করোনায় নিয়োজিত কর্মীদের ব্যাপক সম্মাননা ব্রিটেন সরকারের
সারাবিশ্বের মতো ব্রিটেনেও কভোড-১৯ করোনাভাইরাসে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। এ পর্যন্ত এই ভাইরাসে ব্রিটেনে মারা গেছেন ৫৭৮ জন আর আক্রান্ত ১০ হাজারের উপরে। এসব হাজার হাজার মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন দেশটির ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ( এনএইচএস) কর্মীরা। তাই এনএইচএসের কর্মীদের সম্মাননা ও অগ্রাধিকার দিয়ে নানা আয়োজন করেছে সরকার।
বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় তাদেরকে বিশেষ মর্যাদা দিতে সরকার উদ্যোগ নেয় বিশেষ সম্মানার। ওই সময় সারাদেশের মানুষকে ঘর থেকে বের হয়ে করোনার বীর সেনানী এনএইচএসের কর্মীদের জন্য তালি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। শুধু সরকারের আহ্বানে সাড়া নয়, এনএইচএস কর্মীদের প্রতি নিজেদের কৃতজ্ঞতা থেকেও ব্রিটেনের জনগন সতস্ফূর্তভাবে বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় একযোগে শুরু করেন হাততালি।
রাজ পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ও চ্যান্সেলরসহ অনেক মন্ত্রীরাও ওই কর্মসূচীতে অংশ নেন। এমনকি ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথের ছেলে প্রিন্স চার্লস করোনায় আক্রান্ত হয়েও তার স্ত্রী ক্যামিলাসহ ক্ল্যাপ ফর কেয়ারার সম্মাননা অনুষ্ঠানে অংশ নেন নিজ বাসস্থান থেকে। তারা এখন স্কটল্যান্ডের বার্কহলে অবস্থান করছেন। ওই হলে চার্লস এক রুমে আইসোলেশনে থাকায় তার স্ত্রী অন্য রুমে অবস্থান করছেন। তাই তিনি এক রুমে ও স্ত্রী কেমিলা অন্য রুমের জানালা দিয়ে হাততালি দেন। রানীর নাতি প্রিন্স উইলিয়াম ও তার স্ত্রী কেইট তাদের তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ক্ল্যাপ ফর কেয়ারারে অংশ নেন।
এদিকে করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত সেবা কর্মীদের জন্য গাড়ি পার্কিং ফ্রি ঘোষণা করেছে ব্রিটেন সরকার। করোনাভাইরাসে জনগনকে সহায়তা করতে গিয়ে এনএইচএসের কর্মীদের বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়। এজন্য তাদের হঠাৎ করে যেকোনো স্থানে গাড়ি পার্কিংয়ের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু ব্রিটেনে নিজের ইচ্ছা মতো যেকোনো স্থানে গাড়ি পার্কিং করার নিয়ম নেই। সবাইকে নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি পার্কিং করতে হয়। ওই নিয়ম মেনে গাড়ি পার্কিং করে অনেক সময় এনএইচএসের কর্মীদের সেবা দেয়া দুরহ হয়ে পড়ে। এজন্য তাদের দিতে হয় আক্কেলসেলামী অর্থাৎ ভুল পার্কিংয়ের জন্য জরিমানা। করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবার জন্য এই মহামারীর সময় সরকার এসএইচএসের কর্মীদের জন্য ফ্রি পার্কিয়ের ব্যবস্থা করেছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক জানিয়েছেন, করোনা মহামারী আমাদের জাতীয় দুর্যোগ। এসময় আমরা আত্মনিবেদিত এনএইচএসের কর্মীদের জন্য যে কোনো সহায়তা করতে প্রস্তুত। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী রবার্ট জেনরিকও এনএইচএসের কর্মীদের জন্য অর্থ সাহায্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের পার্কিংসহ যে কোনো সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
এদিকে ব্রিটেনে করোনা আতঙ্কে জনগন অতিরিক্ত কেনাকাটা করলে করোনায় আক্রান্ত মানুষদের সেবায় যারা নিয়োজিত তারা কেনা কাটায় হিমসিম খাচ্ছিলো। তাদের কথা চিন্তা করে ব্রিটেনের বিভিন্ন সুপারস্টোরগুলো বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে এনএইচএসের কর্মীদের জন্য। সুপারস্টোরগুলো ঘোষণা দিয়েছে সপ্তাহের ৩ বা ৪ দিন নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ থাকবে শুধুমাত্র এনএইচএসের কর্মী ও বয়স্কদের জন্য। একইসাথে ওই কর্মীদের জন্য পেট্রোল পাম্পেও তাদের জন্য অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
করোনা মহামারীতে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষের সেবায় এগিয়ে এসে হাজার হাজার মানুষকে সুস্থ করে তোলায় এনএইচএসের কর্মীদের বিশেষ সম্মাননার ব্যবস্থা করেছে সরকার। এক ঘোষণায় ব্রিটেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় জনগণকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, ২৬ মার্চ বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় সবাই তাদের বাড়ির ও ফ্ল্যাট থেকে তালি বাজিয়ে এনএইচএসের কর্মী ও স্বাাস্থসেবা পেশায় নিয়োজিতদের সম্মাননা জানাবে। জনগণকে উদ্দেশ করে এনএইচএস জানিয়েছে, সবাই তাদের সুবিধা মতো নিজ নিজ বাসা ও বাড়ির দরজার সামনে থেকে, বাগান থেকে, বারান্দা থেকে, জানালা থেকে এমনকি বেড রুম থেকে ঠিক ৮টায় তালি বাজিয়ে অভিবাদন জানাবে। ডাক্তার, নার্স , জেনারেল প্রেকটিশনার ( জিপি), প্যারা মেডিকস, সোশ্যাল কেয়ারার ও জরুরি সেবায় নিয়োজিত কর্মীরা এই সঙ্কটময় মুহুর্তে কঠোর পরিশ্রম করছে একইসাথে করোনভাইরাসের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে।
সাহসী ও আত্মনিবেদিত মানবসেবীদের বিশেষ মূল্যায়নে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ক্ল্যাপ ফর কেয়ারার’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে বিশেষ প্রচারণা চালিয়েছিল এনএইচএস। এনএইচএসের কর্মীদের সম্মাননা জানানোর আয়োজক কর্তৃপক্ষ বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় বিশেষ বিশেষ স্থাপনায় নীল রংয়ের আলোকসজ্জা করার ব্যবস্থা করেন। এরই অংশ হিসেবে রাজধানী লন্ডনের উইম্বেলী আর্চ, প্রিন্সিপিলাটি স্টেডিয়াম, দ্যা রয়েল আলবার্ট হল, লিংকন ক্যাথাড্রাল চার্চে নীল আলোকসজ্জা করা হয়। এছাড়া লন্ডনের বাইরে বিভিন্ন শহরেও এনএইচএসের কর্মীদের প্রশংসা করে বিভিন্ন স্থাপনায় নীল আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়।
সরকারের এই উদ্যোগে সমর্থন জানিয়ে সম্মাননা অনুষ্ঠানের প্রচারনা চালিয়েছে লন্ডন মেয়র সাদিক খান, গ্রীন পার্টির এমপি কেরোলিন লুকাসসহ বিরোধী অনেক রাজনীতিবীদ। তারাও গতকাল রাত ৮টায় নিজ নিজ বাসস্থান থেকে এনএইচএসের কর্মী ও জরুরি সেবায় নিয়োজিত কর্মীদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে হাততালি দিয়ে সম্মাননা জানান।
এনএইচএসের কর্মীদের বিশেষ সম্মাননার সাথে তাদের জনগণকে সেবা দেয়ার জন্য বিশেষ জীবাণু প্রতিরোধী পোষাকের ব্যবস্থা করা হয়। এই বিশেষ পোষাকের মধ্যে রয়েছে, চোখের সুরক্ষার জন্য ফুল ফেইস গগলস, সারাশরীর আবৃত বিশেষ গাউন, মাস্ক ও হাতের গ্লাভস।
এদিকে বাংলাদেশ অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস বারায় পার্কিং এনফোর্সমেন্ট টিম বারার রাস্তাগুলি সুরক্ষিত, প্রতিবন্ধকতামুক্ত এবং হাইওয়ে গুলো ইমার্জেন্সি সার্ভিসের ব্যবহারের জন্য পরিষ্কার রাখতে টাওয়ার হ্যামলেট জুড়ে কাজ করে যাচ্ছে। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা রয়েছে।
অনেক ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার, এনএইচএস কর্মী ও অন্যান্য কি-ওয়ার্কাররা এখন গাড়িতে করে চলাচল করছে এবং সামনের সপ্তাহগুলিতে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের উপর কম নির্ভর করতে হতে পারে। তাই সিলেক্টেড কি-ওয়ার্কারদের কাউন্সিল বিশেষ পারমিট প্রদান করেছে। হাসপাতাল ও জিপি সার্জারি আশেপাশের রাস্তায় জরুরি স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পার্কিং স্পেস রাখতে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
কাউন্সিল কি-ওয়ার্কারদের গাড়ি ব্যবহার এবং এরপর বাড়ি ফিরে পার্কিংয়ের সহজ করার জন্য রেসিডেনসিয়াল পার্কিং অঞ্চলে পার্কিং বিধি-নিষেধ শিথিল করেছে। এখন থেকে যে বাসিন্দা নিয়ন্ত্রিত পার্কিং মিনি-জোনে বাস করেন, তারা রেসিডেন্ট পার্কিং বে, কেবল আবাসিক উপায়ে, শেয়ার্ড ইউজ বে, বিজনেস পারমিট এবং পে অ্যান্ড ডিসপ্লেতে পার্ক করতে পারবেন। কোনো কারনে জরিমানার টিকেট ইস্যু হলে ঠিকানার প্রমাণসহ আবেদন করলে জরিমানা বাতিল করা হবে। তাছাড়া পাশের ওয়াপিং বাস গেটে সাময়িকভাবে নিষেধাজ্ঞাগুলি তুলে নেয়া হয়েছে। কাউন্সিল বলেছে একেবারে প্রয়োজনীয় না হলে নাগরিকদের বাসায় অবস্থান করতে। জাতীয় পরামর্শের সাথে মিল রেখে এই পরিবর্তনগুলি তিন সপ্তাহ পরে পর্যালোচনা করা হবে।।
এদিকে এখন পর্যন্ত কি-ওয়ার্কারদের জন্য এক হাজারেরও বেশি পারমিট প্রদান করা হয়েছে। এব্যাপারে কি-ওয়ার্কারদের তাদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।