মার্কিন-তালেবান চুক্তি আফগান বন্দীদের জন্য আশা জাগিয়েছে
আফগানিস্তানের নানগারহার প্রদেশে ২০১৬ সালের মার্চের এক ঠাণ্ডা রাতে তালেবান যোদ্ধারা জান মোহাম্মদের [নিরাপত্তার জন্য নাম বদলে দেয়া হয়েছে] বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘন্টা পরেই সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী হানা দেয় এবং মোহাম্মদকে তুলে নিয়ে যায়।
আগের রাতে তালেবান যোদ্ধারা আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে এক লড়াই থেকে পালিয়ে এসে জোর করে শেরজাদ জেলায় মোহাম্মদের বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাদের কাছে খাবার ও পানি দাবি করে।
ওই রাতটি মোহাম্মদের জীবন পুরোপুরি পাল্টে দেয়। ওই দিনটির কথা স্মরণ করে তিন বলেন, “আমরা তালেবান যোদ্ধাদের থামাতে পারিনি। কিভাবে আমরা সেটা করবো? বন্দুকধারীদের বিরুদ্ধে আমরা ছিলাম পুরোপুরি অসহায়”।
তালেবানদের সহায়তা করার অভিযোগে মোহাম্মদকে গ্রেফতার করা হয়। এ অভিযোগ তিনি অস্বীকার করে আসছেন।
তালেবানদের সাহায্য করার কারণে মোহাম্মদকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। কারাগার থেকে তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “আমাকে যখন বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনা হয়, তখন আমাদের ছেলেমেয়েরা যেভাবে কেঁদেছিল, সেটা আমি ভুলতে পারি না। আমার মেয়ে বলেছিল, ‘দয়া করে আমাকে মেরে ফেলেন আর আমার বাবাকে ছেড়ে দেন’”।
কুখ্যাত পুল-ই-চাকরি কারাগারে তাকে আটকে রাখা হয়। কাবুলের বাইরের উচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত এই কারাগারটি সেখানকার অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনার জন্য পরিচিত। এই কারাগারে সহিংসতা ও নির্যাতনের ইতিহাস রয়েছে। সত্তর ও আশির দশকে এখানে কাবুলে সোভিয়েত মদদপুষ্ট সরকারের সময়ে এখানে গণকবরের সন্ধানও পাওয়া গিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, সেই চুক্তি অনুযায়ী যে ৫,০০০ জনকে ছেড়ে দেয়ার কথা, তাদের মধ্যে মোহাম্মদের নামও রয়েছে।
কাতারের রাজধানী দোহাতে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তাদের সেনাদের একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে নেবে। বিনিময়ে তালেবান গ্রুপ নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেবে। এছাড়া দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আফগান-অভ্যন্তরীণ আলোচনায় বসার ব্যাপারেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তালেবানরা।
বন্দী চুক্তির বিষয়টি কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে কারণ কাবুলের পশ্চিমা-সমর্থিত সরকার বলেছে যে, তারা বিভিন্ন কিস্তিতে বন্দীদেরকে মুক্তি দেবে। তালেবানরা এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে।
আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি বলেছে, সরকার প্রথম ধাপে ১,৫০০ বন্দীকে মুক্তি দেবে এবং বন্দীদেরকে এই প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, তারা আবার লড়াইয়ে ফিরে যাবে না।
তালেবানরা অবশ্য বলেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী ঘানিকে ৫,০০০ বন্দীর সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে এবং কোন শর্ত ছাড়াই তাদেরকে মুক্তি দিতে হবে।
‘ভাঙ্গা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও খুলি’
৫,০০০ বন্দীর তালিকাটা আল জাজিরা দেখেছে। এখানে মুসলিম আফগানদের নাম রয়েছে যারা ১৫ বছর ধরে পুল-ই-চারখি কারাগারে বন্দি রয়েছে। ‘বিস্ফোরক বহনের’ দায়ে তাদেরকে আটক করা হয়েছে।
কাবুলের সালাম ইউনিভার্সিটি থেকে ২০১৫ সালে আফগানকে গ্রেফতার করা হয়। সেখানে তিনি আইন নিয়ে লেখাপড়া করছিলেন। কাস্টডিতে তার উপর নির্যাতন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
আফগান আল জাজিরাকে বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদের সময়, আমার পায়ের আঙ্গুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়। প্রতিদিন আমাকে বিদ্যুতের শক দেয়া হয়েছে। শীতের সময় আমাকে ঠাণ্ডা পানির মধ্যে ১০ মিনিট থেকে আধা ঘন্টা পর্যন্ত চুবিয়ে রাখা হতো। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম। আমার যখন জ্ঞান ফিরতো, আমি বুঝতে পারতাম আমাকে ভূগর্ভস্থ বেজমেন্টের ঠাণ্ডা হাড় কাঁপানো জায়গায় একটা পাতলা কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে”।
“কাবুলের ঠাণ্ডা আর তীব্র শীতের মধ্যে, কারাগারের মধ্যে আমাকে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হতো। আমার হাত বাঁধা থাকতো এবং আমি একটি নড়লে বা ঘুম আসলে আমাকে লাথি বা ঘুষি দিয়ে জাগিয়ে দেয়া হতো। পরদিন সকাল পর্যন্ত এই অবস্থা চলতো”।
“তারা অব্যাহতভাবে আমার উপর নির্যাতন করে গেছে কারণ আমি কোন কিছু স্বীকার করিনি। স্বীকার করিনি, কারণ আমার স্বীকার করার কিছুই ছিল না!”
আফগান সরকার ও পুলিশের সূত্র পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে আল জাজিরাকে বলেছেন, আফগানের চাচা হাক্কানি নেটওয়ার্কের অংশ। তালেবানদের সহযোগী এই সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়েছে ওয়াশিংটন।
আফগান স্বীকার করেছে যে, তার চাচা হাক্কানি নেটওয়ার্কের অংশ। কিন্তু তাকে আর তার পরিবারের যে ১৮ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের সাথে তার চাচার এ ক্ষেত্রে কোন যোগাযোগ নেই। পরিবারের অন্য সদস্যদেরকে ৩-৪ দিন আটক রাখার পর ছেড়ে দেয়া হয়।
অনিষ্পন্ন বিবাদ
ঘানি ও আব্দুল্লাহকে তাদের রাজনৈতিক বিবাদ মেটানোর ব্যপারে রাজি করাতে ব্যার্থ হওয়ার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও সোমবার ঘোষণা দিয়েছেন যে, আফগানিস্তান যে সব সহায়তা পেতো, সেখানে থেকে এক বিলিয়ন ডলারের সহায়তা কাটছাটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
বুধবার আফগান সরকার বলেছিল যে তারা বন্দীদের মুক্তির বিষয়টি আলোচনার জন্য তালেবান প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করবে।
ঘানি-আব্দুল্লাহর বিবাদ যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে এটা সরকারকে আরও দুর্বল করবে এবং তালেবানদের সাথে আফগান-অভ্যন্তরীণ সংলাপের সম্ভাবনা নষ্ট করে দেবে।
গত সপ্তাহে মার্কিন বিশেষ প্রতিনিধি জালমাই খলিলজাদ বলেছেন যে, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বন্দী মুক্তি দেয়ার বিষয়টি আরও জরুরি হয়ে গেছে। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যাতে যত দ্রুত সম্ভব বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়।
আফগান সরকারের কর্মকর্তাদের সাথে বৃহস্পতিবার বৈঠকের পর তালেবানরা জানিয়েছে যে, ৩১ মার্চ বন্দীদের মুক্তি দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
পুল-ই-চারখি কারাগারে বন্দি মোহাম্মদ বলেছেন তিনি সবসময় দোয়া করছেন যে, শিগগিরই পরিবারের সদস্যদের সাথে মিলিত হতে পারবেন তিনি।
তিনি বলেন, “আমি আশি করি আল্লাহ আমার দোয়া শুনবেন এবং আফগানিস্তানে শান্তি ফিরে আসবে”।
“হাঁ, কারাগারে তালেবান যোদ্ধারাও আছে, যারা গর্বের সাথে প্রকাশ করে যে তারা তালেবানদের সাথে জড়িত। তবে আমার মতো নিরপরাধ মানুষরাও এখানে রয়েছে, যাদের মুক্তি পাওয়া দরকার”।