কার সাথে থাকবেন মোদি?
২০১৪ সালে তার প্রথম বিদেশ সফরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নেতাদের একত্রিত করে একটি ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ব্রাজিলের ফোর্তালেজায় গেলে পুতিনকে মোদি বলেছিলেন, ‘এমনকি ভারতীয় একটি শিশুকেও যদি বলতে বলা হয় যে ভারতের সেরা বন্ধু কে, সে উত্তর দেবে রাশিয়া কারণ রাশিয়া সঙ্কটের সময়ে ভারতের সাথে ছিল।’
এরপর মোদি ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমের কাছে আরো ঘনিষ্ঠ করতে চেয়েছেন এবং রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের অধীনে চীনের সাথে এক গভীর দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন। এর অর্থ হলো মোদিকে এখন রাশিয়ার সাথে আরো জটিল সম্পর্ক পরিচালনা করতে হবে। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের সাম্প্রতিক এক বৈঠকে ভারত তালেবানের জন্য কিছু কঠিন দাবি পেশ করতে তিনটি পশ্চিমা শক্তি-যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সাথে জোট করে। বিপরীতে, আফগানিস্তান সংক্রান্ত প্রস্তাবের ভাষাকে রাশিয়া হালকা করার চেষ্টায় চীনের সাথে যোগ দেয় এবং এতে ভোটদানে বিরত থাকে। নয়াদিল্লি এবং মস্কোর মধ্যে এ ধরনের বিচ্ছিন্নতা কার্যত কল্পনাতীত ছিল।
মোদি অবশ্য ওয়াশিংটনের চাপ সত্ত্বেও রাশিয়ার সাথে দীর্ঘদিনের অংশীদারিত্ব ত্যাগ করতে ইচ্ছুক নন। তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের সম্পর্কের বিষয়ে রাশিয়াকে ভেটোর সুযোগ দিতেও প্রস্তুত নন, যা অতীতের মতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দাবি করতে পারে। মোদি আরো সচেতন যে চীনের সাথে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান কৌশলগত অংশীদারিত্বের বিষয়ে তার কোনো ভেটো নেই, যা মস্কো এবং বেইজিং ওয়াশিংটন থেকে উপলব্ধি করা হুমকি দ্বারা চালিত।
মস্কোর সাথে সম্পর্কের প্রতি নয়াদিল্লির আবেগপূর্ণ সংযুক্তি স্থিরভাবে দুই দেশের ক্রমবর্ধমান ভিন্ন আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক গতিপথ সম্পর্কে মোদি প্রশাসনের বাস্তববাদের অনুভূতি দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। মহাশক্তিগুলোর সম্পর্কের অস্থিরতার মধ্যে মোদি এই নতুন অসঙ্গতির উৎসকে শান্তভাবে পরিচালনা করতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। রাশিয়াও ধারণা করে, দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মোদির গভীর কৌশলগত সহযোগিতায় বাধা দিতে পারে না, যা এখন আর কেবল দ্বিপক্ষীয় বিষয় নয়। মস্কো অবশ্যই কোয়াড নিরাপত্তা সংলাপে নয়াদিল্লির ক্রমবর্ধমান ভূমিকা দেখে হতাশ, যা ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর প্রধান প্রশান্ত মহাসাগরীয় মিত্র জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে জোটবদ্ধ করছে।
নিরাপত্তা পরিষদ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পর্যন্ত বহুপক্ষীয় ফোরামে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সাথে ভারতের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার কথাও মস্কো উল্লেখ করেছে। যদিও ভারত ব্রিকসের মতো পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরের ফোরামগুলোতে অংশগ্রহণ করে চলেছে। তবে কোয়াড ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরো বেশি প্রাধান্য অর্জন করে আসছিল।
মস্কো সচেতন যে নয়াদিল্লি এবং বেইজিংয়ের মধ্যে তীক্ষ্ণ দ্বন্দ্ব ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং ভারত-চীনা মিথস্ক্রিয়া ও আস্থা তৈরিতে ব্রিকস ফোরাম ব্যবহারের আশা করছে। কিন্তু নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে বিরোধ এখন গভীর কাঠামোগত। এটি রাশিয়াকে ভারত ও চীনের সাথে তার সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টাকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দিতে পারে।
রাশিয়া চীনের সাথে অংশীদারিত্বকে আরো গভীর করছে, যেটি ভারতের সাথে সম্পর্কের চেয়ে ভূ-কৌশলগত এবং অর্থনৈতিকভাবে বেশি ওজনদার হয়ে উঠেছে। যদিও মস্কো নতুন দিল্লিকে ছাড়ছে না। হিমালয় সীমান্তে চলমান চীন-ভারত সামরিক সঙ্কটের সময়, রাশিয়া ভারতে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করলে চীন অসন্তুষ্ট হলেও তা বন্ধ করেনি। সহজ কথায়, নয়াদিল্লি এবং মস্কো উভয়েই ওয়াশিংটন এবং বেইজিংয়ের সাথে নিজ নিজ সম্পর্কের পরিবর্তনশীল গতিশীলতায় খাপ খাইয়ে নিতে চাইছে।
ভারত নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরো বেশি সম্পর্কযুক্ত হতে শুরু করে, তবে এটি একমেরুভিত্তিক বিশ্ব পরিস্থিতির বিপদ সম্পর্কে গভীরভাবে শঙ্কিত ছিল। কাশ্মির নিয়ে পাকিস্তানের সাথে ভারতের বিরোধের সমাধানে ক্লিনটন প্রশাসনের সক্রিয়তা এবং নয়াদিল্লির পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ফিরিয়ে আনার উপর তার মনোযোগ হয়তোবা ভারতকে মস্কোর অংশীদারিত্ব ধরে রাখতে বাধ্য করেছিল। পাকিস্তানের সাথে ক্রমাগত সামরিক উত্তেজনা এবং সোভিয়েত ও রাশিয়ান অস্ত্রের ওপর ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর নির্ভরতা এটিকে দ্বিগুণ বিচক্ষণ কৌশলে পরিণত করেছে।
মার্কিন শক্তিকে সীমিত করতে রাশিয়া একটি বৃহত্তর আদর্শিক প্রকল্পে আগ্রহী ছিল। এর নির্বাচিত যন্ত্রটি ছিল চীন ও ভারতের সাথে একটি নতুন জোট যা একটি বহুমুখী বিশ্বকে উন্নীত করবে। নব্বইয়ের দশকে চালু হওয়া একটি ত্রিপক্ষীয় ফোরাম শেষ পর্যন্ত ব্রিকসে প্রসারিত হয়।
এদিকে, চীনের সাথে ভারতের ক্রমবর্ধমান সমস্যা বেইজিংয়ের প্রতি নয়াদিল্লির নিরপেক্ষ মনোভাবের একটি বড় পরিবর্তনে বাধ্য করেছে। চীনের ভারসাম্য রক্ষায় ভারত অবশ্যম্ভাবীভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর প্রশান্ত মহাসাগরীয় মিত্রদের দিকে ঝুঁকেছে। বেইজিংয়ের উপস্থাপিত চ্যালেঞ্জগুলোর জন্য ওয়াশিংটন জেগে উঠলে, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বদর্শনে ভারত বৃহত্তর কৌশলগত অগ্রগতি অর্জন করতে শুরু করে। এটি ভারতকে ওয়াশিংটনের নতুন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের কেন্দ্রে রাখার ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয়েছিল।
ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান ইন্দো-রাশিয়ান বিরোধ যদি চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে হয়, তবে পাকিস্তান ঘিরে আফগানিস্তানের ওপর বিচ্ছিন্নতা, এমন একটি ফ্রন্ট যা ভারতের জন্য সংবেদনশীল এবং অনেক বেশি তাৎক্ষণিক। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অপমানজনক পশ্চাদপসরণে ভারতের উদ্ভূত নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন দিল্লি। দুই দশকের মার্কিন সামরিক উপস্থিতি আফগানিস্তানে ভারত নিজস্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রোফাইল উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত করেছিল। পাকিস্তানের সমর্থনে তালেবানের ফিরে আসার পর আপাতত সেখানে এর কার্যক্রম বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। এতে পাকিস্তানকে বিখণ্ড করার কথিত গোপন অ্যাজেন্ডা সামনে আগানো সম্ভবত কঠিন হবে।
গত কয়েক বছর ধরে, রাশিয়া তালেবানের সাথে সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে এবং আফগানিস্তান সংক্রান্ত বিষয়ে পাকিস্তানের সাথে সমন্বয় করেছে। তালেবানের ওপর নয়াদিল্লির স্বল্পপ্রভাব থাকার যুক্তি দেখিয়ে ভারতকে আফগানিস্তানের পরিবর্তন প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়েছে। যদিও দিল্লিতে অনুষ্ঠিত আফগানবিষয়ক জাতীয় নিরাপত্তা সম্মেলনে রাশিয়া মধ্য এশীয় মিত্রদের সাথে নিয়ে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু এরপর ইসলামাবাদের আফগান সম্মেলনেও মস্কো অংশগ্রহণ করেছে। মস্কো বিশ্বাস করে যে ইসলামাবাদ এবং তালেবান মধ্য এশিয়ায় তার দক্ষিণ অংশে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলোকে আরো ভালোভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করবে। নয়াদিল্লি ধারণা করে যে তালেবান নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তান আবারো পাকিস্তানের সমর্থনপুষ্ট ও উৎসাহিত ভারতবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর আবাসস্থল হয়ে উঠবে।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডের সাবেক সদস্য সি. রাজা মোহনের পর্যবেক্ষণটি এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, ‘অতীতে, নয়াদিল্লি রাশিয়ার সংবেদনশীলতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। ভারত এ অঞ্চলের কয়েকটি দেশের মধ্যে ছিল যেগুলো ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান আক্রমণে সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে ইচ্ছুক ছিল না। আজ, মোদি এবং তার পররাষ্ট্র নীতি উপদেষ্টারা ইন্দো-প্যাসিফিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাশিয়ার সাথে মতপার্থক্য প্রকাশ করতে আর অস্বস্তিকর নন। কোয়াড এবং আফগানিস্তান নিয়ে নয়াদিল্লি এমন একটি কৌশলে পৌঁছেছে যা মস্কোর সাথে সম্পর্ককে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে যেখানেই সম্ভব সহযোগিতা সম্প্রসারণ করে, আর পার্থক্য লুকিয়ে রাখে না। … ভারত ব্রিকস গোষ্ঠী এবং রাশিয়া ও চীনের আধিপত্যে থাকা অন্যান্য বহুপক্ষীয় ফোরামে অংশগ্রহণ অব্যাহত রেখেছে, পরেরটির সাথে আগের এবং চলমান দ্বন্দ্বের সাথে প্রকাশ্য পার্থক্য সম্পর্কে কোনো উদ্বেগ ছাড়াই। একই সময়ে, নয়াদিল্লি কোয়াড কাঠামোকে শক্তিশালী করতে জোর দিচ্ছে। এটি এমন একটি ভারতীয় কৌশল যা যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমের সাথে ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্বের বিষয়ে আর প্রতিরক্ষামূলক নয় যা এ মাসে সম্পূর্ণ প্রদর্শনের মধ্যে থাকবে।’
বৈশ্বিক পরিস্থিতি এ সময়ে যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে; তাতে রুশ-চীন আর মার্কিন দু’পক্ষের প্রতিযোগিতা স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের চেয়েও বেশি উত্তেজনাকর অবস্থায় পৌঁছেছে। এ সময়ে দু’পক্ষের সাথে একই সাথে থাকাটা দিল্লির পক্ষে কতটা সম্ভব হবে তা বলা কঠিন। রাশিয়ার সাথে প্রতিরক্ষা সম্পকের্র নতুন পর্যায় কোনোভাবে একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিতে পারবে না। এ বাস্তবতায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় নতুন মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা জোট অকাসের জন্ম হয়েছে, যেখানে ভারত সদস্য নয়। ভারতের চীনের সাথে দ্বন্দ্ব ও রাশিয়ার সাথে অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এক সাথে চলবে বলেও মনে হয় না। কোয়াডে ভারতে সাম্প্রতিক নিষ্ক্রিয়তায় সেটি স্পষ্ট হয়। নতুন অবস্থায় ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সম্পর্কে ভাটা অনিবার্য হয়ে উঠবে। চীন থেকে পশ্চিমা বিনিয়োগ যেভাবে ভারতমুখী হওয়ার কথা সেটি হবে না। এমনকি এম-৪০০ কেনার জন্য যে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হচ্ছে সেটিও আরোপিত হতে পারে। এটি হলে তুরস্কের চাইতেও বেশি চাপে পড়বে ভারত। একই সাথে আমেরিকা বিনিয়োগ ক্ষেত্র ও কৌশলগত মিত্র খোঁজার জন্য বিকল্প সন্ধানে সক্রিয় হতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্নায়ুযুদ্ধ সময়ের পাক-মার্কিন সম্পর্কের যুগ ফের যদি ফিরে আসে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। আর বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার তুলনামূলক ছোট দেশগুলোর গুরুত্ব বাড়বে।