকডাউনে’ নির্বিকার
জনশূন্য রাস্তায় গজের পর গজ প্যাঁচানো তার দিয়ে ঘেরা, কোনো গাড়ি নেই, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, লোকজন তাদের নিজ নিজ ঘরে বন্দী। আজকের কাশ্মির এমনই।
তবে ভুল করবেন না, এটি কাশ্মিরের অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। গত বছরের ৫ আগস্ট থেকেই উপত্যকার এই অবস্থা। তবে এবার সন্ত্রাস বা সহিংসতার স্বাভাবিক কারণে নয়, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে।
মজার ব্যাপার হলো, কাশ্মিরের ইতিহাসে এই প্রথম অরাজনৈতিক কোনো কারণে লকডাউন হলো। এবারের লকডাউন একেবারে সামগ্রিক ও অস্বাভাবিক।
ভারতে ২৪ মার্চ পর্যন্ত কোভিড-১৯ ধরা পড়েছে ৫ শতাধিক। আর কাশ্মিরে চিহ্নিত হয়েছে ছয়টি। ফলে সরকার অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যের মতো কাশ্মিরেও ৩১ মার্চ পর্যন্ত লকডাউন করেছে।
রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, স্কুল ও সরকারি অফিসও খুলছে না। তবে ৩০ বছর ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর এ ধরনের অবস্থা কাশ্মিরে নতুন কিছু নয়।
কাশ্মিরের ইতিহাসের ওপর বিশেষজ্ঞ আবিদ সিমনানি বলেন, পুরো ভারতে যদি কোনো একটি অঞ্চলে সরকারের সব বিধিনিষেধ পালন করা হয়, তবে সেটা হবে কাশ্মির। কারণ, এখানকার লোকজন শাটডাউনে অভ্যস্ত। গত তিন দশক ধরে এখানে অন্যান্য বিধিনিষেধও জারি রয়েছে।
তিনি বলেন, আপনি প্রতিটি কাশ্মিরির বাড়িতে আলাদা একটি কক্ষ দেখতে পাবেন। লোকজন একে বলে স্টোর রুম। এখানে মুদি সামগ্রী, রান্নার তেল, ডাল – সবই তাকের ওপর আলাদা আলাদা করে রাখা হয়। কয়েক মাস চলার উপযোগী মালামাল থাকে এখানে। ৩০ বছর আগে যখন গোলযোগ শুরু হয়, তখনই এই সূচনা। তাদেরকে যদি কয়েক মাস আটকে রাখা হয়, তবুও তাদের কোনো সমস্যা হবে না। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে লকডাউন নতুন হলেও কাশ্মিরে তা স্বাভাবিক বিষয়।
প্রথম কারফিউ
১৯৪৭-পরবর্তী কাশ্মিরে প্রথম বড় ধরনের বিক্ষোভ দেখা যায় ১৯৯০ সালের ২১ জানুয়ারি। শ্রীনগরে লোকজন কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে। তারা তাদের প্রিয়জনদের মুক্তির দাবি জানাতে থাকে। বাতামালু, বারজুলা, রাব বাগ, জওয়ার নগর ও চান্দপুরার লোকজন শ্রীনগরের লাল চকে সমায়েত হয়। বাদশাহ চক দিয়ে মিছিল শুরু হয়। এটি গাও কদালে পৌঁছলে নিরাপত্তা বাহিনী চার দিক থেকে ঘিরে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। রক্তের বন্যা বযে যায়।
কাশ্মিরিরা এমন বিক্ষোভ করেছিল ১৯৩১ সালে। ওই সময়ও শ্রীনগরের কেন্দ্রীয় কারাগারে বাইরে মহারাজার বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করেছিল। হতাহতদের জামিয়া মসজিদে নেয়া হয়। এক আহত তরুণ শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহর কানে কানে বলেন: আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। এখন আপনার দায়িত্ব মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
বিদেশী সংবাদ সংস্থাগুলোর মতে, গাও কাদল হত্যাযজ্ঞে নিহত হয়েছিল ১০০ জন। পরে সোনাওয়ার, লাল বাজার, ডাল গেট, হাওয়াল, গোলাব বাগ, তায়েলবাল, হজরতবাল, নাগবাল ও গান্দারবালেও বিক্ষোভ হয়।
প্রথমবারের কারফিউ ১২ দিন স্থায়ী হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদ আশিক হোসাইন ভাট জানিয়েছেন। এতে লোকজন মারাত্মক দুর্ভোগে পড়েছিল। ওই সময়ই লোকজন তাদের বাড়ির ছোট উঠানটিকে ছোট খামারে পরিণত করেছিল।
অবিরাম কারফিউয়ের মধ্যেই লোকজন নিজেদের মতো করে জীবনযাপন শুরু করে দিয়েছিল।
অবরোধ অব্যাহত
সবচেয়ে দীর্ঘ কারফিউ হয় ২০০৮ সালে। কিছু বন এলাকা হিন্দু মন্দিরকে দেয়ার প্রতিবাদ করেছিল লোকজন। কারফিউ স্থায়ী হয়েছিল দুই মাস। ওই বছর বিক্ষোভে নিহত হয়েছিল ১৪৭ জন।
তারপর ২০১০ সালে তিন মাসের বিক্ষোভকালে শিশুসহ ১২০ জন নিহত হয়।
তারপর ২০১৩ সালে দিল্লির তিহার জেলে পার্লামেন্টে হামলার দায়ে আফজাল গুরুকে ফাঁসি দেয়ার সময় কাশ্মিরে ১৩ দিন কারফিউ চলে। ২০১৬ সালে তরুণ মুজাহিদ বুরহান ওয়ানিকে হত্যার পর কাশ্মিরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। তখন কাশ্মির ছয় মাসের বেশি সময় শাটডাউন থাকে।
আর ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট কাশ্মিরে সবচেয়ে কঠিন শাটডাউন করা হয়। ওই দিন কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেয়া হয়। এসময় হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়, ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়। ছয় মাসের বেশি সময় ধরে চলে এই লকডাউন।
কাশ্মিরের এক অধিবাসী মোহাম্মদ ইসমাইল খান। পুরনো নগরীর এই ব্যবসায়ী জানেন ঘরের ভেতরে কিভাবে সময় কাটাতে হয়।
তিনি বলেন, কাশ্মিরের লোকজন এমন অবস্থায় উপনীত হয়েছে যে লকডাউন তাদের আর কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। তারা আর কারফিউ ও বিধিনিষেধকে ভয় পায় না। বাড়ির ভেতরে আটকে থাকা তাদের জীবনের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে।
কাশ্মিরি শিশুরাও ঘরের ভেতরে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এক শিশু মনোস্তত্ত্ববিদের মতে, তারা ব্যস্ত মার্কেটে যাওয়ার জন্য লাফালাফি করে না।
তিনি বলেন, অতীতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা কাশ্মিরিদের জন্য আশীর্বাদে পরিণত হয়েছে। তারা করোনাভাইরাসের মহামারী রোধে সবচেয়ে কার্যকরভাবে ঘরের ভেতরে থাকতে পারছে। দীর্ঘ লকডাউনের ধকল সামলানোর ক্ষেত্রে বিশ্বে কেউই কাশ্মিরিদের হারাতে পারবে না।