জ্বালানি বিভাগের দুর্নীতির খবরে তোলপাড়

0

সচিবের মুখের কথায় বড়পুকুরিয়ার চীনা ঠিকাদারকে ১৮৬ কোটি টাকা ছাড় দেয়ার তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় জ্বালানি বিভাগে তোলপাড় চলছে।

মঙ্গলবার যুগান্তরে এ নিয়ে প্রকাশিত খবর ছিল ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। প্রশাসনপাড়ায় ছিল আলোচনার খোরাক। জ্বালানি বিভাগের বিভিন্ন কোম্পানি, নিয়ন্ত্রক সংস্থা পেট্রোবাংলা ও সচিবের সাবেক কর্মস্থল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন- সর্বত্র কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ নিয়ে আলোচনায় সরব ছিলেন।

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে গণশুনানিতে অংশ নেয়া বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরের রিপোর্ট পড়ে মাথায় হাত দিয়েছেন। তারা অবিলম্বে এ ঘটনার জন্য উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন।

শুধু বড়পুকুরিয়ার এই অনিয়ম-দুর্নীতি নয়, অনেকেই টেলিফোনে এবং যুগান্তর কার্যালয়ে এসে সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম ও তার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ তুলে ধরেন। তারা বলেন, এসব অভিযোগ তদন্ত করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের মধ্যেও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি কোনোভাবেই বরদাশত করা সমীচীন হবে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্বালানি বিভাগের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির (বিসিএমসিএল) কয়লাকে কেন্দ্র করে অনিয়ম-দুর্নীতির ময়লা এতটাই ছড়াচ্ছে যে, এসব দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়া না হলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।’

প্রসঙ্গত গত জুলাইয়ে হঠাৎ জানা যায়, বড়পুকুরিয়া খনির ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লার কোনো হদিস নেই। কয়লার অভাবে বড়পুকুরিয়া তাপভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেলে এই ‘চুরি’ নজরে আসে। ‘চুরি’ যাওয়া কয়লার আনুমানিক বাজারমূল্য ২৩০ কোটি টাকা।

এছাড়া খনিতে ৫ শতাংশের বেশি আর্দ্রতাসহ কয়লা কিনে প্রায় ৮৪৬ কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে খনি কর্তৃপক্ষ। খনির কয়লা উত্তোলনকারী চীনের দুই প্রতিষ্ঠানের কনসোর্টিয়ামের কাছ থেকে ৫ দশমিক ১ শতাংশ আর্দ্রতাসহ কয়লা কেনার চুক্তি করা হয়। কিন্তু কয়লা কেনা হয়েছে ১০ শতাংশ আর্দ্রতাসহ।

বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষের পর্ষদ সভার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৩ বছরে এই খনি থেকে তোলা ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার টন কয়লা কিনেছে সরকার।

২০১১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগে দেয়া একটি উপস্থাপনায় বলা হয়, বড়পুকুরিয়া খনির কয়লায় ১০ শতাংশ আর্দ্রতা রয়েছে। কয়লার আর্দ্রতা পরিমাপের জন্য রসায়নবিদ নিয়োগের কথা থাকলেও গত ১৩ বছরে এই পদে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি।

ফলে পূর্ণ আর্দ্রতায় (১০ শতাংশ) খনির কয়লা কিনেছে সরকার। চীনা দুই প্রতিষ্ঠান সিএমসি, এক্সএমসির কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে পেট্রোবাংলার করা চুক্তির চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি আর্দ্রতায় কেনার ফলে এ পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ টন বেশি ওজন কয়লার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। খোলাবাজারে প্রতি টন কয়লা ১৬ হাজার ৯২৭ টাকায় বিক্রি করে বিসিএমসিএল। এ হিসাবে ৫ লাখ টন কয়লার মূল্য ৮৪৬ কোটি টাকা।

১০ শতাংশ আর্দ্রতায় কয়লা কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, ‘যদি খনির কয়লায় চুক্তিতে উল্লেখিত পরিমাণের চেয়ে বেশি আর্দ্রতা থাকে এবং তা ওজন করার সময় বাদ দেয়া না হয়, তাহলে কয়লার নামে আসলে আমরা আর্দ্রতা কিনেছি। আর্দ্রতা মাপার কথা কেমিস্টের। কিন্তু এ পদে কাউকে নিয়োগ না দেয়া বেশ সন্দেহজনক।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এই কয়লা চুরি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করে মামলা দায়ের করেছে। বর্তমানে দুদকের মামলাটি বিচারাধীন। এ রকম একটি বিচারাধীন মামলা থাকার পরও সরকারের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম কিভাবে ১৮৬ কোটি টাকা ছাড় করার মৌখিক নির্দেশনা দেন সেটি রহস্যজনক। পুরো ঘটনাটি তদন্ত করলে রহস্য উদঘাটিত হতে পারে।’

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘আপত্তি বিধিবদ্ধভাবে নিষ্পত্তি না করেই টাকাটা দিয়ে দেয়া হয়েছে- এই অভিযোগ আসছে। কোম্পানি আইনে বোর্ড চলে। সচিবের সেখানে আইনগত কোনো কর্তৃত্ব নেই। বোর্ড তার অন মেরিট ডিসিশন নেবে। বোর্ড সচিবের অজুহাত দিয়ে ডিসিশন নিতে যাবে কেন?’

উল্লেখ্য, বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির (বিসিএমসিএল) চীনা ঠিকাদার এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়ামকে ১৮৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিনব এক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে সরকারের জ্বালানি বিভাগ। এই বিভাগের সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের নির্দেশে নিয়মবহির্ভূভাবে বিপুল পরিমাণ এই অর্থ ছাড় করা হয়েছে।

৬ মার্চ স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত বৈঠকের সারসংক্ষেপপত্রের ৩.০৯ দফায় বলা হয়েছে, ‘চুক্তি নং বিসিএমসিএল/০৬/১৩৪/২০১১-এর সমাপ্তিকরণ ও রিটেনশন মানি ফেরত প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে বোর্ড সভায় উপস্থাপনের জন্য সচিব মহোদয় মৌখিক নির্দেশনা প্রদান করেন।’

এর ভিত্তিতেই বোর্ড সভায় উল্লেখিত বিপুল পরিমাণ অর্থ চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে রিলিজ (ছাড়) করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত ও দুর্নীতির শামিল।

সূত্র জানায়, কথা ছিল চুক্তি শেষে ‘স্কোপ অব ওয়ার্ক’ অনুযায়ী সব ধরনের দেনা-পাওনা নিষ্পত্তি করে ঠিকাদারকে টাকা দেয়া হবে। কিন্তু চুক্তি লঙ্ঘন করে পুরো টাকা দিয়ে দিয়েছে বিসিএমসিএল।

কোম্পানির ২৮৯তম পরিচালনা পর্যদ সভায়ও সিদ্ধান্ত হয়েছিল কোল ইয়ার্ডে মজুদকৃত কয়লার মধ্যে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ মেট্রিক টন চুরির বিষয়ে গঠিত কমিটিগুলোর দাখিল করা প্রতিবেদন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ থেকে পাওয়ার পর সুপারিশ মোতাবেক পরবর্তী বোর্ড সভায় ওই টাকা দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে।

কিন্তু তা না করে ১৯০তম সভায় চীনের ঠিকাদার এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়ামকে পুরো টাকা পরিশোধের সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।

জানা যায়, এই বিল প্রদানের জন্য বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে ৬ মার্চ জ্বালানি সচিবের নেতৃত্বে পেট্রোবাংলায় একটি বৈঠক করেন বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির (বিসিএমসিএল) এমডি ফজলুর রহমান। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন চেয়ারম্যান নিজে, পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) ও পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইন্স)।

পরে বোর্ড সভায় টাকা দেয়ার ব্যাপারে ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানির কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য পুরো ১৮৬ কোটি টাকা দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বোর্ড।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com