করোনায় পোশাক শ্রমিকদের অধিকার প্রাধান্য পায়নি
করোনায় তৈরি পোশাক শ্রমিকদের অধিকার প্রাধান্য পায়নি বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেছেন, মালিকপক্ষ সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রণোদনা আদায় করতে পারলেও উৎপাদনের যে মূল উপাদান অর্থাৎ শ্রমিক পক্ষ, সেই শ্রমিক পক্ষের অধিকার, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোনো প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে কার্যকর কোনো কর্মপরিকল্পনা বা কর্মকৌশল গ্রহণে মালিক পক্ষকে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। শ্রমিকরা যার ক্ষুদ্র অংশ মাত্র পেয়েছে, যা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। গতকাল ‘তৈরি পোশাক খাতে করোনাভাইরাস উদ্ভূত সংকট : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে অনলাইনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। এতে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ নূরে আলম মিল্টন এবং অ্যাসিসট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, করোনাভাইরাস অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। জিডিপির ১০ শতাংশ এবং রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৮৪ শতাংশের অংশীদার তৈরি পোশাক খাত। তৈরি পোশাক খাতটি উৎপাদন ও রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই বিদেশের ওপর নির্ভরশীল। স্বাভাবিকভাবেই এ খাতটিকে ঘিরে নেতিবাচক প্রভাব ব্যাপকতর। ব্যাপকভাবে কার্যাদেশ বাতিল হয়েছে। রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কিছু দিনের জন্য, শত শত কারখানা লে-অফসহ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং শ্রমিকদের চাকরি হারানোর ঘটনা ঘটেছে। বৈদেশিক বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে এ খাতের এই যে ভূমিকা, তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ায় সার্বিকভাবেই বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। সরকার ও মালিক পক্ষের কারোরই করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে সমন্বিত পরিকল্পনা না থাকায়, এ খাতের অবস্থা আরও নাজুক হয়েছে। তিনি বলেন, চার দশক ধরে এ খাতের নেতৃবৃন্দের যে পুঞ্জীভূত মানসিকতা অর্থাৎ সরকারি প্রণোদনার ওপর নির্ভরশীলতা, সেটি এই সময়ে প্রকটতর রূপে দেখা গেছে। প্রকৃতপক্ষে এ খাতের বোঝাটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার তথা জনগণের ওপরই বর্তেছে। মালিক পক্ষের আচরণে মনে হয়েছে, পুরো অর্থনীতিতে শুধু তারাই যেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সরকারের প্রণোদনার সিংহভাগের মালিকানা তথা অধিকার যেন তাদেরই, এরকম একটা ভাব। সরকার প্রদত্ত মোট প্রণোদনা অর্থের প্রায় অর্ধেক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তৈরি পোশাকশিল্প খাতে। অথচ জিডিপিতে তাদের অবদান মাত্র ১০ শতাংশ।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সুশাসনের যেসব মাপকাঠি ব্যবহৃত হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির ক্ষেত্রেই ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। যা নিরসনে সরকার ও মালিক পক্ষ উভয়ের দিক থেকেই সদিচ্ছার ঘাটতি ছিল। চলমান মহামারী সংকট আবারও প্রমাণ করল, সরকারি প্রণোদনা তথা জনগণের অর্থের ওপর নির্ভর করে মালিক পক্ষ ও ক্রেতা সংস্থাগুলোর অনেকেই নিজেদের সুবিধা আদায়ে তৎপর ও সফল হয়েছেন। টিআইবি নির্বাহী পরিচালক বলেন, মালিক পক্ষ প্রাথমিক অবস্থায় শ্রমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থে আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাপকহারে লে-অফ করে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। প্রণোদনা প্যাকেজের সিংহভাগই মালিক পক্ষের হাতে চলে গেছে। শ্রমিকরা যার ক্ষুদ্র অংশ মাত্র পেয়েছে, যা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। সংবাদ সম্মেলনে তৈরি পোশাক খাতে করোনা উদ্ভূত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে অংশীজনদের করণীয় চিহ্নিত করে নয় দফা সুপারিশ প্রস্তাব করা হয়েছে। টিআইবির এই সুপারিশগুলো হলো- করোনা মহামারী বিবেচনায় নিয়ে সকল শ্রেণির শ্রমিকের চাকরির নিরাপত্তার বিধান সংযুক্ত করে ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬’ এর ধারা ১৬ ও ২০ সংশোধন করতে হবে। বিজিএমইএ প্রণীত গাইডলাইন মোতাবেক শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ব্যত্যয় হলে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ‘ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি)’ সুবিধা বাতিল এবং জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। বিজিএমইএর অঙ্গীকার করা করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার বাকি তিনটি ল্যাব দ্রুততার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে স্থাপন করতে হবে। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নৈতিক ব্যবসা পরিচালনায় অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। পোশাকের ভিত্তি মূল্য নির্ধারণ ও কার্যাদেশগুলোর বিদ্যমান শর্তের সঙ্গে দুর্যোগকালে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতকরণের বিষয় সংযুক্ত করতে হবে। করোনার দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকার ও মালিক সংগঠনগুলো কর্তৃক গঠিত বিভিন্ন কমিটিকে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে হবে। লে-অফকৃত কারখানায় এক বছরের কম কর্মরত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শ্রমিক অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির নিয়মিত ও কার্যকর পরিদর্শন নিশ্চিত করতে হবে। ইইউ ও জার্মানির সহায়তা তহবিল ব্যবহারের জন্য করোনা মহামারীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের সঠিক তালিকা অবিলম্বে প্রণয়ন করতে হবে এবং করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া, শ্রমিক ছাঁটাই, কার্যাদেশ বাতিল ও পুনর্বহাল, প্রণোদনার অর্থের ব্যবহার ও বণ্টন ইত্যাদি সব তথ্য সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে ও নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে।