হিজাব আমার আত্মরক্ষার বর্ম: পশ্চিমবঙ্গের এক মুসলিম মেয়ের দৃষ্টিভঙ্গি

0

বছর পাঁচেক আগের কথা। আমি তখন ডিএলএড-এর প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। রোজকার মতো সে দিনও হিজাব পরে প্রতিষ্ঠানের মাঠ দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ সামনে এসে পড়েন প্রতিষ্ঠানের এক মহারাজ। প্রথমে বেশ ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। দ্বিধাগ্রস্ত হয়েও মহারাজের সামনে আমি আমার হিজাব খুলিনি। পরে শুনেছিলাম, মহারাজ আমার সম্বন্ধে খোঁজখবর করেছেন। তবে, আমায় কেউ কিছু বলেননি। আমি আগের মতোই বাড়ি থেকে হিজাব পরে প্রতিষ্ঠানে যেতাম। আর ক্লাসরুমে গিয়ে তা খুলে ফেলতাম। পরবর্তী কালে কলেজ এবং আমার বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি সেটাই করি। যা করি, নিজের ইচ্ছায় করি। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, হিজাব পরতে বা না পরতে কেউ কখনো আমাকে জোরও করেনি, বাধাও দেয়নি।

আমি পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রান্তিক গ্রামের মুসলমান পরিবারের মেয়ে। এই হিজাব পরতে আমাকে আমার পরিজন বা এলাকার কেউ-ই কোনো দিন জোর করেননি। কোনো দিন কেউ ধর্মীয় চাপও দেননি। আমি হিজাব বেছে নিয়েছিলাম সম্পূর্ণ আমার নিজের ইচ্ছায়। আমি সারা ক্ষণ হিজাব পরে থাকি না। কোথায় পরব এবং কত ক্ষণ পরব, তা-ও আমি নিজেই ঠিক করে নিই। বাড়ি থেকে যখন বের হই, তখন হিজাব পরি। পুরো রাস্তায় হিজাব পরে থাকি। আর প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আমি হিজাব খুলে রাখি। আমি আমার প্রতিষ্ঠানটিকে একটা নিরাপদ জায়গা মনে করি— বাড়ির মতো। আমি ভরসা করি আমার প্রতিষ্ঠানকে। আমি বিশ্বাস করি যে, সেখানে আমার কোনো বিপদ হবে না। হিজাবকে সাধারণত কড়া ধর্মীয় অনুশাসনের অবগুণ্ঠন বা পিতৃতন্ত্রের পীড়নের চোখে দেখা হয়। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সে কথা হয়তো সত্য। কিন্তু চরম বা একমাত্র সত্য নয়। আজ আমি বা আমার মতো অজস্র মুসলমান মেয়ে হিজাবকে কেবল ধর্মীয় বা নিপীড়নের পোশাক রূপে দেখি না। আমাদের কাছে হিজাব আত্মরক্ষার একটি হাতিয়ার। উল্লেখ করে রাখি যে, আমার মা কিন্তু হিজাব পরেন না।

পৃথিবীতে যেমন বহু হিজাবধারী মুসলমান মেয়ে রয়েছেন, তেমনই হিজাবকে প্রত্যাখ্যানকারীও রয়েছেন। নিজের ধর্ম, নিজের বিশ্বাসকে আমরা প্রত্যেকেই নিজেরা নিজেদের মতো করে নিজেদের জীবনব্যাখ্যায় মিশিয়ে নিয়ে থাকি। প্রতিটি ধর্মের মানুষেরই তার বিশ্বাস মতো, তার পছন্দ মতো ধর্মীয় অনুষঙ্গ মাখা বা যে কোনও পোশাক পরিধানের অধিকার আছে। আর তার সেই অধিকারের সীমাটি ক্ষেত্র বিশেষে পাল্টে যেতে পারে না।

আমার বয়স যখন ১৮-১৯, তখন থেকে আমি হিজাব পরতে শুরু করি। আমার মনে হয়েছিল, হিজাব আমায় রক্ষা করতে পারে। প্রশ্ন করতেই পারেন যে, পোশাক কী করে কাউকে রক্ষা করতে পারে? এর উত্তরে আমি বলব, হিজাব আমাদের চার পাশের দূষণ থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে সহজেই। অন্তত আমার সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে। মুখের মাস্কের মতোই হিজাব আমাদের রাস্তায় যাবতীয় ধুলো থেকে অনেকটাই বাঁচায়। যে সমাজের একটা বড় অংশই পোশাকের সঙ্গে ধর্ষণের সম্বন্ধ খুঁজে পায়, সেই মানুষগুলোর নোংরা চোখগুলোকে বড় বেশি ভয় পাই। পথেঘাটে নিজেকে নিরাপদ মনে হয় না। জানি, হিজাব বা কোনো পোশাকই সম্ভাব্য অপরাধীকে নিরস্ত্র করবে না। তবু হিজাব পরে থাকলে ঘরের বাইরে অন্তত মানসিক ভাবে নিজেদের এক ফোঁটা বেশি সুরক্ষিত বলে মনে হয়। আমাদের এই নিরাপত্তার বোধটিকেও কি রাষ্ট্র কেড়ে নিতে চায়? আমি নাহয় প্রতিষ্ঠানের ভিতরটিকে নিরাপদ বলে মনে করি। কিন্তু, অন্য কেউ যদি তা না করে? পরিচিত সহপাঠীদের হাতেই যাদের হেনস্থা হতে হয়, প্রতিষ্ঠানের বাইরে বা ভিতরে— কোনও স্থানই কি তারা নিজেদের আর নিরাপদ বলে মনে করবে?

হিজাব নিয়ে এই বিতর্ক আসলে অনর্থক। আমি হিজাবকে আমার আত্মরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে দেখি। আর কেউ হয়তো তাকে ধর্মীয় অধিকার রূপে দেখে। কেউবা ব্যক্তিসত্তার প্রকাশ। যার যেমন দৃষ্টিভঙ্গি। কোনও নির্দিষ্ট একটিই দৃষ্টিভঙ্গি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। কেউ চাইলে পরুন, কেউ না চাইলে পরবেন না। কোনও পোশাক জোর করে পরানো আর জোর করে খুলে নেয়া— দু’টিই সমান অনৈতিক। আমরা কী পরব, আমরা কী খাব, আমরা কী করব, তা বরং মেয়েদেরই ভাবতে দিন।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com