অল্প টাকা ঋণ নিয়ে মামলায় জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন নিরীহ জেলে ও কৃষকরা
অল্প টাকা ঋণ নিয়ে মামলায় জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন নিরীহ জেলে ও কৃষকরা। ঋণ পরিশোধে একটু দেরি হলেই কপালে জুটছে সার্টিফিকেট মামলা এবং হয়রানি। সারাদেশে সার্টিফিকেট মামলা এখন ১ লাখ ২৬ হাজার ১১৯টি।
এসব মামলায় অভিযুক্তরা জনপ্রতি গড়ে ঋণ নিয়েছেন ৩০ হাজার টাকা। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন কেউ কেউ। সার্টিফিকেট মামলায় অভিযুক্ত সোয়া ১ লাখ মানুষের মধ্যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে ১১ হাজার ৭৭২ জনের নামে। অনেকে অর্থ পরিশোধ করতে না পেরে গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
কৃষিঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ কৃষকদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা না করতে ব্যাংকগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে নানা সময়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো সমঝোতার ভিত্তিতে প্রত্যাহার করে কৃষকদের হয়রানি বন্ধ করতেও বলা হয়। জেলা প্রশাসক সম্মেলনে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বলে দেওয়া হয়, কৃষক ও মৎস্যজীবীদের হয়রানি করা যাবে না। তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। সারাদেশে সার্টিফিকেট মামলায় সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা আসল টাকা পরিশোধ করলেও অতিরিক্ত সুদের জালে ফেঁসে যাচ্ছেন। কেউ কেউ ব্যাংকের দায় পরিশোধ করতে নতুন করে এনজিওর ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন।
অডিট আপত্তি থেকে বাঁচতে অনেক সাধারণ মানুষের নামে সার্টিফিকেট মামলা করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। অনেক কৃষক ঋণ পরিশোধ করেছেন এবং অনেক গ্রাহক আসলের বেশি টাকাও পরিশোধ করেছেন। তার পরও সার্টিফিকেট শাখা থেকে হয়রানি করা হচ্ছে। অনেক গ্রাহক আসল টাকা পরিশোধ করে ব্যাংক চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেন। তবে সেসব আবেদন ব্যাংকে পড়ে থাকছে বছরের পর বছর।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ১৫ বছরের বেশি সময় ঝুলে থাকা সব সার্টিফিকেট মামলা দ্রুত নিষ্পন্ন করতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি বিভাগীয় কমিশনার সমন্বয় সভার সভাপতি মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন ওই নির্দেশনা দেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওই সভার কার্যপত্রে বলা হয়, সারাদেশে কৃষক-জেলেদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ২৬ হাজার ১১৯টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১ হাজার ৯৬২টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। এই সংখ্যা গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় ১১৫টি কম। কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষকে হয়রানি না করে মামলা নিয়ে সমঝোতা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঝিনাইদহে ৮৩৫ কৃষকের নামে মামলা
খেলাপি ঋণের ভারে দেশের কোনো কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হলেও অল্প টাকার ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। হাজার বা শতকোটি টাকার ঋণখেলাপিরা যখন অধরা, তখন ঝিনাইদহে অনেক কৃষকের নামে ঝুলছে সার্টিফিকেট মামলার খড়্গ। ঝিনাইদহ জেনারেল সার্টিফিকেট শাখা সূত্রে জানা গেছে, গত মার্চ পর্যন্ত ৬ উপজেলার ৮৩৫ জন কৃষকের নামে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ঝিনাইদহ জেনারেল সার্টিফিকেট আদালতে ৪ কোটি ১৩ লাখ টাকার বিপরীতে কৃষকের নামে ১৪৯টি, সদর উপজেলা সার্টিফিকেট আদালতে ২৬ লাখ ৯৩ হাজার টাকার বিপরীতে ১১৪টি, শৈলকুপায় ৬২ লাখ ২৫ হাজার টাকার বিপরীতে ১০৩টি, হরিণাকুণ্ডুতে ২৯ লাখ ৪৩ হাজার টাকার বিপরীতে ২৬টি, কালীগঞ্জে ৯৮ লাখ ১৬ হাজার টাকার বিপরীতে ১৭৫টি, কোটচাঁদপুরে ৩৭ লাখ ৭৯ হাজার টাকার বিপরীতে ১১টি ও মহেশপুর সার্টিফিকেট আদালতে ২৬ লাখ ৭ হাজার টাকার বিপরীতে ২৭৫টি মামলা হয়েছে। এই কৃষকদের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা ৬ কোটি ৯৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। মার্চ পর্যন্ত আটটি মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে ৯৯ হাজার ২৭০ টাকা আদায় করা হয়েছে। এ ছাড়া ১১টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। ঝিনাইদহ জেনারেল সার্টিফিকেট আদালতে কৃষি ব্যাংক ৩ কোটি ৩২ লাখ টাকার জন্য ৩৮৮ জন কৃষকের নামে মামলা দিয়েছে। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংক ৪৩ লাখ ৪৮ হাজার টাকার জন্য ৮টি, জনতা ব্যাংক ২৮ লাখ ১৩ হাজার টাকার জন্য ৪০টি, অগ্রণী ব্যাংক ৫৮ লাখ ৮০ হাজার টাকার জন্য ৮১টি, কর্মসংস্থান ব্যাংক ২৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকার জন্য ২৮টি, ন্যাশনাল ব্যাংক ১৩ লাখ ৮০ হাজার টাকার জন্য ১০টি, বিআরডিবি ৮৮ লাখ ৫ হাজার টাকার জন্য ৯১টি, পল্লী বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ৬৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকার জন্য ১৮২টি মামলা করেছে। এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ জেনারেল সার্টিফিকেট অফিসার নওসীনা আরিফের বক্তব্য জানতে চাইলে কথা বলতে চাননি তিনি।
ঝিনাইদহের মানবাধিকারকর্মী অধ্যক্ষ আমিনুর রহমান টুকু বলেন, মামলাগুলো সমাধান হচ্ছে না। মামলা দেখে কৃষকরা ভয় পান। কৃষকরাই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। কৃষি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে বের করতে হবে।
একের পর এক নির্দেশনায়ও পাল্টায় না চিত্র
কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা না করে ঋণের বিষয় নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংককেও বিষয়টি জানানো হয়েছে। কৃষিঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ কৃষকদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা না করতে ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানা যায়। এর আগে যেসব মামলা হয়েছে, তা পুনঃতপশিল করে কৃষকদের মামলা থেকে রেহাই দেওয়ারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে একের পর এক নির্দেশনা দেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন নেই।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কৃষিঋণ তামাদি হলে ব্যাংককে সার্টিফিকেট মামলা করতে হয়। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছি, এটি চলতে পারে না। প্রয়োজন হলে ঋণ পুনঃতপশিল করে মামলার হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি যেসব মামলা হয়েছে, তা সমঝোতার ভিত্তিতে প্রত্যাহার করে কৃষকদের হয়রানি বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ এই কর্মকর্তা জানান, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে যেসব এলাকার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের ঋণ পুনঃতপশিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বেশি মামলা করেছে কৃষি ব্যাংক
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে কৃষি ব্যাংক। কৃষকদের বিরুদ্ধে করা ব্যাংকটির মামলা ৫৬ হাজার ৮০০। দাবি করা অর্থের পরিমাণ ২১৯ কোটি টাকা। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মামলা ১৭ হাজার ৫৯৮। অনাদায়ী টাকা প্রায় ১০৩ কোটি। সোনালী ব্যাংকের পাওনা ৩৯ কোটি টাকা; এর বিপরীতে মামলা ১০ হাজার ২৮৪টি। রূপালী ব্যাংক মামলা করেছে ২ হাজার ৫৫০টি। তাদের দাবি করা টাকা ৫ কোটি।
‘কৃষককে হয়রানি অনৈতিক ও বৈষম্যমূলক’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাঘববোয়াল ঋণখেলাপির কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো প্রায় খাদের কিনারে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না, অথচ গরিব কৃষককে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। কৃষকদের ঋণ গভীর সমুদ্রে এক ফোঁটা পানির মতো। অর্থাৎ এতই সামান্য, যা বড়দের তুলনায় শতাংশেও আসবে না। এটা অগ্রহণযোগ্য, অনৈতিক ও বৈষম্যমূলক।’
-সমকাল