যেভাবে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করতে পারেন ইমরান খান
ক্রিকেট-কিংবদন্তী ইমরান খান তার দলের খেলোয়াড়দের একবার বলেছিলেন ‘কোণঠাসা হয়ে পড়া বাঘের মতো লড়াই’ করতে।
প্রায় আড়াই দশকের আন্দোলন সংগ্রামের পর পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের সাড়ে তিন বছরের মাথায় রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হলেন।
নানা নাটকীয়তার পর তার বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানো ইমরান খান কি এখন সেই ‘কোণঠাসা বাঘের’ মতো লড়াই করতে পারবেন? নাকি ক্রিকেটের মতো তার রাজনৈতিক ইনিংসের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে?
রাজনৈতিক মৃত্যু?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর পদ হারালেও এখনই ইমরান খানের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটছে না।
ক্রিকেট ম্যাচে তিনি যেমন শেষ বল পর্যন্ত জেতার জন্য খেলেছেন, ঠিক তেমনি রাজনীতিতেও তার লড়াই অব্যাহত থাকবে।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (সোয়াস) দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক এবং পাকিস্তান বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, পাকিস্তানের সমাজে, এমনকি সামরিক বাহিনীতেও তার অনেক সমর্থক রয়েছে।
তিনি বলেন, “ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে ইমরান খান অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ‘মার্কিন ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ তুলেছেন। ষড়যন্ত্রের এই গল্প পাকিস্তানে অত্যন্ত জনপ্রিয়।”
“পাকিস্তানের মানুষ এধরনের ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব বিশ্বাস করতে পছন্দ করে। ‘সবকিছুর পেছনেই আমেরিকার হাত আছে’- এরকম ধারণার ওপরেই গড়ে উঠেছে এই দেশের সমাজ। তারা মনে করে আমেরিকার হস্তক্ষেপ ছাড়া পাকিস্তানে কিছুই হয় না। ফলে ইমরান খানের এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তার ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে।”
ইসলামাবাদে সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাসিম জেরাও মনে করেন রাজনীতিতে এখন ইমরান খানের আরো আরেকটি অধ্যায় শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ইমরান খান আগেও প্রমাণ করেছেন তিনি একজন যোদ্ধা। তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের প্রতিও তার অঙ্গীকার রয়েছে। এখন তিনি আবার সেই লড়াই করার অবস্থায় ফিরে যাচ্ছেন।’
নাসিম জেরা বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে তার ২০ বছরেরও বেশি সময় লেগেছে। তিনি জানেন কিভাবে কঠিন সময় মোকাবেলা করতে হয়। এখন দেখা যাক এখান থেকে তিনি কোথায় গিয়ে পৌঁছান।
তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবেন কি না তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
পাকিস্তানে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।
ক্ষমতায় ফেরা?
পাকিস্তানের ইতিহাসে এর আগে দু’জন প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয়বার এমনকি তৃতীয়বারের মতোও ক্ষমতায় ফিরে আসার উদাহরণ রয়েছে।
বেনজির ভুট্টো ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর একবার এবং নওয়াজ শরিফ দুবার নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদে ফিরে আসেন।
ইমরান খানেরও বেলাতেও কি সেরকম সম্ভাবনা আছে?
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নওয়াজ শরিফের দল পিএমএলএন এবং বেনজির ভুট্টোর পিপিপি উভয়েরই জনগণের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা ছিল। তারা অনেক কিছু মেনে নিয়েছিল এবং আপস করেছিল, যার ফলে তারা ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছিলেন।
তারা বলছেন, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর ব্যাপারে বর্তমান ইমরান খানের কতটুকু ক্ষমতা আছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি কেমন সম্পর্ক তৈরিতে সক্ষম হবেন -এসবের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
ইসলামাবাদে রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাসিম জেহরা বলেন, পাকিস্তানে কারো ক্ষমতায় আসার পেছনে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে- রাজনৈতিক সংগ্রাম তার একটি, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো কেমন, সার্বিক পরিস্থিতি কেমন ইত্যাদি।
‘এসব কারণে তার ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা আমি উড়িয়ে দিতে চাই না,’ বলেন তিনি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে আগামী অন্তর্বর্তী সরকারের পারফরমেন্সে ওপরেও।
তারা বলছেন, নতুন সরকার যদি মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে, বিভিন্ন সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে, অর্থনীতি কিছুটা হলেও চাঙ্গা করতে পারে, দরিদ্র মানুষের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে, তাহলে ইমরান খানের মানুষের কাছে অতীতের বিষয়ে পরিণত হবে।
আয়েশা সিদ্দিকা মনে করেন না যে ইমরান খান সহসাই সরকারে ফিরে আসতে সক্ষম হবেন। বিরোধী বেঞ্চেও তিনি কতটা শক্তি নিয়ে বসতে পারবেন এ নিয়েও তার সন্দেহ রয়েছে।
তিনি মনে করেন, এর পুরোটাই নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকারের পারফরমেন্সের ওপর। নতুন সরকার যদি মানুষের মন জয় করতে না পারে তাহলে ইমরান খান তার ক্ষতি কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
‘পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার আগ পর্যন্ত ইমরান খান তার বিরোধীদের দুর্নীতির ব্যাপারে সরব থাকবেন, মার্কিন ষড়যন্ত্র নিয়ে কথা বলবেন এবং পাকিস্তানের মানুষ এই তত্ত্ব বিশ্বাস করতে প্রস্তুত। এর সাথে যদি অন্তর্বর্তী সরকারের খারাপ পারফরমেন্স যোগ হয় তাহলে হয়তো তিনি তার হৃত সুনাম ফিরে পেতে পারেন,’ বলেন আয়েশা সিদ্দিকা।
পিটিআই-এর ভবিষ্যৎ
ইমরান খান পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ পাইয়ে দেন ১৯৯২ সালে। এর চার বছর পর ১৯৯৬ সালে গঠন করেন রাজনৈতিক দল পিটিআই।
এর পর আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে তিনি সামনের দিকে অগ্রসর হন।
শেষ পর্যন্ত তার দল ব্যাপক জনপ্রিয়তার অর্জনের মাধ্যমে ২০১৮ সালে ক্ষমতায় এলে ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
ইমরান খান ক্ষমতা হারানোর পর তিনি ও তার দল সারা দেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন।
ইসলামবাদে সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাসিম জেহরা বলেন, ইমরান খান মনে করেন তার দলের এমপিদের পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করা উচিত। এখন দেখতে হবে যে কতজন এমপি তার কথা শোনেন।
‘এর পেছনে কিছু মূল্য আছে। মনে রাখতে হবে সরকারি দল আর বিরোধী দলে থাকা ভিন্ন বিষয়। যারা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তাদেরকে যখন সাড়ে তিন বছর পর পদত্যাগ করতে বলা হচ্ছে তখন তারা সেই নির্দেশ কতটা অনুসরণ করবেন তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে,’ বলেন তিনি।
তিনি মনে করেন ইমরান খান যে প্রতিবাদ বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন তাতে জনগণ কিভাবে সাড়া দেয় তার উপরেও পিটিআই-এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের সোয়াসের পাকিস্তান গবেষক আয়েশা সিদ্দিকা মনে করেন, পিটিআই একটি জনপ্রিয় দল হিসেবেই থাকবে।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে- তার দলের নেতাদের তিনি কতটা একসাথে রাখতে পারবেন?
‘অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটির সময় পিটিআই দলের সদস্যরা পার্লামেন্ট থেকে ওয়াকআউট করেছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তারা আগামীতেও ইমরান খানের নেতৃত্বে একতাবদ্ধ থাকবেন,’ বলেন আয়েশা সিদ্দিকা।
তিনি মনে করেন, দলের ভেতরে অনেকেই আছেন যারা নির্বাচিত হওয়ার মতো। তারা অন্য দলে যোগ দেবেন কি না আগামীতে সেটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে উঠতে পারে।
আয়েশা সিদ্দিকার মতে পিটিআই-এর একটি মুখ হচ্ছে রাজনৈতিক আদর্শধারী ব্যক্তিবর্গ যারা মনে করেন কিছু একটা করতে হবে- দুর্নীতি বন্ধ করা, প্রচলিত নেতৃত্ব থেকে বের হয়ে আসা ইত্যাদি।
এদের অনেকেই নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য এবং তারা ইমরান খানকে ছেড়ে চলে যেতে চাইবেন, কারণ তারা ক্ষমতায় থাকতে চান।
‘তাদের অনেকেই হয়তো আগামী নির্বাচনে পিটিআই ছেড়ে দিয়ে অন্য দল থেকে প্রার্থী হতে পারেন। তবে যাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তারা হয়তো ইমরান খানের সঙ্গেই থেকে যাবেন,’ বলেন আয়েশা সিদ্দিকা।
সামরিক বাহিনীর সাথে সম্পর্ক
বলা হয়, সামরিক বাহিনীর সমর্থন নিয়েই ইমরান খান ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। পরে সেনা প্রধানের সঙ্গে তার বিরোধের জের ধরেই তাকে ক্ষমতা হারাতে হলো।
একেবারে শেষের দিকে ইমরান খান সেনা প্রধান জেনারেল বাজওয়াকে বরখাস্ত করতে চেয়েছিলেন।
আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘পুরো সেনাবাহিনী কিন্তু ইমরান খানের বিরুদ্ধে নয়। শুধু সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল বাজওয়া তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সামরিক বাহিনীর ভেতরেও তার অনেক সমর্থক রয়েছে।’
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী হবে সেটা তিনি সামনের “খেলা কিভাবে খেলবেন” তার উপর নির্ভর করছে।
‘আমরা জানি যে তিনি শেষ খেলাটা খারাপ খেলেছেন এবং যদি সেটা অব্যাহত থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে হয়তো দুর্নীতির মামলাও আনা হতে পারে,’ বলেন আয়েশা সিদ্দিকা।
কিন্তু নাসিম জেহরা বলেন, ইমরান খানকে সামরিক বাহিনী জোরপূর্বক ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেনি, অনাস্থা ভোটে হেরে তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে।
‘এই অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে দেড় বছর ধরে বিরোধীদের মধ্যে কথাবার্তা চলছিল। শেষ পর্যন্ত তারা সেটা এনেছে এবং ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরাতে সক্ষম হয়েছে। সেনাবাহিনী ও ইমরান খানের মধ্যে আমি কোনো সংঘাতমূলক অবস্থান দেখতে পাচ্ছি না যা তার জন্য বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করবে,’ বলেন তিনি।
সামনের পথ
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ইমরান খানের সামনে এখন একমাত্র পথ হচ্ছে রাজপথের আন্দোলনে ফিরে যাওয়া, যেরকম আন্দোলনের মাধ্যমে একসময় তিনি মানুষের কাছে গিয়েছিলেন।
নাসিম জেহরা বলেন, একজন রাজনীতিকের কাছে আর কী বিকল্প থাকতে পারে- তারা আন্দোলন সংগ্রাম করেন এবং ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা করেন।
‘পিটিআই-এর এমপিরা সবাই যদি তার নেতৃত্বে একতাবদ্ধ থাকেন তাহলে তারা পার্লামেন্টে শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে। মনে রাখতে হবে যে নির্বাচনের আর এক বছরের মতো বাকি। এমন নয় যে ইমরান খানকে আরো পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। ফলে তিনি এখন অনেক বেশি ব্যস্ত সময় কাটাবেন।’
তবে আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘এখন আমরা কতগুলো ঘটনা ঘটতে দেখব। নতুন সরকার ও সামরিক বাহিনী মিলে কিছু করার চেষ্টা করবে, যেমন ভারতের সঙ্গে শান্তি আলোচনা, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নত করা।’
তিনি বলেন, এখন ইমরান খান যদি এসব উল্লেখ করে জনগণ বিশেষ করে তরুণ সমাজকে তার উত্থাপিত ‘মার্কিন ষড়যন্ত্র’ তত্ত্বের ব্যাপারে উত্তেজিত রাখতে পারেন, তাহলে হয়তো তিনি লাভবান হতে পারেন।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার যদি জনগণের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে তাহলে ক্রিকেটের মাঠ থেকে ইমরান খানের ক্ষমতাগ্রহণ ও ক্ষমতাচ্যুতির গল্প হবে নিতান্তই আরো একটি গল্প, কিন্তু সেটি প্রধান গল্প হবে না।
সূত্র : বিবিসি