শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে আইন প্রণয়নের দাবি
শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশ ও কল্যাণ নিশ্চিতে সবক্ষেত্রে শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে যথাযথ উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানিয়েছে চাইল্ডস রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ।
মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) শিশুদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বিলোপ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে এ আহ্বান জানায় সংগঠনটি।
সংগঠনটি থেকে জানানো হয়, যে কোনো মাত্রার শারীরিক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শিশুকে ভীতি প্রদর্শন, আঘাত করা, নিষ্ঠুর ও অবমাননাকর আচরণ শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে এবং শিশুর মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। সব শিশুরই সহিংসতামুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশে বেড়ে ওঠার অধিকার রয়েছে। তাই চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ ও কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশনার কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিতের আহ্বান জানাচ্ছে। এ ধরনের শাস্তি বন্ধে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন এবং পরিবারসহ সব প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে সচেতনতা বাড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসেই ১৮৬ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ১২ জন শিক্ষক কর্তৃক নির্যাতনের শিকার ও ১৬ জন শিক্ষক কর্তৃক যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ২০২৩ সালে মোট এক হাজার ১৩ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এছাড়া, এমন অসংখ্য ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যায়। বিশেষত, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুদের মানসিক নিগ্রহের শিকার হওয়ার বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। উপরন্তু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও পারিবারিক বা সামাজিক পর্যায়ে অথবা ভিন্ন ধরনের কাঠামোতে যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক ব্যবস্থাপনা, দিবাযত্ন কেন্দ্র, কোচিং সেন্টার ইত্যাদি পর্যায়েও শিশুদের নানান ধরনের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদানের ও তাদের সঙ্গে অবমাননাকর আচরণের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নজির খুবই কম। শিশুদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশ ও শিক্ষাকে প্রভাবিত করে। তাদের মধ্যে পরিবার ও সমাজের প্রতি অনাস্থা তৈরি করে।
শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের ক্রমবর্ধমান শারীরিক নির্যাতন এবং তা প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষের ক্রমাগত ব্যর্থতাকে চ্যালেঞ্জ করে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড ও সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) রিট দায়ের করে। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের জুলাই মাসে উচ্চ আদালত শিক্ষাপ্রতিস্থানে সব ধরনের শারীরিক শাস্তি অসাংবিধানিক ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘোষণা করে রায় দেন। এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১১ ধরনের শারীরিক ও দুই ধরনের মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করতে ২০১১ সালে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে পরিসংখ্যান বলছে পরিপত্র জারির পরও শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না।
সংস্থাটি জানায়, শিশুদের সুরক্ষা প্রদান, তাদের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সবক্ষেত্রে শাস্তি বিলোপ করে আইন প্রণয়ন জরুরি। প্রচলিত আইনের যেসব ধারা শিশুদের শাস্তি দেওয়া সমর্থন করে (যেমন দণ্ডবিধির ৮৯ ধারা) তা পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ওই সনদের অনুচ্ছেদ ১৯ (শিশুর প্রতি আচরণ) অনুযায়ী, পিতামাতা, আইনানুগ অভিভাবক বা শিশু পরিচর্যায় নিয়োজিত অন্য কোনো ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় শিশুকে আঘাত বা অত্যাচার, অবহেলা বা অমনোযোগী আচরণ, দুর্ব্যবহার বা শোষণ এবং যৌন নির্যাতনসহ সব রকমের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য যথাযথ আইনানুগ, প্রশাসনিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রের। এছাড়া, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের ১৬.২ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে শিশুদের অবমাননা, শোষণ, পাচারসহ সব ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধ করা।