পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি
পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট দেশটির প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ভেঙে দেয়া জাতীয় পরিষদ পুনরুজ্জীবিত করে শনিবারের অধিবেশনে আস্থা ভোটের নিষ্পত্তির আদেশ দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
ইমরান খান ইঙ্গিত দিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চেষ্টা করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী চাইছে তা এখনো পরিষ্কার নয়।
তবে সেনাবাহিনীর ভূমিকা আর ইমরান খানবিরোধী চেতনাকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে ক্ষমতা পরিবর্তনের পরিস্থিতি তৈরি করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘আপাত স্বস্তির’ বলেই মনে করছেন তারা।
যদিও ইমরান খান ‘শেষ বল পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার’ ঘোষণা দিয়েছেন এবং আজই তার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার কথা রয়েছে।
পাকিস্তানের ডেপুটি স্পিকার কাসেম সুরি দেশটির সম্মিলিত বিরোধী দলের আনা অনাস্থা প্রস্তাবটি খারিজ করে দিলেও বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট সুরির সিদ্ধান্তকে বেআইনি বলে রায় দিয়েছে।
এ প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইমরান খানের নিজের দল এ প্রস্তাব আটকে দেয়।
এর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ বিরোধী দলগুলো সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় এবং তাদের আবেদনে বলা হয় যেভাবে অনাস্থা প্রস্তাবটি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আটকে দেয়া হয় তা ছিল বেআইনি ও অসাংবিধানিক।
সুপ্রিম কোর্ট আরো বলেছে, জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির কাছে যে সুপারিশ করেছিলেন তা ছিল বেআইনি এবং প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভি এ লক্ষ্যে যে ঘোষণা করেন তাও ছিল অবৈধ।
আদালতের এ রায়ের অর্থ হলো বিরোধীদল শনিবার প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ওপর অনাস্থা ভোট করে তাকে পরাজিত করবে এবং তাকে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে।
প্রধান বিচারপতি তার রায়ে বলেছেন, এ ভোটটি শনিবার হতেই হবে এবং কোনো কারণ দেখিয়ে এ অধিবেশন মুলতবি করা যাবে না।
তবে শুরু থেকেই ইমরান খান তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য বিরোধী দলগুলোর চেষ্টাকে ষড়যন্ত্র আখ্যায়িত করে এর পেছনে মদদ দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন প্রকাশ্যেই।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলে ইমরান খান দেশের অভ্যন্তরে মার্কিনবিরোধী মনোভাবকে ব্যবহারের মাধ্যমে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি করতে চেয়েছেন।
আরেকজন বিশ্লেষক সাউথ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকুর রহমান বলছেন, ইমরান খান রাশিয়া ও চীনের ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন এটা সত্যি, কিন্তু তার জন্য তাকে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে সরাতে চেষ্টা করছে কি-না তা এখনো পরিষ্কার নয়।
তিনি বলেন, ইউক্রেন হোক আর চীন হোক- পাকিস্তান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র এখন কতদূর যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
সঙ্কট শুরু হলো কিভাবে
২০১৮ সালের জুলাইয়ে নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় এসেছিলেন পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। কিন্তু তখনো দেশটির সেনাবাহিনীর ভূমিকা তার বিজয়ের পথ তৈরি করে দিয়েছে- এমন কথাই প্রচলিত ছিল।
পাকিস্তানকে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট জয়ে নেতৃত্ব দেয়া ইমরান খান ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই আর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণেই ধীরে ধীরে বিপাকে পড়তে শুরু করে তার সরকার। এক পর্যায়ে গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান নিয়োগ নিয়ে সেনাবাহিনীর সাথেও দ্বন্দ্বে জড়ান তিনি।
আবার রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা শুরু করলো তখন তার মস্কো সফরকে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ভালো ভাবে নেয়নি।
এর মধ্যেই তার ক্ষমতাসীন জোটের বড় অংশ এমকিউএম তাকে ছেড়ে বিরোধী জোটে যোগ দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারায় তার সরকার।
পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য ১৭৩ জন সদস্যের সমর্থন দরকার হয়। যদিও বিরোধীদের পক্ষে এখন ১৭৭ জনের সমর্থন আছে।
এটি বুঝতে পেরেই শেষ পর্যন্ত পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব আটকে দিয়ে প্রেসিডেন্টকে দিয়ে পার্লামেন্ট ভেঙে আগাম নির্বাচনের পথে অগ্রসর হন তিনি।
কিন্তু এখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ফলে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব – চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া ইমরান খানের সামনে আর কোনো পথ খোলা রইলো না।
পাকিস্তানে অবশ্য কোনো প্রধানমন্ত্রীই তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।
যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে দেখছে
মার্চের শেষে এক সমাবেশে একটি চিঠি দেখিয়ে ইমরান খান বলেছিলেন, তার বিরুদ্ধে বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব একটি ষড়যন্ত্র এবং এতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নামও উল্লেখ করেন।
তার অভিযোগের জবাবে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখায় যুক্তরাষ্ট্র। অনাস্থা প্রস্তাবের সাথে তাদের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে দেশটি।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের সাথে এক ধরনের টানাপোড়েন শুরু হয় ইমরান প্রশাসনের।
তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সুসম্পর্কের কারণে রাজনৈতিক সরকারের সাথে তাদের সম্পর্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ঠিক কতটা উদ্বিগ্ন তা নিয়ে প্রশ্ন আছে বলে মনে করেন অনেকেই।
ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের, বিশেষ করে আফগানিস্তানে যত দিন মার্কিন সৈন্য ছিল তত দিন পাকিস্তানের ওপর তাদের এক ধরনের নির্ভরতাও ছিল।
আবার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আছে আগে থেকেই, কারণ দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা আছে।
এসব মিলেই সম্পর্ক এত দিন একভাবে চললেও দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এখন নতুন কিছু চিন্তা করছে এবং চীনের সাথে টানাপোড়েন অনেকটাই প্রভাব বিস্তার করছে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ওপর।
এ বিষয়ে ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘পাকিস্তানের সাথে চীনের দীর্ঘ দিনের মৈত্রী। কিন্তু তা যে পর্যায়ে গেছে তা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য অনুকূল নয়। এটা যে আবার পাকিস্তানের সবাই গ্রহণ করছে তাও নয়। এ বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে।’
পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধিতা আছে এবং ইমরান খানসহ রাজনীতিকরা বিভিন্ন সময়ে তা ব্যবহার করেছেন- এসব বিষয় বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র দূরত্ব বজায় রাখছে আবার কৌশলগত কারণে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক রাখা জরুরি সেটাও তারা বুঝতে পারছে বলে মনে করেন তিনি।
ড. শফিকুর রহমান বলছেন, নানা কারণে এশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা আছে, কিন্তু নতুন মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো পুরোপুরি দৃশ্যমান নয় বলে মনে হয় তার কাছে।
ইউক্রেন ইস্যুতে ইমরান খানের ভূমিকাই কী টানাপোড়েনের কারণ?
রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পরপরই মস্কো গিয়েছিলেন ইমরান খান এবং তিনি ফিরে আসার পর জমে ওঠে পাকিস্তানের রাজনীতিও।
ইমরান খান দাবি করছেন, তিনি যেহেতু সম্প্রতি মস্কো সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে দেখা করেছেন এবং এর আগে বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের’ সমালোচনা করেছেন, এ কারণে তাকে সরানোর ষড়যন্ত্র চলছে।
যুক্তরাষ্ট্র এসবের সত্যতা অস্বীকার করলেও পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশটিতে মার্কিনবিরোধী মনোভাব রয়েছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রেরও জানা আছে বলে মনে করেন আলী রীয়াজ।
তার মতে, ইমরান খান সরকারের সাথে টানাপোড়েন কিন্তু আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের সময়েই হয়েছে। কারণ ওই সিদ্ধান্তের আগে পাকিস্তানের সাথে কোনো আলোচনা করেনি যুক্তরাষ্ট্র। আরেকটি বিষয় হলো চীনের সাথে পাকিস্তানের বন্ধন আরো দৃঢ় হওয়া। এগুলো পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে।
আলী রীয়াজ বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ যখন এলো তখন দেখা গেলো ইমরান খান রাশিয়ার দিকে। এটা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অস্বস্তিকর। তবে এককভাবে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে হয়নি। ইমরান খান প্রায়ই মার্কিনবিরোধী কথা বলেন। এসব মিলেই চলমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
তার মতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে তবে ভারত-চীন ইস্যুসহ নানা কারণে তাদের ভিন্ন চরিত্রও দেখা যেতে পারে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন সরকারের সম্পর্ক ভালো হবার সম্ভাবনা থাকলেও নিশ্চয়তা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর কারণ নতুন সরকারের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে যে ব্যাপক সহায়তার দরকার হবে সেটা কে দিবে? আর জনগণের মার্কিনবিরোধী মনোভাব নিয়ে নতুন সরকার কী করে তার ওপরেও অনেক কিছু নির্ভর করবে। তবে ইমরান খানের পর নতুন সরকার তা কতটা ব্যবহার করবে তাও দেখতে হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের যে অস্বস্তি ছিলো তা সামান্য হ্রাস করবে-এর বেশি কিছু নয়।’
অবশ্য ড. শফিকুর রহমান মনে করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ওপর নজর রাখছে এটা সত্য। তবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আর এখন রাশিয়া ও ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যতটা ব্যস্ত সেখানে পাকিস্তান নিয়ে তাদের অতটা ভাবারও সুযোগ নেই। বাইডেন প্রশাসনের ওপর মহল থেকে তাই তেমন কোনো আগ্রহও দেখা যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘মার্কিন কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন। এটা তো নিশ্চিত পাকিস্তানে যা হতে চলেছে তা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রলুব্ধ না করলেও তার পক্ষেই যাচ্ছে।’
শফিকুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সাথে তাদের সম্পর্ক বরাবরই ভালো এবং ওই সেনাবাহিনীর সাথে আর ইমরান খানের তেমন সুসম্পর্ক নেই। তবে নতুন সরকার আসার পর বোঝা যাবে যুক্তরাষ্ট্র কী চাইছে বা পাকিস্তান নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আসলে কী।’
সূত্র : বিবিসি