বড়দিন মানেই কেক, ক্রিসমাস ট্রি, সান্টাক্লোসের উপহার
বড়দিন মানেই কেক, ক্রিসমাস ট্রি, সান্টাক্লোসের উপহার। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ঘটা করে পালন করা হয় এই দিবস। পাশ্চাত্য দেশ সহ সব শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে ছোট-বড় রেস্তরাঁ কিংবা ক্যাফে, শপিং মল সবই সেজে উঠেছে বড়দিনের জন্য। কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই শুরু হয়েছে বড়দিনের উৎসবের আমেজ।
বড়দিনের আয়োজনে অনেক বড় একটি অংশ জুড়ে আছে কেক। নানান রকম কেকের বাহার থাকে বড়দিনের আয়োজন ঘিরে। কেউ পছন্দ করেন ফ্রুট কেক, কেউবা ভ্যানিলা বা চকলেটের স্বাদের। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও এর কমতি নেই। এবার ঢাকায় তৈরি হলো ১৬ ফুট উঁচু বড়দিনের কেক। বিশাল আকৃতির কেকটি বানানো হয়েছে ক্রিসমাস ট্রির আদলে। যার ওজন ১ হাজার ৮০০ পাউন্ড। কেকটি মোট ১৩টি স্তরে সাজানো হয়েছে।
জানেন কি, ভারতবর্ষে কখন শুরু হয়েছিল কেক কাটার প্রচলন। সময়টা ১৮৮৩ সাল। মারডক ব্রাউন নামে ব্রিটেনের এক ব্যবসায়ী দক্ষিণ ভারতে এসেছিলেন। বড়দিন আসন্ন। কিন্তু মারডক নিজের দেশ থেকে শত শত মাইল দূরে। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চিন্তাভাবনা করেন তিনি। বড়দিন উপলক্ষে কেক খাবেন বলে স্থির করেন মারডক। কিন্তু ভারতে তখন কেকের প্রচলন হয়নি। তাই ফ্যাক্টরি বা কারখানা পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। চলে গেলেন কেরালার এক বিস্কুট তৈরির কারখানায়।
সেই বিস্কুট তৈরির কারখানার মালিকানা ছিলেন মামবালি বাপু। তার কাছেই মারডক বড়দিনের জন্য কেক বানিয়ে দেওয়ার আবদার করেন। তবে বাপু কেক কীভাবে বানাতে হয় তার কিছুই জানেন না। সেই সমস্যার সমাধান করেন মারডক নিজেই। দক্ষিণ ভারতে মালাবার উপকূলে স্কট নামের এক জন দারুচিনি ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্রিটেনে তার যাওয়া-আসা ছিল। মারডক কেক খেতে চেয়েছেন শুনে ব্রিটেন থেকে একটি কেক আনিয়ে ফেললেন স্কট। তারপর সেই কেক নিয়ে গেলেন বাপুর কাছে।
কেক কীভাবে তৈরি করা হয় তা বাপুকে শেখালেন স্কট। মনে ভয় থাকলেও ব্রাউন সাহেবের নির্দেশ অনুযায়ী কেক বানানো শুরু করলেন বাপু। মারডক তাকে জানিয়েছিলেন, কেক তৈরির সময় সামান্য ব্র্যান্ডি ব্যবহার করলে কেকের স্বাদ বাড়ে। নিকটবর্তী ফরাসি এলাকা মাহে থেকে ব্র্যান্ডি আনাতেও বলেছিলেন মারডক। কিন্তু তার পরিবর্তে কাজু এবং আপেলের একটি মিশ্রণ দিয়ে কেক বানিয়ে ফেললেন বাপু।
দেশীয় উপকরণ দিয়েই সম্পূর্ণ কেকটি বানিয়ে ফেলেন বাপু। স্বাদে আলাদা হওয়ায় তা মারডকের পছন্দ হবে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি। তবে ঘটে অন্য ঘটনা, মারডক এই অভিনব পদ্ধতিতে বানানো কেক খেয়ে শুধু যে মুগ্ধ হয়ে যান তা-ই নয়, এমন আরও এক ডজন কেক বানানোর অর্ডারও দেন।
বাপু নতুন ধরনের এই কেকের নাম রাখলেন ‘প্লাম কেক’। অনেকে দাবি করেন, এটিই বড়দিন উপলক্ষে ভারতে বানানো প্রথম কেক। যদিও এর কোনো লিখিত প্রমাণ নেই। তবে বাপুর বর্তমান বংশধররা দাবি করেন, এই কেক ১৪০ বছর আগে বড়দিন উপলক্ষেই বানিয়ে ছিলেন বাপু। মামবালি বাপুর হাত ধরে যে ইতিহাসের সূত্রপাত হয়েছিল, ১৪০ বছর ধরে সেই ধারাই বয়ে নিয়ে চলেছে পরিবারের বংশধরেরা। এখনো একই পদ্ধতি অনুসরণ করে কেক বানিয়ে যাচ্ছে ওই বেকারির কর্মীরা।
চার প্রজন্ম ধরে প্লাম কেকের সেই জনপ্রিয়তা বজায় রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকাশ। ভারতীয়দের সামনে ব্রিটেনের স্বাদ তুলে ধরেছিলেন বাপু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন হাতে তৈরি কেক এবং মিষ্টি সৈন্যদের জন্য পাঠিয়েছিলেন বাপু। প্রথা অনুযায়ী কেক বানালেও তারা কেকের স্বাদবদলের জন্য নতুন ধরনের ‘ফ্লেভার’ যোগ করেন। এখনও পর্যন্ত ২৪ ধরনের কেক বানিয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছে তাদের বেকারি।
তবে কেকের জন্ম আরও কয়েকশ বছর আগেই। ‘দ্য অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি’ অনুযায়ী, কেক কথাটির খোঁজ পাওয়া যায় ১৩ শতকে। পুঁথিপত্র অনুযায়ী, প্রাচীন নোরস বা স্ক্যান্ডেনেভিয়ান শব্দ ‘কাকা’ থেকেই এসেছে কেক কথাটি। তবে সেই কেকের থেকে আজকের কেক পুরোপুরি আলাদা। তখন কেক ছিল মূলত পাউরুটি। তার স্বাদ মিষ্টি করা হতো মধু দিয়ে। কখনো কখনো থাকত বাদাম, কিসমিস বা অন্যান্য শুকনা ফল। মধ্যযুগে ইউরোপের বেকারিগুলোতে মাঝে মাঝে ফ্রুতকেক ও জিঞ্জারব্রেড বানানো হতো। সেসব কেক কয়েক মাসেও নষ্ট হতো না।
আবার অনেক ইতিহাসবিদ দাবি করেন, প্রাচীন মিশরীয়দের থেকে সর্বপ্রথম কেকের ধারণা পাওয়া যায়। তখনকার কেক কিন্তু মোটেই এখনকার কেকগুলোর মতো ছিল না। শুকনো ফলের বীচি, শুকিয়ে রাখা ফলমূল এবং তখনকার দিনের প্রচলিত ওয়াইনের সংমিশ্রণে তৈরি হত সেগুলো। তবে ইউরোপে জন্মদিনে কেকের প্রচলন নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। অনেকের মতে, প্রথম জন্মদিন উপলক্ষে কেক কাটার প্রচলন শুরু হয় গ্রিক বা রোমানদের থেকে। আবার অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন জন্মদিনে কেকের প্রচলনটা শুরু করেন জার্মানরাই।
সে যাই হোক, মধ্যযুগে জার্মানরাই সর্বপ্রথম লেয়ার্ড কেকের উদ্ভাবন করেন। ইতিহাস বলে, যিশুখ্রীষ্টের জন্মদিনকে কেন্দ্র করেই মূলত জার্মানদের কেক কাটার শুরু। গবেষকগণের মতানুসারে তাই ধরে নেওয়া যায় আসল জন্মদিনের যে কেক, সেটার শুরু হয় জার্মানি থেকেই।
প্রাচীনকালে রোমান ও গ্রিকদের মধ্যে জন্মদিনসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান উদযাপনের প্রধান অনুষঙ্গ ছিল কেক। তারা যে কোনো উৎসব ’প্লাকাস’ নামে গোলাকৃতির সমতল এক প্রকার কেক বানাতো। তখনকার দিনে যেহেতু গ্রিসে এবং রোমে ময়দা, মধু, ফলমূল এবং বিভিন্ন প্রকারের বাদাম ছিল খুব সহজলভ্য, তাই কেকের মূল উপাদানও ছিল সেগুলোই। তবে গ্রিকরা ’স্যাটূরা’ নামে আরও এক ধরনের কেক বানাতো। সেটি চন্দ্রদেবী আর্তেমিসের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত প্রার্থনা অনুষ্ঠানের জন্য। চন্দ্রদেবীকে উৎসর্গ করে তৈরি এই স্যাটূরা কেক ছিল চাঁদের মতোই গোল আকৃতির।
কেকের মধ্যে প্রথম ফিউশন প্রথাটা রোমানদের থেকেই আসে। তারাই প্রথম ময়দা, ফলমূল, বাদাম এবং মধুর বাইরে এসে কেকে যুক্ত করেন চিজ বা পনির। যা থেকে বিবর্তিত হতে হতে আজকে আমাদের চিজকেক। ধীরে ধীরে কেকের উপকরণে যোগ হয়েছে একের পর এক উপয়াদান। যা নানান, স্বাদ ও গন্ধে রসনা মেটাচ্ছে কেক প্রেমীদের।
সূত্র: বিবিসি