মাস্কের বদলে অস্ত্র: করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির মধ্যেই ইসরাইল থেকে অস্ত্র কিনছে ভারত
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে করোনাভাইরাস সঙ্কট সামাল দিচ্ছেন, তার সমালোচনা করেছেন অ্যাক্টিভিস্ট আর অধিকার গ্রুপগুলো। ইসরাইলের সাথে করা কয়েক শ’ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি বলবৎ থাকার খবর প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে তারা সোচ্চার হয়েছেন।
ভারত সরকারের প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, দেশটির ১.৩ বিলিয়ন লোক ক্রমবর্ধমান হারে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে ইসরাইল ১৬,৪৭৯টি নেগেভ লাইট মেশিন গান দেবে। এসব অস্ত্রের মূল্য হবে ১১৬ মিলিয়ন ডলার।
অথচ করোনাভাইরাস মোকাবিলায় হিমশিম খেতে থাকা ভারতের চিকিৎসকেরা মাস্ক ও সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের স্বল্পতা নিয়ে অভিযোগ করে যাচ্ছেন। আর তাতে ফুটে ওঠেছে যে এ ধরনের সঙ্কট মোকাবিলায় ভারতের প্রস্তুতি পর্যাপ্ত নয়।
কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, ভারতে কোভিড-১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা ৪৬৯, মারা গেছে ১০ জন। তবে আরো কয়েকটি দেশের মতো, ভারতেও পরীক্ষা করা হয়েছে খুব কম এবং সংক্রমণ বাড়ছে।
সোমবার ভারতের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের ৫৫ ভাগ লোক তথা প্রায় ৭১৫ মিলিয়ন মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। আর রক্ষণশীল হিসাবে মে মাস নাগাদ ভারতে প্রায় ৩০ হাজার লোক মারা যাবে।
মহামারিটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকায় বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ভারতের অর্থনীতিও সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে। ফলে এই পর্যায়ে অস্ত্র আমদানির ব্যয় অর্থনীতির ওপর যে চাপ সৃষ্টি করবে, তা সামাল দেয়া কঠিন হবে।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিশ্বরাজনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অচিন বনিক বলেন, সরকার ভালো মতোই জানে যে সরকারি যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে, তাতে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম দেখানো হয়েছে। এই পর্যায়ে অস্ত্র ক্রয় তাই নজিরবিহীন ও মারাত্মক নিন্দনীয়।
তিনি মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ভারতের এখন প্রতিটি রুপি ব্যয় করা উচিত করোনাভাইরাসের সত্যিকারের বিপদ মোকাবিলায়। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, এমনকি চীন ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতের চিকিৎসাব্যবস্থা অনেক নাজুক। এখানে জরুরিভিত্তিতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এখন তহবিল অন্য খাতে ব্যয় করা কঠিন বিষয়।
লোকরঞ্জন
বৃহস্পতিবার সই করা অস্ত্র চুক্তিটি ছিল ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে করা ডিফেন্স অ্যাকুইজিশন কাউন্সিলের অনুমোদনপ্রাপ্ত। এটি ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অধীনে দুই দেশের মধ্যকার কয়েকটি অস্ত্র চুক্তির অংশবিশেষ।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, এসব অস্ত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রণাঙ্গনে থাকা সৈন্যদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে এসব অস্ত্র খুবই কার্যকর হবে।
তবে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অপূর্বানন্দ বলেন, একটি সঙ্কটের সময় অস্ত্র ক্রয়কে অগ্রাধিকার দেয়াটা আসলে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের ভারতকে ইসরাইলের মতো সামরিক রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস।
তিনি বলেন, তথাকথিত সামরিক রাষ্ট্রের অস্ত্রই আসল কথা। তারা শত্রুদের উস্কানি দিতে থাকে। আর তারা জনসাধারণকে বিশেষ করে হিন্দুদেরকে মোহগ্রস্তে পরিণত করছে।
তিনি বলেন, এই সঙ্কট সমাধানে সরকারের কাছে করার কিছুই নেই। আমাদের চিকিৎসকদের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম নেই। আমরা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা করতে পারছি না।
তিনি বলেন, অথচ মোদি ভারতকে লোকরঞ্জক পথে নিয়ে যাচ্ছেন। জনগণকে তিনি কেবল এটিই দিতে পারেন।
কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিার নেতা কিবতা কৃষ্ণানও একইভাবে বলেন যে সরকার করোনাভাইরাসের কারণে জীবিকা হারানো লোকজনের জন্য সহায়তা প্যাকেজের কথা ঘোষণা করতে পারত। তা না করে তারা সামরিক ক্রয়ে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে।
তিনি বলেন, চাকরি হারিয়ে লোকজন বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে গ্রামে ছুটছে। এতে করে ভাইরাস বিস্তারের ঝুঁকি আরো বাড়ছে।
কাশ্মিরে যোগাযোগ অবরোধ
করোনা বিপর্যয়ের মধ্যেও ভারত সরকার কাশ্মিরে অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। সেখানে এখনো ট্রেন ও বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে দিল্লি জানিয়েছে, তারা গরিবদের জন্য রেশন বাড়াচ্ছে।
ভ্রান্ত শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত ও ইসরাইল তাদের সম্পর্ক জোরদার করেছে। বিশেষ করে মোদি ও নেতানিয়াহুর অধীনে তা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আর অস্ত্র বাণিজ্যের মাধ্যমেই তা তারা করে যাচ্ছে।
ভারত হলো ইসরাইলের বৃহত্তম সামরিক সরঞ্জামের ক্রেতা। ইসরাইলের অস্ত্র রফতানির ৪৬ ভাগ হয় ভারতে।
অপূর্বানন্দ বলেন, আমাদের জাতীয় সম্পদ ব্যয় হওয়া উচিত কোভিড-১৯ হুমকি মোকাবিলায়, ভ্যাকসিন উন্নয়ন ও পরীক্ষায়। কিন্তু ভারত এ নিয়ে চিন্তা পর্যন্ত করছে না। তারত কেবল প্রতিরক্ষায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের ভ্রান্ত দিকে নজর দিচ্ছে। আর তা করার জন্য অস্ত্রের ভাণ্ডার বাড়াচ্ছে।