করোনায় ক্ষতি বাড়াবে রাজধানীর বায়ুদূষণ
ধুলো-বালি ও ভারী ধাতু বাতাসে মিশ্রণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বায়ুদুষণে গতকালও ঢাকা ছিল শীর্ষে। ভারতের রাজধানী দিল্লি বিশ্বের একটি অন্যতম বায়ুদূষিত শহর দীর্ঘ দিন থেকে। বেশ কয়েক বছর থেকে ঢাকাও হয়ে উঠছে অন্যতম দূষিত নগরী।
এ ব্যাপারে পরিবেশবাদীরা বলছেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টি হ্রাস পাওয়া এবং বেশ কয়েকদিন থেকে শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করায় ঢাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে ধূলিকণা ও অন্যান্য ধাতুতে। এসব কারণে ঢাকা এখন বারবার বায়ুদূষণের নগরী হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। বৃষ্টি না হলে সামনের দিনগুলোতে এমন অবস্থা চলতেই থাকবে।
আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান জানান, শীতের সময় এমনিতেই বাতাসে থাকা জ্বলীয়বাষ্পের সাথে আর্দ্রতা মিশে কুয়াশার সৃষ্টি হয়। এরসাথে শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে ধূলিকণাও যুক্ত হওয়ায় কুয়াশার পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেয়। বায়ুর আদ্রতার সাথে ধুলা মিশে গেলে তা সহজে মাটিতে পতিত হয় না, এটা দীর্ঘ সময় বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। ফলে দূষণের মাত্রাও বাড়ে। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত ঢাকার বাতাসে দূষণের পরিমাণ কমবে না।
যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক বিশ্বের বিভিন্ন শহরের বায়ু পরিমাপক প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজুয়্যালের সূচক অনুসারে গতকাল সোমবার ঢাকার অবস্থা ছিল বেশ অসহনীয়। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তার আশপাশে নিঃশ্বাস নেয়াটা কিছুটা কষ্টকর ছিল। নাক-মুখ ও চোখ জ্বালা-পোড়ার মতো অসহনীয় অবস্থা ছিল পথচারীর। এমনকি ঘরে অবস্থানকারীদেরও একই রকম অবস্থা ছিল গতকাল।
ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে রক্ষিত বায়ু পরিমাপক যন্ত্রের হিসেবে গতকাল বেলা ৩টার দিকে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ২৬৯। সে তুলনায় একই সময়ে গত সোমবার দিল্লি শহরের বায়ুমান ছিল ২৬২ এবং তৃতীয় অবস্থানে ছিল পাকিস্তানের করাচি নগরী। ঢাকায় গত রোববার বায়ুমান ছিল ২৩৮। বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, এ ধরনের বায়ুমান স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক ডা: শামীম আহমেদ বলেন, ‘বায়ুদূষণের ফলে ফুসফুসে ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যায়। বর্তমান করোনাভাইরাসের আক্রান্ত রোগীদের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। বায়ুদূষণ অব্যাহত থাকলে তাদের ফুসফুস আরো বেশি ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। সে জন্য যাদের ফুসফুস সংক্রান্ত কোনো রোগ আছে বায়ুদূষণের এ সময়ে তাদের উচিত প্রয়োজন না হলে ঘরে বাইরে না বের হওয়া। একান্তই যদি তাদের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে ভালো মাস্ক পরে বাইরে যেতে হবে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় বাইরের যাওয়াটাকে এড়িয়ে চলা।’
ঢাকা বায়ুদূষণ সম্পর্কে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান এ নাসের খান বলেন, বায়ুদূষণ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর পেছনে যেসব কারণ রয়েছে তা সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ দিন থেকে। ঢাকার রাস্তায় ধুলা-বালি প্রচুর। এটা হচ্ছে রাস্তা অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে। নির্মাণকাজ করলে মাটি ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী আনা-নেয়া করার সময় সাবধানাতা অবলম্বন করা হয় না। যে ট্রাকে করে এসব মাটি ও নির্মাণসামগ্রী নেয়া হয় সে ট্রাকগুলো ঢেকে রাখা হয় না। মাটি ও বালি রাস্তায় পড়ে গেলে এ জন্য ট্রাকচালক ও নির্মাণ কোম্পানি দায়ী কিন্তু তারা কোনো দায়িত্ব নেয় না।
তিনি বলেন, এমনকি উন্নয়ন ও নির্মাণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাও কখনো এদের শাস্তি দেয় না। এসব ছাড়াও ঢাকার মধ্যে রয়েছে প্রচুর কল-কালখানা, ঢাকার আশপাশেই রয়েছে প্রচুর ইটের ভাটা। এসব উৎস থেকে প্রচুর ধুলা-বালি ও ভারী ধাতু ঢাকার বাতাসে মিশে যাচ্ছে। এসব বন্ধ করতে পারলে ঢাকার বাতাসের উন্নতি হতে পারে। এমনকি প্রতিদিন নিয়মিত করে রাস্তায় পানি ছিটালেও বায়ুদূষণের মাত্রা কমানো যেতে পারে। তাও এখন হচ্ছে না।
ডা: শামীম আহমেদ বায়ুদূষণ বিষয়ে আরো বলেন, ‘বায়ুদূষণের মাধ্যমে বাতাসে ভেসে থাকা রোগগুলো বেশি করে মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। ফলে শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, ক্রনিক অ্যাজমা, ব্রংকাইটিসের প্রকোপ বাড়তে পারে। এ ছাড়া দূষিত বায়ুর মাধ্যমে ক্ষতিকর পদার্থ নাক ও মুখ দিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করে। সারা শরীর থেকে রক্ত ফুসফুস থেকে অক্সিজেনের বিশুদ্ধ হয়ে আবার শরীরের বিভিন্ন অংশে ফিরে যায়।
তিনি বলেন, যখন আমরা অক্সিজেন নিচ্ছি তখন বায়ুর মাধ্যমে অন্যান্য ক্ষতিকর বস্তুগুলোও ফুসফুসে গিয়ে জমা হয়। এসব ক্ষতিকর ধাতব পদার্থ, ধুলা-বালি ফুসফুসে বেশি বেশি জমা হলে ফুসফুস দুর্বল হয়ে যাবে। একই সাথে ইনফেকশনও বাড়বে। ধীরে ধীরে এর কার্যক্ষমতা কমে যাবে। এসব কারণে ফুসফুসে ক্যানসার হতে পারে।
শামীম আহমেদ জানান, বর্তমানে করোনাভাইরাসের সময় এই ঝুঁকি আরো বেশি। কারণ ফুসফুস রক্ত সঠিকভাবে পরিষ্কার করতে না পারলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর মৃত্যু ঝুঁকি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাবে। বিশেষ করে বয়স্ক, গর্ভবতী মা ও শিশুদের এই ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। তবে যারা নিয়মিত মাস্ক পড়েন তারা একটু কম ঝুঁকিতে থাকবেন’।