তালেবানের সামনে যত চ্যালেঞ্জ
তালেবানদের কাছে কাবুলের পতন রাজনৈতিক পণ্ডিতদের হতবাক করেছে, মার্কিন সেনাধ্যক্ষ বলছেন, হিসাবের অঙ্ক ভুল হয়ে গেছে! কাবুলের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার পর তালেবানরা এখন বিভিন্ন দিক থেকে একাধিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
অর্থনৈতিক বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক অর্থের প্রবাহ। দীর্ঘ যুদ্ধকালীন সময়ে আফগানিস্তানকে ব্যাপকভাবে বিদেশী অর্থের ওপর নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে। আফগানিস্তানের মোট আয়ের ২০ শতাংশ বিদেশী সহায়তা। সেগুলো এখন বন্ধ। উপরন্তু আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৯.৫ বিলিয়ন ডলার ফ্রিজ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কর্মসূচি স্থগিত করায় পরিস্থিতি তীব্রতর হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যখন নগদ অর্থ ও মানবিক সহায়তা দরকার সেখানে অর্থসম্পদ আটক করে রাখা হয়েছে, যা চরম ন্যক্কারজনক। আফিম বাণিজ্য তালেবানদের ৩০০ মিলিয়ন থেকে ১.৬ বিলিয়ন ডলার দিতে পারে। বার্ষিক বাজেটের জন্য ৫.৫ বিলিয়ন ডলার দরকার। বিশ্লেষকরা মনে করেন চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তান ও ইরান আর্থিক সহায়তা দিয়ে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ কাজে লাগাবে।
আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকরা চলতি বছর ১৩ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের জন্য প্রায় এক বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব গুতেরেস আফগান শিশু ও অন্যান্য দুর্বল জনগণকে অনাহার থেকে রক্ষার জরুরি আবেদন জানানোর পর এই প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। তবে গুতেরেস কমপক্ষে ৬০৬ মিলিয়ন ডলার চেয়েছিলেন।
মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ ও ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) বলেছে, দেশটি আফগানিস্তানকে ৬৪ মিলিয়ন ডলার দেবে যাতে ‘নিরাপত্তাহীনতা, সংঘর্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কোভিড-১৯ মহামারীর জটিল প্রভাবের মুখোমুখি আফগানদের সরাসরি জীবনরক্ষাকারী সহায়তা দেয়া হয়।’ ইউনিসেফের হেনরিয়েটা জানান, ১০ লাখ আফগান শিশু পুষ্টিহীনতার মুখে পড়বে।
তালেবানরা নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর তিন কোটি ৮০ লাখ লোকের আফগানিস্তান বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত সম্পদ পরিচালিত সহায়তা প্রকল্প থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) অনুমান করেছে, আফগানরা এ বছর ৪০ শতাংশ ফসল হারিয়েছে; তাই গমের দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
পাকিস্তান অনেক আগে খাদ্য ও ওষুধ পাঠিয়েছিল, ইরান মানবিক সহায়তা পাঠিয়েছে। তুরস্ক পাকিস্তানের মাধ্যমে শুকনো খাবার পাঠিয়েছে। চীন ৩১ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো প্রশাসন। তালেবানদের দেশ পরিচালনার টেকনোক্র্যাটিক অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। সরকারি পরিষেবা ও অর্থনৈতিক বিষয় পরিচালনার জন্য দরকার সুদক্ষ ও পেশাদার লোকবল। অনেক পেশাদার তালেবানের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।
তৃতীয় বিষয়টি তালেবান গোষ্ঠীর ভেতরকার ভিন্নমত। একটি চরমপন্থী মানসিকতা এবং অন্যটি মধ্যপন্থী। যেমন- সামরিক নেতা সিরাজউদ্দিন হাক্কানি চরমনীতির প্রবক্তা এবং সামরিক প্রধান মোহাম্মদ ইয়াকুব ও জুরিস্ট আবদুল হাকিম মধ্যপন্থী। তালেবান নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা সংঘর্ষ এড়াতে ইয়াকুব ও হাক্কানির মধ্যে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ বিভক্ত করেছেন। এটি তেমন ভালো কাজ হয়নি।
চতুর্থ হলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। তালেবানদের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ নীতির ওপর কাজ করতে হবে। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার এবং নারী ও সংখ্যালঘুদের বিশেষ অধিকার দেয়া। তাদের আরো নিশ্চিত করতে হবে যে, আফগান মাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না সেটি যত তিক্তই হোক।
পঞ্চম চ্যালেঞ্জটি হলো সরকার ও সংবিধান। তালেবানরা গণতন্ত্রের পশ্চিমা ধাঁচকে অনুসরণ করছে না, সিদ্ধান্ত ও নীতির জন্য সুপ্রিম স্টেট কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কাউন্সিল একজন আমিরের অধীনে কাজ করবে, তবে সংবিধান সম্পর্কে অনেক কথা রয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছিল, ইরানি মডেল অনুসরণ করবে, এখন সেই অবস্থানে নেই। বেশি প্রচারিত হয়েছিল ‘আফগানিস্তান ইসলামিক আমিরাত’ হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, আফগানিস্তান কিংডম বা বাদশাহর শাসন হচ্ছে, এটি বেশ অবাক করা কথা। কিং জহির শাহের সময় যে সংবিধান ছিল, সেটি আবার চালু করা হবে।
আমরা দেখেছি আজ পর্যন্ত আফগানিস্তানে আটটি সংবিধান রচিত হয়েছে। সর্বশেষ সংবিধানটি ২০০৪ সালে বানানো হয়। আফগানিস্তানের প্রথম সংবিধানটিকে ‘নিজামনামা’ বলা হতো। এক হাজার ডেলিগেট ১৯২৪ সালে এটি অনুমোদন করেছিলেন, এর সাত বছর পর নাদির শাহের প্রশাসন আসে। তিনি একটি সংবিধান তৈরি করেন সেটি দ্বিতীয় সংবিধান। ওখানে যে মৌলিক বিষয় ছিল তাতে ‘ইসলামী সরকার’ বা ইসলামী হুকুমতের কথা ছিল, ওই সংবিধানে ১১০ আর্টিকেল ছিল, সংবিধানের সব কিছুই ইসলামী ও ইসলামী আইনকানুনকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। এরপর ১৯৬৪ সালে আসে জহির শাহের সংবিধান। সেখানে ১১ চ্যাপ্টার ও ১২৮ আর্টিকেল স্থান পায়। এরপর আসেন প্রেসিডেন্ট দাউদ, ১৯৭৩ সালে তিনিও একটি সংবিধান রচনা করেন যেখানে ১৩ চ্যাপ্টার ও ১৩৬ আর্টিকেল সংযুক্ত করা হয়। মানে যিনি আসেন তিনি একটি সংবিধান রচনা করে দেশ পরিচালনা করেছেন। ১৯৭৮ সালে দাউদের পতন হয়েছিল। বারবাক কারমাল যখন আসেন তখনো নতুন সংবিধান বানানো হয়, সেখানে যে মূলনীতি ছিল সেখানে দেশকে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব আফগানিস্তান বলা হয়েছে। ১৯৮০ সালে এই সংবিধানে কিছু সংশোধন করা হয়। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা আক্রান্ত ছিল আফগানিস্তান। বারবাক কারমালের সাত বছর পর ড. নাজিবুল্লাহ আসেন। তিনি আর একটি সংবিধান বানান, সেখানে ১৩ চ্যাপ্টার ও ১৩৯ আর্টিকেল ছিল। তিন বছরের মধ্যে এই সংবিধান তিনবার অ্যামেন্ডমেন্ট করা হয়।
সোভিয়েত বাহিনী যখন দেশ ছেড়ে চলে যায়, তখন বহুদিন পর্যন্ত দেশে কোনো সংবিধান ছিল না। হামিদ কারজাইয়ের আমলে সংবিধান বানানো হয়। ২০০৪ সালে কিছু পরিবর্তন করা হয়। নাদির খান ও দাউদ খান যে সংবিধান বানিয়েছিলেন, সেগুলোকে দেশের সবচেয়ে ‘বাজে সংবিধান’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সব শাসক নিজের সুবিধামতো সংবিধান বানিয়েছেন। অন্য দিকে ১৯৯৮ সালে তালেবানরা ক্ষমতায় থাকার সময় প্রথম সংবিধান সম্পাদনা করেন, যাকে ‘দস্তুর এমারাত ইসলামী’ বলা হয় এবং দ্বিতীয়টি ‘মনশুর এমারাত ইসলামী আফগানিস্তান’ যা ২০২০ সালে ফাঁস হয়েছিল; কিন্তু তালেবানরা এটিকে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করেনি।
লক্ষণীয় বিষয়, সংবিধান সম্পর্কে তালেবান অ্যাক্টিং মিনিস্টার অব জাস্টিসের সাথে চীনা দূতের সাক্ষাৎ ঘটে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে। আলোচনায় আসে যে, বাদশাহ জহির শাহের আমলের সংবিধান অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য চালু রাখা হবে। ইসলামী শরিয়াহ বা আমিরাতের নিয়ম ধারাবিরোধী বিধি এবং আন্তর্জাতিক আইনের নিয়মকানুন যা শরিয়তবিরোধী নয়; সেসবও মেনে চলবে। তা হলে অবস্থা দাঁড়াচ্ছে- খেলাফতের যিনি আমিরুল মুমিনিন তিনি আপাতত বাদশাহের মতোই কাজ করবেন। কেননা সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপ্রধান একজন বাদশাহ বা রাজা। এখানে ইসলামী আমিরাতে তালেবানদের সূক্ষ্মবুদ্ধি কাজ করছে। তবে পুরো বিষয়টি এখনো দেখার মতো অবস্থায়। কখন কোন দিকে মোড় নেয়, তা বলা দুষ্কর।
ষষ্ঠ চ্যালেঞ্জটি প্রতিপক্ষ বাহিনী থেকে উদ্ভূত। আইএসকেপি ইস্যু। তালেবান ও আইএস উভয়ই সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী, কিন্তু তারা মিত্র নয়, প্রতিদ্ব›দ্বী। আইএসের উদ্দেশ্য আফগানিস্তানে আইএস খোরাসান প্রদেশ প্রতিষ্ঠা করা। আইএস ও তালেবান ২০১৫ সাল থেকে আফগানিস্তানে আইএস প্রবেশের সময় থেকে যুদ্ধে রয়েছে।
বিশ্লেষকরা তালেবানকে আইএসের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে দেখছেন। আফগানিস্তানে আইএসের উপস্থিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের জন্য একটি সাধারণ সম্পর্কের ভিত্তি রচনা করে ফেলেছে। ক’দিন আগে দোহা আলোচনায় আইএস দমনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কমান্ডো পাঠানোর প্রস্তাব উঠিয়েছে। তালেবানরা বাইরের শক্তির প্রয়োজন নেই বলে সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
সপ্তম চ্যালেঞ্জ কাবুলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির অভ্যন্তরে দেখা দিয়েছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। ফলে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি আরো অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ক’দিন আগে হামিদ কারজাই বিমানবন্দরের বাইরের গেটে আরেক দফা ভয়াবহ বোমা হামলাকে তারই অংশ মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
আফগানিস্তানে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা একাধিক স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা দফতরের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তালেবানের সবগুলো ফ্রন্ট একাট্টা হয়ে লড়লেও যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা চলে আসায় সে লক্ষ্যের সমাপ্তি ঘটেছে। সরকার গঠনের সময় গোষ্ঠীটির বিভিন্ন ফ্রন্টের নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। ফলে তারা রাজনৈতিক সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েছে।
অষ্টম সমস্যাটি গুরুতর। বুঝতে হবে, আফগান যুদ্ধ শেষ হয়নি, ফর্ম পরিবর্তন হয়েছে। মূলত আফগানিস্তান থেকে মার্কিনিরা কখনো বের হতে পারবে না। ডেনিয়েল মার্ক তার বইতে এরকম কথা বলেছিলেন, ‘নো এক্সিট ফর্ম পাকিস্তান’। কাবুল ও এ অঞ্চল থেকে আমেরিকানরা যেতে পারবে না। কেন? সোজা উত্তর- চীন ও অংশত রাশিয়া। মার্কিন সমরবিশারদরা মনে করেন, চীনের সাথে সমুদ্রে যুদ্ধের চেয়ে ভূস্থলের যুদ্ধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। সেই ভ‚ভাগ মার্কিনিদের প্রয়োজন। এখন যত প্রিয় বা অপ্রিয় হোক, ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে পারে না একই কারণে। একই সাথে আরেক বিরাট আফগানিস্তান তৈরি হচ্ছে মধ্য এশিয়াজুড়ে। রাশিয়া অনেকটা কব্জা করে রেখেছে সব ক’টি দেশ। চীন ও আমেরিকাও সেখানে নিজের স্বার্থ রক্ষায় বিবিধ কর্মসূচি রেখেছে বহুদিন ধরে। এখন চীন মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানে ঢুকছে। মার্কিনিদের মাথাব্যথার কারণ পাকিস্তানও কম নয়- দেশটি পরমাণু শক্তিধর । এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিশাল এই মাঠ ছেড়ে দিতে পারে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানকে লক্ষ্য করে আশপাশেই থাকবে। আফগান সীমান্ত থেকে মাত্র ২০০ মাইল দূরে তাজিকিস্তানে ভারতের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। সেটি ড্রোন ঘাঁটি; এই ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। রাশিয়াও এ বিষয়ে সবুজ সঙ্কেত দেখিয়েছে। আবার তাজিকিস্তানের সাথে তালেবানদের ভালো সম্পর্ক নেই।
তাজিক-আফগান সীমান্তে যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থাটি নবম সমস্যা। আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এই বিবাদ শুরু হয়েছে। তালেবানরা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য তাজিকের নিন্দা জানিয়েছে। আহমেদ মাসউদ ও সাবেক আফগান ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ উভয়ই জাতিগতভাবে তাজিক। দুই নেতাই বর্তমানে তাজিকিস্তানের আশ্রয়ে রয়েছেন। সাবেক আফগান সরকারি কর্মকর্তাদের নিরাপদ আশ্রয় ও সহায়তা দিয়েছে তাজিকিস্তান। পাঞ্জশির উপত্যকায় তালেবানবিরোধী প্রতিরোধ বাহিনীকে তাজিক সরকার সহায়তা করছে বলেও জানা গেছে। পাকিস্তান হস্তক্ষেপ না করলে পাঞ্জশির জয় সহজ হতো না।
এ দিকে তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এমোমালি রাহমন কাবুলে তালেবান নিযুক্ত মন্ত্রিসভাকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছেন। পাঞ্জশির প্রদেশে তালেবানদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও করেছেন তিনি। এক ভাষণে তিনি আফগানিস্তানের পরিস্থিতিকে ‘অস্থিতিশীল’ বলেছেন।
জাতিগত তাজিকরা আফগানিস্তানের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশেরও বেশি। তালেবান সদস্যরা প্রধানত সবচেয়ে বড় জাতিগত গোষ্ঠী পশতুনদের অন্তর্ভুক্ত। রেষারেষি ও উত্তেজনার মধ্যে তালেবান-তাজিকরা যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হলে কেউ সমর্থন পাবে না। তাজিকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এমোমালি রাহমন অভিযোগ করেছেন, বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আফগানিস্তানে সক্রিয় থাকায় আবারো দেশটি সন্ত্রাসবাদের প্লাটফর্ম হতে পারে।
উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানের তাখার প্রদেশ তাজিকিস্তানের সাথে আফগান সীমান্ত। তাজিকিস্তানের গোর্নো-বাদাখশান স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে রাশিয়ান সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। ভারতেরও শক্তিশালী বিমান ঘাঁটি রয়েছে ওই অঞ্চলে। ভারতের তীর পাকিস্তানের দিকে হলেও এখন পুরো এলাকা তাদের লক্ষ্যবস্তু। উল্লেখ্য, ভারত, রাশিয়া ও তাজিকিস্তান তালেবান সরকারের সমালোচনা করে চলেছে এবং কেউ স্বীকৃতি দেয়নি। কাবুলকে চাপে রাখতে তালেবান-সীমান্তে উসকানি তাজিকিস্তানের একটি কৌশল।
তালেবানের সামনে রয়েছে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ। আমরা মাত্র ক’টি বিষয়ে আলোচনা করেছি। আরো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে- হাজরা নিয়ে ইরানের সাথে বিরোধ, পাকিস্তানের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে নতুন বিরোধের সূত্রপাত, পাকিস্তানের তেহরিকে তালেবান ইস্যু; নারীদের সমতা-ক্ষমতা-শিক্ষার আন্দোলন, মানবিক সহায়তার দ্বার উন্মুক্তকরণ, খাদ্যাভাব দূর করা, দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা, বিদেশে আফগানিস্তান থেকে পলানো বিভিন্ন পেশাজীবীদের তালেবানবিরোধী প্রচারণা বন্ধ করা, শীতকালীন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, নিজেদের মধ্য দ্ব›দ্ব নিরসন।
আফগানিস্তানে ক্ষমতার দৌড়ে এগিয়ে থাকতে যে দু’টি ফ্রন্ট বেশি তৎপর, তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে তালেবানের হেলমান্দভিত্তিক ফ্রন্ট, অন্যটি হাক্কানি নেটওয়ার্ক। হেলমান্দভিত্তিক ফ্রন্টের দাবি, মার্কিন ড্রোন হামলায় তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যাপক প্রাণহানি সত্ত্বেও তারা লড়াই চালিয়ে গেছে। ফলে তাদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে, ন্যাটো সেনাদের ফেলে যাওয়া সামরিক সরঞ্জাম প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রন্টগুলো গোপনে সরিয়ে নেয়া নিয়ে তালেবান নেতৃত্বের অস্বস্তি দূর করে শান্তি সমঝোতা স্থাপন, পদবঞ্চিত তালেবান নেতাদের সমঝোতাকরণ, অতি-রক্ষণশীল কট্টরপন্থীদের শরিয়াহ আইনের কঠোর সংস্করণ প্রয়োগ ও মধ্যপন্থীদের কিছুটা ছাড় দেয়ার মনোভাব নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই তালেবানদের বিভাজনের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যারা দালালি করেছে, সেসব নাগরিককে তালেবানের জ্যেষ্ঠ নেতারা ক্ষমা করলেও তালেবানের অন্য ফ্রন্টগুলো ও যোদ্ধারা তা মানতে চান না। ফলে যেকোনো সময় সায়গনের মতো ‘ঠাণ্ডা হওয়ার পর আবার রক্ত প্রবাহের’ আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব নিয়ে তালেবানের নাভিশ্বাস উঠছে। যেকোনো ইস্যুই আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদে অশান্তির কালো আবরণ উন্মুক্ত করতে পারে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার