বসুরহাটের পৌর নির্বাচন ‘আওয়ামী ভণ্ডামির লেটেস্ট মডেল’: রিজভী

0

সদ্য অনুষ্ঠিত নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌর নির্বাচনকে ‘আওয়ামী ভণ্ডামির নতুন মডেল’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী।

তিনি বলেছেন, ‘রকিবুল হুদা কিংবা নূরুল হুদা’ চক্র গত এক দশক ধরেই বেহুদা নির্বাচনের মাধ্যমে যে নানারকম নির্বাচনী মডেল জন্ম দিয়েছেন তা জনগণের স্মৃতি থেকে এখনও বাসি হয়ে যায়নি। কখনও ‘নির্বাচন ছাড়াই ১৫৪ এমপি’ আবার কখনও ‘ভোট ছাড়াই নিশিরাতের এমপি’- এসব মডেলের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চাহিদা পূরণে এবার বেহুদা কমিশনের লেটেস্ট আবিষ্কার ‘বসুরহাট মডেল’।’

সোমবার (১৮ জানুয়ারি) নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

রিজভী বলেন, ‘ওবায়দুল কাদের সাহেব এবং নিশরাতের প্রধানমন্ত্রীর ‘বসুরহাট মডেল’ এর মর্মার্থ হলো ‘সবই আমরা আমরা’। এই মডেলে তারা নিজেরাই নিজেদের প্রশংসায় ভাসিয়ে দেবে আবার নিজেরাই নিজেদের বিরোধিতায় মেতে উঠবে। এমন বিরোধিতা যাতে একদিকে গণমাধমকে ব্যস্ত রাখা যায় আবার অপরদিকে নির্বাচন নামের প্রহসনকে আলোচনায় রাখা যায়। এটাই হলো ‘বসুর হাট মডেল’। এই মডেলে, সব প্রশংসা নিশিরাতের প্রধানমন্ত্রীর জন্য আর সমালোচনা সব আওয়ামী লীগের অন্যসব নেতাদের। আওয়ামী লীগের সকল কাজই প্রকৃতপক্ষে এক ছলনা ছাড়া কিছুই নয়।’

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘গত শনিবার দ্বিতীয় ধাপের ৬০টি পৌরসভায় আগের মতোই ব্যাপক সহিংসতা, রক্তপাত ও ভোট ডাকাতির নির্বাচন করেছে ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচন নিয়ে অন্ধকার শ্বাসরোধী পরিবেশের কোনও পরিবর্তনই হয়নি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, প্রশাসনের সহায়তায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা অধিকাংশ পৌর নির্বাচনী এলাকায় তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে। সিরাজগঞ্জের শহীদগঞ্জে জনগণের ভোটে বিজয়ী আমাদের কাউন্সিলর প্রার্থী তরিকুল ইসলামকে নৃশংসভাবে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে আওয়ামী জঙ্গি সন্ত্রাসীরা। তরিকুলের হত্যাকারী প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থী শাহাদাত হোসেন বুদ্দিন বাহিনীকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে সিরাজগঞ্জ যখন উত্তাল তখন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সরাসরি খুনিদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেছেন, ’কাউন্সিলর হত্যা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র’!’

রিজভী বলেন, ‘নিহত নির্বাচিত কাউন্সিলর যেহেতু বিএনপির নেতা, তাই কাদের সাহেবের কাছে এই হত্যা হয়ে গেলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা! শুধু অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা কতটা নৃশংস হতে পারে এটা তার চূড়ান্ত প্রমাণ। এদের মনে কোনও অনুশোচনা নেই।’

তিনি বলেন, ‘যতদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে ততদিন দেশের ফাঁড়া কাটবে না। সর্বত্র চর দখলের মতো কেন্দ্র দখল করে ভোট কারসাজির ডিজিটাল মেশিন ইভিএম দিয়ে প্রকাশ্যে কারচুপি করা হয়েছে। বহু কেন্দ্রে ইভিএমে নৌকা ছাড়া কোনও প্রতীক রাখেনি। মানুষ ভোট দিতে গিয়ে দেখে যে, শুধু নৌকায় ভোট পড়ছে। প্রশাসনের সহযোগিতায় সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা, কৃত্রিম লাইন তৈরি করে ভোটাদের ভোট কেন্দ্রে যেতে না দেয়া, নৌকা ছাড়া অন্য কোনও প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়া, কেন্দ্র থেকে এজেন্ট ও প্রার্থীদের গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া, ভোটের ফলাফল সরকারদলীয় প্রার্থীদের পক্ষে ঘোষণা করা, আমাদের নেতাকর্মীদের হয় কারাগারে নয়তো এলাকাছাড়া করা, এসবই হয়েছে এই পৌর নির্বাচনে। অনিয়ম, ভোট জালিয়াতি ও পেশী শক্তির বিষয়ে অভিযোগ করা হলেও রিটার্নিং কর্মকর্তারা কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।’

বিএনপির এই শীর্ষনেতা বলেন, ‘ভোট নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর বলেছেন, ‘পৌরসভা নির্বাচনে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হয়েছে। ভোট কেন্দ্রে প্রচুর ভোটার উপস্থিতি ছিল। ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।’ কতবড় বেহায়া এবং সরকারের কাছে আত্মা বিক্রি করলে এমন নগদ মিথ্যা বলা যায়! নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান অথচ সিইসি নূরুল হুদার নেতৃত্বে যে কমিশন সেই কমিশনের অধীনে আজ পর্যন্ত একটি নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে সরকার। নির্বাচন কমিশন সরকারের ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। বরাবরের মতোই ৬০ পৌরসভার নির্বাচনগুলোতেও সরকারদলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত নির্লজ্জ।’ 

তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও নিজেদের স্বাধীন সত্তা বিকিয়ে দিয়ে সরকারের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী আদর্শে রঞ্জিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা নিজের মানসম্মানকে মোটেই তোয়াক্কা করেন না। তাই সবকিছু ধ্বংস করে শুধু শেখ হাসিনার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য নৌকাকে বিজয়ী করাকে তিনি তাঁর আদর্শিক কাজ বলে মনে করেন। ভোট কেন্দ্রের অবস্থা কী, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের কোনও কোনও নেতা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। সত্যিকারের ভোট হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা দরজা ঠুয়াই পাবে না, দরজা খুঁজে পাবে না- এটা তো আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মুখ থেকে আসছে। এটাই হলো প্রকৃত বাস্তবতা। একারণে সুষ্ঠু ভোট শেখ হাসিনার কাছে আতঙ্ক।’

রিজভী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্বাচনী এলাকায় বসুরহাট পৌরসভায় তার আপন ছোট ভাই বহুলালোচিত আব্দুল কাদের মির্জার বিজয়ে অতি আনন্দিত হয়েছেন। খুশিতে গদগদ হয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, বসুরহাটে যে নির্বাচন হয়েছে সেটা নাকি ‘স্বচ্ছতার মডেল’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি ‘বসুর হাট’ মডেল নির্বাচন চান।’ প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদার বেহুদা নির্বাচনে নিজের ছোটভাই আব্দুল কাদের মির্জার জয় লাভের আনন্দে ছোট ভাইয়ের মতোই ওবায়দুল কাদেরের এই মন্তব্যে একটি প্রবাদের কথা মনে পড়ে গেলো, ’পাগলের সুখ মনে মনে, পাতা টোকায় আর গোনে’।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশের জনগণ জানে, আওয়ামী লীগের আমলে জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচনে জনগণের ভোটে হার-জিত নির্ধারিত হয় না। হার-জিত নির্ধারিত হয় গণভবনে। নির্বাচন কমিশন স্রেফ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পোস্ট বক্স। নির্বাচন কমিশনের কাজ, আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড থেকে পাঠানো তালিকা প্রকাশ করা। এ খেলার মাস্টার মাইন্ড শেখ হাসিনা আর খেলোয়াড় হিসেবে আছে পুলিশ প্রশাসন। নির্লজ্জ রেফারি নির্বাচন কমিশন এখানে হাতের পুতুল। তাই আমরা মনে করি, পূর্ব নির্ধারিত এসব একতরফা নির্বাচনকে একটু রমরমা করতেই এবারের ‘মডেল’ ছিলেন আব্দুল কাদের মির্জা। আওয়ামী লীগের এই নাটক মানুষ আগেই টের পেয়েছিলো। আমিও এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করেই বলেছিলাম, ওবায়দুল কাদেরের ভাই আব্দুল কাদের মির্জার উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক, তার মুখ থেকে কিছু অপ্রিয় সত্য বেরিয়ে এসেছে। সেসব প্রশ্নের জবাব জনগণ জানতে চায়। ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই মির্জা কাদের স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘তার ভাবি অর্থাৎ ওবায়দুল কাদেরকে বৌ’ সামলাতে হবে, অন্যথায় আওয়ামী লীগকে পস্তাতে হবে’, ‘ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে যারা চলেন, তারা চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী’, মির্জা কাদের আরও বলেছিলেন, তিনি এর আগেরবার জনগণের ভোটে ‘বসুরহাটে’র মেয়র নির্বাচিত হননি, তাকে জেতানোর জন্য নির্বাচনের আগের রাতেই তার ভোটের বাক্সে ভোট ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তাহলে এবারেও কি কাদের মির্জাকে জেতানোর জন্য নির্বাচনের আগের রাতে নাকি ভোটের দিন সকালে ভোটের বাক্সে ব্যালট পেপার ঢোকানো হয়েছে?’

রিজভী বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের এই সংকটকালে প্রতিটি দেশের সরকারপ্রধান সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশে নিশিরাতের সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা করোনার ভয়ে নিজেকে গণভবনে বন্দি রেখে জনগণের সঙ্গে তামাশায় লিপ্ত রয়েছেন। কখনও নন ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে জনগণকে ব্যস্ত রাখা কিংবা কখনও আব্দুল কাদের মির্জার মতো ‘আইটেম বয়’ মার্কেটে ছেড়ে গণমাধ্যমকে ব্যস্ত রাখা- এসব অপকৌশলের ব্যাপারে জনগণ সচেতন। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, মানুষকে নিয়ে, মানুষের স্বার্থ নিয়ে এসব রঙ্গ-তামাশার জবাব মানুষ কড়ায়-গণ্ডায় ফিরিয়ে দেবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগামীকাল ১৯ জানুয়ারি ২০২১ মহান স্বাধীনতার ঘোষক, সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এর ৮৫তম জন্মবার্ষিকী। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ইতোমধ্যে বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। শহীদ জিয়াউর রহমানের দূরদর্শিতা, দেশপ্রেম, সাহস, বীরত্ব, সততা, দক্ষতা, কর্মক্ষমতা, পরিকল্পনা, জনঘনিষ্ঠতা, ঔদার্য্য, আড়ম্বরহীনতা সবকিছুই কিংবদন্তি হয়ে আছে। হি ওয়াজ নট অনলি এ ভিশনারি লিডার, হি ওয়াজ এ ম্যান অব অ্যাকশন। এমন একজন রাষ্ট্রনায়ক যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল দেশ ও জাতির জন্য তখনই ষড়যন্ত্রের হিংস্র ছোবল তাঁকে ছিনিয়ে নিয়েছে।’

রিজভী বলেন, ‘তিনি (জিয়াউর রহমান) আর কোনদিন সশরীরে ফিরবেন না আমাদের মাঝে। তবে আমাদের কাছে অমলিন হয়ে থাকবে তাঁর দিকনির্দেশনা, আদর্শ, কর্মসূচি ও তার ব্যক্তিগত জীবনাচরণ। জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে বড় অবদান, তিনি এই জাতিকে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সঙ্গে বাংলাদেশ ও জিয়াউর রহমান একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। সেই কারণে জিয়া, জিয়ার দর্শন, জিয়ার ধানের শীষ বাংলাদেশের মানুষের কাছে আজও এত প্রিয়।’

বিএনপির এ শীর্ষ নেতা বলেন, ‘আজ গণতন্ত্রবিহীন, মানবতাহীন নির্মম এই রাষ্ট্রে জিয়া অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ এদেশ এখন গণতন্ত্রশূন্য, দুর্বল স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। সংগ্রাম গণতন্ত্রের জন্য, সংগ্রাম স্বাধীনতার জন্য, সংগ্রাম মুক্তির জন্য, দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও- আজকের দিনে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।’

তিনি বলেন, ‘আজ বন্দি গণতন্ত্র ছটফট করছে। সেই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে এদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের আশা-উদ্দীপনার উৎস গৃহবন্দি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন বেগবান করতে হবে। তাঁর নেতৃত্বেই ফিরে আসবে মানুষের স্বাধীনতা তথা গণতন্ত্র। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কঠোর পরিশ্রম করছেন বিদেশের মাটিতে থেকেও। আমরা আশা করব, তার এই পরিশ্রম সফল হবে, ইনশাআল্লাহ্।’

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক শ্যামা ওবায়েদ, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল খালেক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com