যেভাবে শুরু বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সাইবার অস্ত্র পেগাসাসের জন্য যুদ্ধ
ইসরাইল কীভাবে কুখ্যাত গোয়েন্দা সফটওয়্যার ‘পেগাসাস’কে কূটনৈতিক কামধেনু হিসেবে কাজে লাগিয়েছে, কীভাবে এর ষোল আনা সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছে তা উঠে এসেছে নিউ ইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। তেল আবিবের পথ ধরে খোদ ওয়াশিংটনও একই কসরত করেছে। ‘পেগাসাস’ কিনেছিল আমেরিকা। তবে এখন এই সফটওয়্যারকে নিষিদ্ধ করার কাজে আটঘাট বেঁধেই নেমেছে ওয়াশিংটন।
তেল আবিবভিত্তিক নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের স্টাফ রাইটার রনেন বার্গম্যান এবং দুই দফা পুলিৎজার বিজয়ী ওয়াশিংটনের অনুসন্ধানী সাংবাদিক মার্ক ম্যাজজেনটি যৌথভাবে এ প্রতিবেদন তৈরি করেন। রনেন বার্গম্যানের সর্বশেষ বই ‘রাইজ অ্যান্ড কিল: দ্যা সিক্রেট হিস্টোরি অব ইসরাইল’স টারগেটেড অ্যাসাসিনেশন’ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। আর মার্ক ম্যাজজেনটির সর্বশেষ বইয়ের নাম- ‘দি ওয়ে অব নাইফ: দ্য সিআইএ, এ সিক্রেট আর্মি, অ্যান্ড আ ওয়ার অ্যাট দ্য এন্ডস অব দি আর্থ।’
২০১৯ সালের জুন মাসের একটি দিন। ইসরাইলি তিন কম্পিউটার প্রকৌশলী ঢুকলেন নিউ জার্সির এক ভবনে। মার্কিন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা এফবিআই ব্যবহার করে এ ভবন। ভবনটির একটি বিচ্ছিন্ন কামরার লম্বা তাকগুলোতে বসাতে শুরু করলেন তারা কয়েকটি কম্পিউটার সার্ভার। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনবরত ফোন করে চললেন এই তিন প্রকৌশলী। তেল আবিবের উপকণ্ঠে হারজলিয়াতে তাদের কর্তাব্যক্তিদের কাছেই ফোন করছিলেন তিন প্রকৌশলী। দুনিয়ার সবচেয়ে কুখ্যাত গোয়েন্দা সফটওয়্যার এনএনও গ্রুপের সদর দপ্তরের সাথে যোগাযোগ রাখছিলেন তারা। এভাবেই শেষ হলো বসানোর পর্ব। এবারে শুরু হলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পালা।
‘পেগাসাসে’র একটি সংস্করণ কিনেছে এফবিআই। এনএসও’র সেরা গোয়েন্দা হাতিয়ার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এটি। গত প্রায় এক দশক ধরে আইন প্রয়োগকারী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে ‘পেগাসাস’ বিক্রি করছে ইসরাইলের সংস্থাটি। এনএসও’র দেয়া প্রতিশ্রুতিতে বলা হচ্ছে, যে কোনো বেসরকারি কোম্পানি এমনকি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাও যা পারে না সে কাজ করবে ‘পেগাসাস।’ আইফোন এবং অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন থেকে তথ্য হাতিয়ে নেবে। অবিরাম এবং নির্ভরযোগ্যভাবেই এ কাজ দিনের পর দিন করে যাবে ‘পেগাসাস।’
এনএসও ২০১১ সালে ‘পেগাসাস’কে বিশ্ববাজারে ছাড়ে। এর শক্তিতেই বলীয়ান হয়ে মেক্সিকোর কর্তৃপক্ষ এল চ্যাপো নামে পরিচিত মাদক সম্রাট জোয়াকুইন গুজমান লোরাকে পাকড়াও করতে সক্ষম হয়। ইউরোপীয় তদন্তকারীরা ‘পেগাসাস’কেই খাটিয়ে নীরবে ব্যর্থ করেছে সন্ত্রাসবাদীদের একের পর এক চক্রান্ত। সংগঠিত অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে লড়াইতে জয়ী হয়েছে তারা। বিশ্বজুড়ে শিশু নির্যাতন চক্রকে ভেঙ্গে দিয়েছে। এ চক্রের সাথে জড়িত ৪০টির বেশি দেশের সন্দেহভাজন বহু অপরাধীকে শনাক্ত করা গেছে। সত্যি বলতে কী বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বিচার করলে দেখা যাবে একবিংশ শতকে আইন প্রয়োগকারী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অন্যতম বড় সমস্যার সুরাহা করেছে এনএসও’র এই পণ্য। এই সমস্যা হলো, অপরাধী এবং সন্ত্রাসী চক্রগুলোর সংকেতবদ্ধ বার্তা আদান-প্রদান বা যোগাযোগ প্রযুক্তি অনেক উন্নত। এ সব সংকেত মোচন করে তথ্য উদ্ঘাটনে যে সব ব্যবস্থা আইনি সংস্থাগুলোর কাছে ছিল তার চেয়েও অপরাধীদের প্রযুক্তি উন্নততর এবং শক্তিশালী। ফলে একদিকে দিনে দিনে অপরাধ চক্র পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। অন্যদিকে তাদের তৎপরতা সম্পর্কে আইনি সংস্থাগুলাকে থাকতে হচ্ছে ঘোর অন্ধকারে।
তবে ২০১৯ সালের মধ্যে এ পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে যায়। জুন মাসের সে দিনটিতে যখন এনএসও’র প্রকৌশলীরা এফবিআই ভবনে ঢুকলেন তার আগে থেকেই ‘পেগাসাস’ অপব্যবহারের একেবারে হাতেনাতে প্রমাণ মিলতে শুরু করে।
মেক্সিকো ‘পেগাসাস’কে কেবল অপরাধ চক্রের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করেনি। বরং দেশটির সাংবাদিক এবং ভিন্ন মতের রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধেও লাগিয়ে দিয়েছে ‘পেগাসাস’কে। মানবাধিকার কর্মীদের ফোন থেকে তথ্য হাতিয়ে নিতে এবং তাদের ফোনে আড়িপাততে ‘পেগাসাস’কে কাজে লাগায় সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির সরকার মানবাধিকার কর্মীদের কারাগারে পাঠাতেও দ্বিধা করেনি। নারী অধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করেছে সৌদি আরব। দায়ের করা এক মামলার ভাষ্য অনুযায়ী, দেশটির ভিন্ন মতাবলম্বী এবং ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক জামাল খাসোগির ওপর গুপ্তচরগিরি করতে ব্যবহার করা হয় ‘পেগাসাস।’ ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে সৌদি ঘাতকদের হাতে নিহত হন তিনি। মেলেনি তার মরদেহও। তার লাশ টুকরা টুকরা করে গুম করে ফেলা হয়।
এতোসব ঘটনাতেও গা করেনি ‘পেগাসাসের’ নতুন ক্রেতাদের দল। এ দলে নাম লেখায় আমেরিকাও। এফবিআইয়ের জন্য ‘পেগাসাস’ কেনা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার বিস্তারিত বিবরণ কখনোই প্রকাশ করেনি আমেরিকা। বরং খাসোগি নিহত হওয়ার বছরই মার্কিন মিত্র জিবুতির সরকারকে ‘পেগাসাস’ কেনার তহবিলের যোগান দেয় ওয়াশিংটন। সন্ত্রাসবাদ দমনের লক্ষ্য নিয়ে ‘পেগাসাস’ কেনার এ যোগাড়যন্ত্র করা হয়। কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সাংবাদিক দলন ও সরকার বিরোধীদের দমন-পীড়ন নিয়ে দেশটির বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারের উদ্বেগ ছিল বহুদিনের। এনএসও’র সাথে আলাপে বসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাদক বিরোধী সংস্থা ডি.ই.এ, কেন্দ্রীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সিক্রেট সার্ভিস বা ইউএসএসএস এবং মার্কিন সেনাবাহিনীর আফ্রিকা কমান্ড। পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার পথে এগিয়ে যায় এফবিআই।
আমেরিকার কোনো ফোন নম্বর হ্যাক করার সক্ষমতা রাখা হয়নি ‘পেগাসাসে’। প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে এফবিআই কর্মীরা নতুন স্মার্টফোন কিনে আনেন। অন্য দেশের সিম কার্ড ব্যবহার করে ভুয়া একাউন্ট তারা খোলেন। এবারে ‘পেগাসাসে’র প্রকৌশলীরা তাদের যন্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করেন। এফবিআই কর্মীদের ফোন নম্বরে ঢোকেন। আর এরই মধ্য দিয়ে সাইবার হামলা শুরু করেন তারা। ‘পেগাসাসে’র প্রকৌশলীদের জন্য এ ধরণের প্রদর্শনী মোটেও নতুন নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করে এমন অনেক ভেলকি দেখিয়েছেন তারা।
‘পেগাসাসের’ এই সংস্করণ ‘শূন্য’ বা ‘জিরো ক্লিক’ হিসেবে পরিচিত। এ জাতীয় অন্যান্য সফটওয়্যারের সাথে এখানেই ‘পেগাসাসের’ বড় পার্থক্যের দেয়াল তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ এই সংস্করণের ‘পেগাসাস’ দিয়ে গোয়েন্দা তৎপরতা বা নজরদারি চালানোর জন্য কোনো ক্লিক করারই দরকার নেই। এর ফল হলো এই যে ফোনের তৎপরতা নজরদারি করছেন যে সব মার্কিন কর্মকর্তা তারা ফোনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে সেখানে ‘পেগাসাস’ ঢুকে যাওয়ার কোনো নজিরই দেখতে পান না। তারা আরো দেখতে পান না যে ‘পেগাসাস’ কম্পিউটারের সাথে বিশ্বব্যাপী সার্ভারের যোগাযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে হ্যাকিং চলছে ফোনে। কাজ শেষে আবার নিউ জার্সির যন্ত্রপাতির সাথে সংযোগ দিয়ে দেওয়া হয় আক্রান্ত ফোনকে। অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া এতসবের কিছু্ই ঠাওর করতে পারে না কেউ। বরং কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ‘পেগাসাস’ কম্পিউটারের বিশাল পর্দায় উন্মোচিত হতে দেখে আক্রান্ত ফোনের প্রতিটি তথ্য। তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে ফোনে রাখা প্রতিটি ইমেইল, প্রতিটি ফটো, প্রতিটি লেখা, প্রতিটি ব্যক্তিগত যোগাযোগের তথ্য। ফোনটি কোথায় আছে তাও দেখতে পায়। এমনকি ফোনের ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া হয়েছে তাও দেখা যায়। এভাবে ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করে এফবিআইয়ের একজন কর্মী প্রায় সাথে সাথেই অন্য আরেকজনের ফোনকে শক্তিশালী নজরদারির যন্ত্রে পরিণত করতে পারবে। আমেরিকা ছাড়া বিশ্বের যে কোনো দেশের স্মার্টফোনের ওপর ভর করতে পারে ‘পেগাসাস।’ ফলে সেই ফোনটি এভাবে গোয়েন্দা যন্ত্র হয়ে যায়। তোমারি শিল তোমারি নোড়া ভাঙ্গবো তোমার দাঁতের গোড়া! এভাবে তারই সেরা উদাহরণ হয়ে ওঠে ‘পেগাসাস’- আক্রান্ত ফোন।
মার্কিন নাগরিকদের ওপর সরকারি নজরদারির বিষয়ে তথ্য ২০১৩ সালে ফাঁস করেছিলেন দেশটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি(এনএসএ)’র ঠিকাদার এডওয়ার্ড স্নোডেন। ফলে দেশের অভ্যন্তরে গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোকে কেন্দ্র করে আমেরিকায় বিতর্কের তুফান বয়ে যায়। এর আগে খুব কম বিতর্কই মার্কিন নাগরিকদেরকে এমন যারপরনাই মানসিক পীড়নে ফেলতে পেরেছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য রাখার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি বিকাশ ঘটে স্মার্টফোন ও গোয়েন্দা সফটওয়্যারের। এ জাতীয় ফোন প্রতিদিনই টেরাবাইট পরিমাণে তথ্য তৈরি করছে আর গোয়েন্দা সফটওয়্যার দিয়ে তা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। আমেরিকার ওপর গোয়েন্দাগিরি করার সক্ষমতা অন্য দেশকে দেওয়া হলে তাতে মার্কিনীরা ক্ষেপে উঠবে। পরিণামে তা ইসরাইলের জন্য ভালো হবে না। তাই এনএসওকে এমনভাবে ‘পেগাসাস’ তৈরি করতে হয় তা দিয়ে যেন অন্য কেউ মার্কিন ফোন নম্বরের বিরুদ্ধে গোয়ন্দাগিরি করতে না পারে। এতে মার্কিন কর্তৃপক্ষও মার্কিনীদের ওপর গোয়েন্দাগিরির সুযোগ হারায়।
এবারে এলো ফ্যান্টম!
নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকার ইচ্ছা নিশ্চয়ই থাকবে না মার্কিন গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর। এবারে অসহায় অবস্থা থেকে দূর করতে এফবিআইকে ‘পেগাসাসের’ সীমাবদ্ধতা কাটানোর নতুন প্রস্তাব দিলো এনএসও। ওয়াশিংটনে মার্কিন কর্তাদের সামনে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করল এনএসও। ‘ফ্যান্টম’ নামে ‘পেগাসাসের’ নতুন সংস্করণ হাজির করল এ প্রদর্শনীতে। এফবিআই সে সব সন্দেহভাজন মার্কিন নম্বরে নজরদারি করতে চাইছে সে সব নম্বরকে সহজেই হ্যাক করার কাজটি করছে ‘পেগাসাসে’র নব সংস্করণ ‘ফ্যান্টম।’ এজন্য এনএসওকে ইসরাইল বিশেষ লাইসেন্স দিয়েছে। এই লাইসেন্সের আওতায় ফ্যান্টম ব্যবস্থাকে মার্কিন ফোন নম্বরে সাইবার হামলা চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। এতে মার্কিন বিশেষ খদ্দেরদের জন্য পেগাসাসের নতুন এ সংস্করণ ব্যবহারের বিধান রাখা হয়েছে। আর সৌভাগ্যবান সেই ‘বিশেষ’ খদ্দেররা হলো– মার্কিন সরকারি সংস্থাসমূহ। সম্ভাব্য ক্রেতাদের জন্য ফ্যান্টমের চিত্তাকর্ষক গুণাগুণ তুলে ধরে চটকদার ব্রোশিওর প্রকাশ করে এনএসও’র মার্কিন সাবসিডিয়ারি। এটি প্রথম প্রকাশ করে মার্কিন-কানাডীয় সাময়িকী ভাইস। এতে বলা হয়, ফ্যান্টম আমেরিকান আইন প্রয়োগকারী এবং গুপ্তচর সংস্থাগুলোকে “মোবাইল ডিভাইসসমূহ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ডেটা হাতিয়ে নিতে সহায়তা করবে। সহায়তা করবে এসব যন্ত্রের সাহায্যে নজরদারি চালিয়ে” গোয়েন্দা তথ্য যোগাড় করতে। এটি নজরদারি চালানোর ক্ষেত্রে একটি “স্বতন্ত্র সমাধান।” নজরদারি চালানোর জন্য এটিঅ্যান্ডটি, ভেরিজোন, অ্যাপেল বা গুগলের সহযোগিতার কোনোই প্রয়োজন পড়বে না। এতে আরো বলা হয়, এই ব্যবস্থা “আপনার লক্ষ্যে থাকা স্মার্টফোনকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহের সোনার খনিতে রূপান্তর করবে।”
ওয়াশিংটনে ‘ফ্যান্টমের’ এই প্রদর্শনীর পর শুরু হয় আলোচনা। এটি মোতায়েন করা হলে তাতে মার্কিন আইনের লঙ্ঘন ঘটবে কী না তা নিয়ে আলোচনায় নামেন মার্কিন বিচার বিভাগের আইনজীবীরা এবং এফবিআই। দুই প্রেসিডেন্ট প্রশাসন এ আলোচনায় জড়িয়ে পড়ে এবং আলোচনা চলে পাক্কা দুই বছর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আড়িপাতা সংক্রান্ত যে সব আইন-কানুন আছে ফ্যান্টম মোতায়েন ও কার্যকর হলে তা লঙ্ঘন করার দায়ে পড়তে হবে কিনা? মূলত তাই নিয়ে আলোচনা চলে। আইনজীবীরা আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক নিয়ে মেতে থাকলেও এনএসও’র সাথে পেগাসাস বিষয়ক চুক্তির মেয়াদ আবার বাড়ায় এফবিআই। এ জন্য মাশুল বাবদ এনএসওকে দিতে হয় ৫০ লাখ ডলার। এ সময়ে এনএসও প্রকৌশলীরা ঘনঘন এফবিআই কর্মীদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখে। প্রযুক্তিগত নানা বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান তারা। প্রযুক্তিগত কী ধরণের পরিবর্তন করা হলে তার আইনি প্রভাব কী হবে সে বিষয়ে পরিষ্কার অবস্থান নিতে চেয়েছেন এনএসও’র মানুষগুলো।
‘পেগাসাসে’র ফ্যান্টম সংস্করণ নিয়ে মার্কিন বিচার বিভাগ এবং এফবিআইয়ের আলোচনা গত বছরের গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত চলেছে। এনএসও নির্মিত সাইবার অস্ত্র মোতায়েন ও কার্যকর করা হবে না বলেই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় এফবিআই। এরই মধ্যে ফরবিডেন স্টোরিজ নামের সংবাদ সংস্থাগুলোর জোট এনএসও নির্মিত সাইবার অস্ত্র নিয়ে গা শিউরে ওঠার মতো খবর প্রকাশ করতে শুরু করে। ‘পেগাসাস’কে কীভাবে সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে যথেচ্ছ প্রয়োগ করা হয়েছে তাও প্রকাশ করতে থাকে ফরবিডেন স্টোরিজ। নিউ জার্সির এফবিআই ভবনে যে পেগাসাস বসানো হয়েছিল তা এখন সুপ্ত অবস্থায় আছে। বাংলাদেশে লোকমুখে প্রচলিত কথা ধার করে বলা যায়, ‘সাহেব এখন রেস্ট করছেন।’
এদিকে এফবিআই’র মুখপাত্র বলেন, এ সংস্থা নতুন প্রযুক্তি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে “ব্যবহারের ক্ষেত্রে শুধু আইনগত দিকগুলো খতিয়ে দেখার জন্যেই নয়, বরং অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করার এবং মার্কিন জনগণ এবং মার্কিন নাগরিক স্বাধীনতা উভয়ই সুরক্ষার জন্য।” এফবিআই নিয়মিতই প্রযুক্তি এবং সেবাখাতের মূল্যায়ন অব্যাহত রাখে। ভুল হাতে পড়লে এসব ব্যবস্থা নিরাপত্তা ক্ষেত্রে কী ধরণের ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে সেটি খতিয়ে দেখার কাজও এফবিআই করে বলে ওই মুখপাত্র স্বীকার করেন। কিন্তু মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, ডিইএ, সিক্রেট সার্ভিস এবং আফ্রিকা কমান্ড ‘পেগাসাস’ নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। জিবুতি সরকারের একজন মুখপাত্র বলেন, তার দেশ কখনোই ‘পেগাসাস’ কেনেনি বা ব্যবহারও করেনি।
নভেম্বরে মার্কিন প্রশাসন যে ঘোষণা দিল তাতে পেগাসাস নিয়ে তাদের ভূমিকা পুরোই ঘুরে গেল। অন্তত এনএসও’র সঙ্গে পেগাসাস নিয়ে আগের চুক্তির কথা যারা জানতেন তাদের কাছে সেরকমই মনে হলো। মার্কিন স্বার্থবিরোধী হিসেবে বাণিজ্য বিভাগের তালিকায় নাম উঠল এনএসও’র। মারণাস্ত্র তৈরিতে জড়িত দেশ বা প্রতিষ্ঠানের কাছে মার্কিন পণ্য বিক্রি ঠেকানোর জন্যেই গোড়াতে এ তালিকা করা হতো। সাম্প্রতিককালে এ তালিকায় বেশ কয়েকটি সাইবার অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানিরও নাম উঠেছে। এ তালিকায় নাম ওঠার কারণে এনএসও আর কখনোই মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ সেবা বা সামগ্রী কিনতে পারবে না।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষা শিল্পের নয়নমণি হয়ে উঠেছিল এনএসও। ডেল কম্পিউটার এবং অ্যামাজন ক্লাউড সেবার মতো মার্কিন প্রযুক্তি ছাড়া এনএসও’র তৎপরতা অচল হয়ে পড়ার হুমকি দেখা দেয়। তাছাড়া, প্রকাশ্যে এমনভাবে এনএসওকে মার্কিন সরকারের তিরস্কারের বিষয়টি হজম করতে পারেনি তেল আবিবও। মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের তালিকায় এনএসও’র নাম ওঠার বিষয়টি প্রকাশ্য ঘোষণা দেওয়ার মাত্র এক ঘণ্টা আগে জানানো হয় ইসরাইলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে। এতে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা কর্তারা রেগে আগুন হয়ে ওঠেন। মার্কিন খবরের বেশিরভাগ শিরোনামে এনএসওকে নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত বেসরকারি কোম্পানি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কোম্পানিটি ইসরাইলে অবস্থিত হলেও এর বেশিরভাগ তহবিলের যোগান আসে বিদেশ থেকে। তবে তেল আবিবের কর্তৃপক্ষের ভাবভঙ্গি থেকে মনে হয় খোদ ইসরাইলের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত ইসরাইল ন্যাশনাল সাইবারের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনকারী ইয়ে-গাল উন্না দাবি করেন, “মানুষ তাদের তীর ছুঁড়ছে এনএসওকে লক্ষ্য করে কিন্তু আসলে তাদের লক্ষ্যবস্তু এনএসও’র পেছনের নীল-সাদা (ইসরাইলি) পতাকা।”
মার্কিন দ্বিচারী নীতিকে কেন্দ্র করেই অংশত ক্ষোভে ফেটে পড়েছে ইসরাইল। এনএসও পণ্য নিয়ে আমেরিকা বহু বছর ধরে গোপনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও অন্তত একটি দেশ, জিবুতিকে ‘পেগাসাস’ কেনার অর্থ জুটিয়েছে আমেরিকা। তারপরই হঠাৎ করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা খড়গ নেমে এলো এনএসও’র ঘাড়ে!
একই সাথে তেল আবিবের নিজের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিও জড়িয়ে রয়েছে। এ বিষয়টি সম্পর্কে আগে তেমন জানা যায়নি বা বোঝা যায়নি। ইসরাইলের রপ্তানি-লাইসেন্স প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এনএসও বা এ জাতীয় নিরাপত্তা পণ্য বিক্রির বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। কোন দেশের কাছে এ পণ্য বা সেবা বিক্রি করা যাবে বা যাবে না তা নির্ধারণ করার জন্য ইসরাইল নিজস্ব জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলকে বেছে নেয়। বহু বছর ধরে এ কাজটি করলেও তা আগে টের পাওয়া যায়নি।
নিউ ইয়র্ক টাইমস অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে যেয়ে এক বছর ধরে অনেকগুলো দেশের বহু সরকারি কর্মকর্তা, গোয়েন্দা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নেতা, সাইবার অস্ত্র বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার দাবিতে তৎপর ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নেয়। আর এর মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে কীভাবে কূটনীতির কামধেনু হিসেবে এনএসও’র সাইবার অস্ত্র ব্যবহার করছে ইসরাইল। নিজের কূটনৈতিক কামনাকে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োগ করছে এনএসওসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রির বিষয়টি। ‘পেগাসাস’ পাওয়ার পর মেক্সিকো এবং পানামার মতো দেশের কূটনৈতিক অবস্থান বদলে যায়। জাতিসংঘে গুরুত্বপূর্ণ ভোটাভুটির সময় ডিগবাজি খেয়ে তারা ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নেয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এও উঠে আসে যে কীভাবে ‘পেগাসাসে’র বিক্রির মধ্যদিয়ে ইরান বিরোধী ইসরাইলি প্রচারণায় আরব দেশগুলোর সমর্থন নিশ্চিত করতে পেরেছে তেল আবিব। এমনকি দীর্ঘ দিনের শত্রু হিসেবে বিবেচিত কয়েকটি আরব দেশের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা হয় ২০২০ সালের আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে প্রকাশ পায় যে এ ক্ষেত্রেও চোখের আড়ালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল ‘পেগাসাস।’
প্রভাব বৃদ্ধির জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে ইসরাইল অন্যদিকে নগদ লাভের আশায় হন্যে এনএসও। এই দুইয়ের মহামিলনের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী গুপ্তচরবৃত্তির এ হাতিয়ারের ঠিকানা হয় বিশ্বব্যাপী নতুন প্রজন্মের জাতীয়তাবাদী নেতাদের অস্ত্র ভান্ডার। যদিও পেগাসাস বিক্রির ক্ষেত্রে তেল আবিবের নজরদারি বহাল ছিল। শক্তিশালী এই গোয়েন্দা সফটওয়্যার যেন দমন কর্মকাণ্ডে ব্যবহার না হয় সেটা রোধ করাই ছিল এ নজরদারির একান্ত লক্ষ্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানবাধিকার রক্ষা নিয়ে সন্দেহজনক অবস্থান সত্ত্বেও ‘পেগাসাস’কে বিক্রি করা হয় পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং ভারতে।
এসব পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধারাবাহিক কিছু হিসাব-নিকাশ কষেছে। গোপনে কোম্পানিটির প্রযুক্তি অর্জন করেছে। খতিয়ে দেখেছে এবং স্থাপন পর্যন্ত করেছে। এমনকি প্রকাশ্যে এনএসও’র নিন্দাও করেছে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকান সরবরাহকারীরা যেন ‘পেগাসাসে’র নাগাল না পায় সে চেষ্টাও করেছে। এনএসও নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের মধ্যে বর্তমানে তীব্র টানাপোড়েনের জন্ম দিয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, দীর্ঘকাল ধরে জঙ্গি বিমান এবং সেন্ট্রিফিউজের মতো সামরিক সাজ-সরঞ্জামকে যে দৃষ্টিতে দেখেছে সে একই নজরে দেখছে সাইবার যুদ্ধের শক্তিশালী পণ্যকেও। এগুলো কেবল জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং বিশ্বজুড়ে প্রভাব কেনার মুদ্রা হিসাবেও গণ্য হতে পারে।