বধ্যভূমি সংরক্ষণ: দেড় বছরে একটি ইটও লাগেনি
মহান মুক্তিযুদ্ধের ২৭১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য দেড় বছর আগে ৪৪২ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের অধীন কোথাও একটা ইটও লাগেনি।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এখন পর্যন্ত প্রকল্পের জন্য জমিই চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। এই মুহূর্তে এর কোনো প্রকল্প পরিচালকও নেই। এই অবস্থায় কবে নাগাদ কাজ শুরু করা যাবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীও।
‘১৯৭১–এ মহান মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার জন্য ব্যবহৃত বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন সিদ্ধান্ত হয়, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০২১ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এই প্রকল্পের প্রস্তাবের (ডিপিপি) নকশা অনুযায়ী প্রতিটি বধ্যভূমির জন্য ১৯ শতাংশ জমি লাগবে। মন্ত্রণালয় থেকে জেলাগুলোতে চিঠি দিয়ে জমিও চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু জেলা প্রশাসকেরা চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, এই পরিমাণ জমি পাওয়া যাচ্ছে না। পরে ৯ ডিসেম্বর জমি পাওয়ার সংকটকে বিবেচনা করে মূল কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমিয়ে স্থাপত্য নকশায় পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। পুনরায় বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য কমপক্ষে ৬ শতাংশ ও সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ জমির বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের স্থাপত্য নকশা অনুমোদনের জন্য প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের
প্রস্তাবে পরিবর্তন আনতে হবে। বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য যেসব স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে, এমন অনেক জায়গায় আগে থেকেই বধ্যভূমি রয়েছে। জেলা-উপজেলা পরিষদ ও স্থানীয় উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অন্য প্রকল্পের মাধ্যমে বধ্যভূমিতে কিছু স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। আবার অনেক স্থানে বেসরকারিভাবেও স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়েছে। সুতরাং, একই স্থানে নতুন করে বধ্যভূমির কোনো প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া এই প্রকল্পের দায়িত্বে এখন কোনো কর্মকর্তা নেই। চলতি বছরের শুরুতে একজন কর্মকর্তাকে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি সম্প্রতি বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
৪৪২ কোটি টাকায় ২৭১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের এই প্রকল্পের জন্য এখন পর্যন্ত জমিই চিহ্নিত হয়নি
জানা গেছে, বধ্যভূমির জন্য নির্ধারিত স্থানের অনেকগুলোতে জমির তফসিল, মৌজা, খতিয়ানে ওই দাগ নেই। কিছুসংখ্যক বধ্যভূমির জমির তফসিল ও প্রকৃত বধ্যভূমির অবস্থানের সঙ্গে গরমিল রয়েছে। এ ছাড়া ডিপিপিতে যে জমির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা খাসজমি হলেও ব্যক্তিগত জমির মূল্য ধরা হয়েছে। আবার কিছুসংখ্যক খাসজমি ও ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো মূল্য ধরা হয়নি। এ ছাড়া এই প্রকল্পে কারা কাজ করবে, তা নিয়েও জটিলতা রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যার স্মৃতিকে তুলে ধরতেই আমরা এ প্রকল্প নিয়েছি। বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও প্রকল্পটির ধীরগতি আমাদের ব্যর্থতা।
আমি কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চেয়েছি কেন তারা একটি টাকাও খরচ করতে পারেনি।’ তিনি বলেন, ‘বধ্যভূমি সংরক্ষণ না করার বিষয়টি আমাকেও কষ্ট দেয়। চেষ্টা করব যত দ্রুত সম্ভব প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার।’
তবে মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এ কাজে আরও বিলম্ব হবে। আগামী এক বছরও এই প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্যই থাকবে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের অগ্রগতি না হওয়াটা মন্ত্রণালয়ের চরম ব্যর্থতা। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে বিশেষজ্ঞ, ভূমি মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সাংসদকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয় যে তালিকা করেছে সেটাও অসম্পূর্ণ। আমরা সাড়ে তিন হাজার বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য বলেছিলাম।’