যে কারণে রাশিয়াকে ভয় পাচ্ছে ন্যাটো
রাশিয়ার আগ্রাসন মোকাবেলায় ইউক্রেনকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহে ঠিক কতদূর পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলো সপ্তাহে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে বৈঠক করেছেন ন্যাটো সামরিক জোটের নেতারা। রাশিয়ার বিরুদ্ধে সংঘাতে না জড়িয়ে কীভাবে মিত্ররাষ্ট্র ইউক্রেনকে সর্বোচ্চ সামরিক সহায়তা দেওয়া যায়, সেটিই এখন চলমান সংকটে ন্যাটোর প্রধান চ্যালেঞ্জ। যদিও ইউক্রেন সরকার বরাবরই ন্যাটোর সরাসরি সাহায্যের জন্য স্পষ্টভাবে আহ্বান জানিয়ে আসছে।
ইউক্রেন বলছে, ডনবাস অঞ্চলে আসন্ন রুশ আক্রমণকে প্রতিহত করতে জরুরিভিত্তিতে পশ্চিমের সামরিক সহায়তা প্রয়োজন। জ্যাভলিন, এনএলএডব্লিউ (নেক্সট জেনারেশন লাইট অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক ওয়েপন), স্টিঞ্জারসহ ট্যাংক ও বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পুনরায় পশ্চিমের কাছে চাইছে তারা।
ইতোমধ্যেই, ইউক্রেনকে প্রচুর অস্ত্র সরবরাহ করেছে পশ্চিমা মিত্ররা। এরপরেও দেশটি আরও সামরিক সহায়তা চাইছে। রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান বিমান হামলা এবং দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার মোকাবেলায় ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান, ড্রোন এবং উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন বলে জানিয়েছে তারা।
এখন হয়তো অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে ঠিক কী কারণে ন্যাটো এখনও চুপ করে আছে? যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিচ্ছে না? এর উত্তর হলো, যুদ্ধের পরিধি বিস্তৃত হওয়ার ভয়।
পশ্চিমাদের মনে রাশিয়ার কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার (স্বল্প পরিসরের) বা ইউক্রেনের সীমানা ছাড়িয়ে ইউরোপীয় অঞ্চলে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এই শঙ্কা বা ভয় মোটেই ভিত্তি নয়। যুদ্ধের শুরুতেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র বহনকারী বাহিনীকে উচ্চ সতর্কতায় থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে মূলত রাশিয়া যে একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, তা পুরো বিশ্বকে আরও একবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন পুতিন।
তবে রাশিয়ার পারমাণবিক স্টোরেজ থেকে কোনো ধরনের সরঞ্জাম নড়চড় হওয়া শনাক্ত করতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও পুতিনের বক্তব্য ছিল, “রাশিয়ার একটি বিশাল পারমাণবিক অস্ত্রাগার রয়েছে; সুতরাং আপনি আমাদের কোণঠাসা করে ফেলতে পারবেন, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।”
রাশিয়ান ‘মিলিটারি ডক্ট্রিন’ বা সামরিকনীতি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথমিকভাবে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র (স্বল্প পরিসরে) ব্যবহারের অনুমতি দেয়। এদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালে জাপানের ওপর মার্কিন পারমাণবিক হামলার পর, গত ৭৭ বছরে আর কোথাও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেনি পশ্চিম।
ন্যাটো নেতারা এখন একটি বিষয় নিয়েই সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন; একবার যদি কোনোভাবে পারমাণবিক এই নিষেধাজ্ঞা ভেঙে পড়ে, এমনকি যদি ইউক্রেনের ওপর স্বল্প পরিসরেও তা আঘাত হানে, তাহলে রাশিয়া এবং পশ্চিমের মধ্যে একটি বিপর্যয়কর পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। আর এমনটি হলে তা পুরো বিশ্বের জন্যই ডেকে আনবে ভয়ঙ্কর পরিণতি।
তাহলে ঠিক কীভাবে এই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে? এবং পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোকেও যুদ্ধে টেনে আনতে পারে?
পশ্চিমা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এমন অনেকগুলো সম্ভাব্য পরিস্থিতিই তৈরি হতে পারে চলমান সংকটে। এরমধ্যে সম্ভাব্য ৩টি পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
১। ন্যাটোর সরবরাহকৃত জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে যদি ওডেসায় ইউক্রেনীয় বাহিনী শ খানেক নাবিকসহ কৃষ্ণ সাগরে কোনো রুশ যুদ্ধজাহাজে আঘাত করে এবং তা ডুবিয়ে দেয়, তাহলে নিঃসন্দেহে রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়বে। একক হামলার ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা হবে নজিরবিহীন এবং প্রেসিডেন্ট পুতিন অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানাবেন।
২। রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ন্যাটো জোটভুক্ত দেশ, যেমন- পোল্যান্ড বা স্লোভাকিয়া দিয়ে ইউক্রেনে নিয়ে যাওয়ার সময় যদি কোথাও তা আঘাত হানে, যদি ন্যাটোভুক্ত দেশের সীমান্তে কোনো ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটে, তাহলে তা ন্যাটোর সংবিধানের ৫ নং অনুচ্ছেদকে লঙ্ঘন করবে। সেক্ষেত্রে ওই দেশের সুরক্ষায় পুরো ন্যাটো জোট এই লড়াইয়ে অংশ নিতে পারে।
৩। ডনবাসে ব্যাপক লড়াইয়ের মধ্যে কোনো শিল্প কারখানায় যদি বিস্ফোরণ ঘটে এবং এর ফলে বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস নির্গত হলে পরিস্থিতি বেগতিক হতে পারে। যদিও এমন একটি ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটেছে, তবে সেখানে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু সিরিয়ার ঘৌটায় বিষাক্ত গ্যাসের ব্যবহারে যে ধরনের ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল, এরকম কোনো ঘটনা যদি ইউক্রেনের ক্ষেত্রে রুশ বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটিয়েছে বলে প্রমাণ হয়, তাহলে ন্যাটো তার জবাব দিতে বাধ্য থাকবে।
আবার এমনও হতে পারে ওপরের কোনো পরিস্থিতিই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে না।
কিন্তু যখন পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ায় জানাতে এতটা ঐক্য দেখাচ্ছে, সেখানে এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, পরিস্থিতির প্রয়োজনে চলমান উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে এমন পদক্ষেপ নিতে পিছ পা নাও হতে পারে পশ্চিমারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্রিটেনের একজন অভিজ্ঞ সামরিক কর্মকর্তা বলেন, “এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত প্রশ্ন হলো, আমাদের সরকার সংকট ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত নাকি কৌশলগত বিষয়ে, তা নিয়ে ভাবতে হবে।”
“এখানে আমাদের লক্ষ্য হলো, ইউক্রেনকে যথাসাধ্য সাহায্য করা। তবে সমস্যা হলো, ‘জুজুর ভয় দেখানোর খেলায়’ পুতিন আমাদের চেয়ে ভালো খেলোয়াড়”, যোগ করেন তিনি।