পতনের দ্বারপ্রান্তে শ্রীলঙ্কা, গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা
পতনের দ্বারপ্রান্তে শ্রীলঙ্কা। দেশটির অনেক নাগরিকই মনে করছেন এই পরিস্থিতিতে দেশ একটি গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হতে পারে। এ অবস্থায় প্রতিদিনের মতো রোববারও রাজধানী কলম্বোসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়। এসব বিক্ষোভ থেকে প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসের পদত্যাগ দাবি উঠেছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট কোনো অবস্থাতেই পদত্যাগ করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। বিদেশ থেকে ঋণ নিতে নিতে দেশটি এখন দেউলিয়া হয়ে পড়েছে বা দেউলিয়া হওয়ার পথে। খাদ্যদ্রব্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ নেই।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশচুম্বী দাম। চারদিকে এক ভয়াবহ অবস্থা। যে যেখানে পারছেন, সেখান থেকেই প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছেন। বৃটেনের অনলাইন দ্য টেলিগ্রাফে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন সাংবাদিক জো ওয়ালেন।
কলম্বোতে রোববারের বিক্ষোভে ব্যতিক্রমী ব্যানার দেখা যায়। তাতে লেখা ছিল ‘সেভ আস ফ্রম দ্য পলিটিক্যাল টেরোরিস্টস’। অর্থাৎ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের থেকে আমাদের রক্ষা করুন। রাজাপাকসে পরিবারকে লক্ষ্য করে এতে আরও লেখা ছিল ‘ইউ আর ওর্স দ্যান দ্য করোনাভাইরাস’। অর্থাৎ আপনি করোনাভাইরাসের চেয়েও জঘন্য। উল্লেখ্য, ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কটে শ্রীলঙ্কা হাবুডুবু খাচ্ছে। এর ফলে কয়েকদিন ধরে সেখানে একটানা প্রতিবাদ বিক্ষোভ হচ্ছে। তাতে যোগ দিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানী কলম্বোজুড়ে। এর ফলে শহরের অনেক এলাকা অচল হয়ে পড়েছে। বিক্ষোভকারীরা তাদের দাবি পরিষ্কার করেছে। তারা চাইছে, প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসেকে পদত্যাগ করতে হবে। দেশকে তার পরিবারের কব্জা থেকে মুক্তি দিতে হবে। এই পরিবার কয়েক দশক ধরে দেশ শাসন করে আসছে। এ দায়িত্বে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন লোককে চাইছেন তারা।
রাজিব উইথারানা একজন আইটি কর্মকর্তা। তিনি বলেন, দেশে জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে। খাদ্যের দাম তিন থেকে চারগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব বিষয়ে সরকারের মনোযোগে পুরোপুরি ঘাটতি আছে। তার অফিসে কাজ করেন ১৫০ জন মানুষ। ১৩ ঘন্টা দেশজুড়ে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে সেই অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এই বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন বা লোডশেডিং করার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। রাজিব বলেন, মানুষ স্বস্তি পাবে এমন কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই চলছে দেশ। যখন মধ্যম শ্রেণি অর্থ ব্যয় করার সামর্থ রাখে না তখন সমাজের নিচের পর্যায় দুর্ভোগে পড়ে। এসব মানুষ কিভাবে বেঁচে আছেন, সে বিষয়ে আমার কোনো ধারনা নেই।
শহরের প্রতিটি রাস্তার কোণায় কোণায় নার্ভাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সশস্ত্র পুলিশ। জরুরি আইনের অধীনে অস্ত্র হাতে দু’জন সেনা সদস্যকে প্রতিটি পেট্রোল পাম্প পাহাড়া দিতে বলা হয়েছে। পেট্রোল পাম্পে স্থানীয় লোকজনের হুড়োহুড়িতে গত সপ্তাহান্তে তিনজন মানুষ মারা যাওয়ার পর এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত যেসব বিক্ষোভ হয়েছে তা ব্যাপক অর্থেই শান্তিপূর্ণ। কিন্তু বহু শ্রীলঙ্কান আশঙ্কা করছেন যদি রাজাপাকসে পদত্যাগ না করেন, তাহলে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে যেতে পারে। এরই মধ্যে ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করেছে কয়েকবার। এসব মানুষ প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসের বাড়িতে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন।
জনমত ব্যাপকভাবে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। তিনি ২০১৯ সালের নির্বাচনে ভূমিধস জয় পেয়েছিলেন। কিন্তু তারপর অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনায় লেজেগোবরে করে ফেলেছেন বলে অভিযোগ। এ অবস্থায় শনিবার হাজার হাজার নাগরিক কলম্বোর রাস্তায় এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ করেছে। এ থেকে তার পদত্যাগ দাবি উঠেছে। বিক্ষোভে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নেই। সবাই এক হয়ে নেমেছেন রাস্তায়। সিনহলিজ একজন সম্পদশালী বৌদ্ধের পাশাপাশি সরকার বিরোধী স্লোগান দিয়েছেন একজন মুসলিম অটোরিক্সা চালক। পার্লামেন্টের বাইরে ৮ বছরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিক্ষোভ করছিলেন চামারি পবিত্র নামে একজন গৃহবধু। তিনি বলেন, আগের দিন খাবার বলতে কাছের একটি গাছ থেকে কয়েকটি নারকেল আর কয়েকটি আম জোটাতে পেরেছি মাত্র। আমার স্বামী একটি প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করেন। কাগজের দাম বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। ফলে তার আর আয় উপার্জন নেই। মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার কাছে কোনো জ্বালানিও নেই। রাতে রান্না করতে পারিনি। কারণ, বিদ্যুৎ নেই।
শ্রীলঙ্কায় তারল্য সঙ্কটও দেখা দিয়েছে। চীন, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক সহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঋণদাতাদের কাছে শ্রীলঙ্কার ঋণের পরিমাণ কমপক্ষে ২১০০ কোটি পাউন্ড। অন্যদিকে দেশটির রিজার্ভে আছে মাত্র ১৭০ কোটি পাউন্ড। গত মে মাসে রাসায়নিক সারের বিরুদ্ধে আকস্মিক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ফলে খাদ্য উৎপাদনে বড় প্রভাব পড়েছে। এতে দেখা দিয়েছে খাদ্য খাটতি। আমদানিও নেই। টমেটো, পিয়াজ সহ শাকসবজির দাম গত বছরের পরে বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ গুন। চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৩০ ভাগ। এমনকি রাজধানী কলম্বোর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো বলেছে, তাদের কাছে পর্যাপ্ত খাবার নেই। সেখানে বামবালাপিতিয়া এলাকার একজন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক টেলিগ্রাফকে বলেছেন, তার পরিবার কয়েকটি ফ্রোজেন পাউরুটির ওপর ভিত্তি করে বেঁচে আছে।
অন্যদিকে রাজধানী কলম্বোর বাইরে প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় যেসব মানুষ বসবাস করেন, তারা বলছেন অনাহারে কাটছে তাদের দিন। অনাহারের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে কমপক্ষে ২০ জন সেখান থেকে বোটে করে পালিয়ে গেছে ভারতে। ভারত কর্তৃপক্ষ পূর্বাভাষ দিয়েছে যে, সামনের সপ্তাহগুলোতে ভারতে যেতে পারেন চার হাজার শ্রীলঙ্কান। বুধবার দেশটির মেডিকেল বিষয়ক সর্বোচ্চ পরিষদ গভর্নমেন্ট মেডিকেল অফিসার্স এসোসিয়েশন রাজাপাকসেদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ঘোষণা করেছে মেডিকেল জরুরি অবস্থা। এর সমন্বয়ক ড. ভাষান রতœাসিঙ্গম নিশ্চিত করেছেন বৃহস্পতিবার। বলেছেন, শ্রীলঙ্কার একজন মানুষ মারা গেছেন। কারণ, হাসপাতালগুলোতে টেনেক্টাপ্লেস ফুরিয়ে গেছে। কার্ডিয়াক সার্জারির জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ। ড. রতœাসিঙ্গম বলেন, প্রচুর শ্রীলঙ্কান পশ্চিমের দেশগুলোতে বৃটেন, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। এই সঙ্কটে আমাদেরকে সহায়তা করতে তাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। তাদের প্রতি অনুরোধ আমাদের কাছে ওষুধ পাঠান। এখানেই শেষ নয়। দেশটিতে জীবন রক্ষাকারী আরও ৫টি ওষুধের সরবরাহ শেষ। অন্য গুরুত্বপূর্ণ কমপক্ষে ১৮০টি ওষুধ, হাসপাতাল সরঞ্জাম ও পরীক্ষায় রিএজেন্টের ভয়াবহ সঙ্কট দেখা দিয়েছে।