করোনার নতুন ঢেউ : কী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে?
করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমন শঙ্কার মধ্যে সংক্রমণের বিস্তার ঠেকানোর জন্য মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে এবার রাজধানী ঢাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত নামানো হচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশ দেয়ার কথা জানানো হয়েছে। সত্তর দিনের মধ্যে গত ২৪ ঘন্টায় সবচেয়ে বেশি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে।
সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেই কিছু দিন ধরে শীতে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
তবে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হলেও তা কার্যকর না হওয়ায় এখন সরকার কঠোর হওয়ার কথা বলছে।
বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলেছেন, সরকারের ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির কারণে স্বাস্থ্যবিধি মানা বা প্রতিরোধের বিষয় একেবারে ভেঙে পড়েছে।
সরকারি হিসাবে দেশে দুই মাসের বেশি সময় ধরে কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের সংখ্যা দুই হাজারের অনেক নিচে ছিল। এক সপ্তাহ ধরে শনাক্তের সংখ্যা কিছুটা বাড়তে থাকে।
সর্বশেষ গত ২৪ ঘন্টায় শনাক্তের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়েছে।
উত্তরাঞ্চলীয় জেলা বগুড়ার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা: মোস্তাফিজুর রহমান মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেছেন, তাদের জেলাতেও সংক্রমণ বাড়ছে। এর পেছনে স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিষয়কে তিনি অন্যতম কারণ হিসাবে দেখেন।
“এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণ একটু একটু করে বাড়ছে। এটা বাড়ার মুল কারণ আমার মনে হয়, বার বার তাগিদ দেয়ার পরও সবাই কেন যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে না।”
“এখন কিন্তু মাস্ক পরাটা সব ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। অথচ সবাই ঠিকমত মাস্ক ব্যবহার করছে না। এবং স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলছে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা-সেটিও সবাই মানছে না। সবাই ভাবছে করোনাভাইরাস হয়তো চিরতরে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়।”
প্রথমদিকে ঢাকা ছাড়াও যে নগরী বা জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার বেশি ছিল তার মধ্যে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম অন্যতম। সেখানে আবারও সংক্রমণের হার কিছুটা বৃদ্ধির দিকে বলে কর্মকর্তারা বলেছেন।
চট্টগ্রাম থেকে একজন সমাজকর্মী নুরজাহান খান বলেছেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মাস্ক পরার কথা লেখা থাকলেও তা বেশিরভাগ মানুষই মানছেন না। তিনি বলেছেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধের সব ব্যবস্থাই অনেক আগে ভেঙে পড়েছে।
“আমি যতটা দেখছি, যারা শিক্ষিত যদের কাছ থেকে আমরা সচেতনতা আশা করতে পারি। তারাও সচেতন না। মাস্ক তো এক শতাংশ পরে কিনা সন্দেহ আছে। হ্যাণ্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে না। রাস্তাঘাটে থুতু ফেলে।”
তিনি আরও বলেছেন, “সংক্রমণ এত যে বেড়েছে, প্রত্যেকট ঘরেই এখন রোগী থাকতে পারে। করোনাভাইরাস হওয়া মানে একটা পরিবার ধ্বংস হয়ে যাওয়া। চিকিৎসায় একেকটা পরিবারের পাঁচ ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে। তারপরও মানুষ কেন সচেতন হচ্ছে না?”
নুরজাহান খান মনে করেন, প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের চেয়ে মানুষের নিজেদেরই দায়িত্ব বেশি।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বিষয়টাকে ভিন্নভাবে দেখেন। তারা মনে করেন, সাধারণ মানুষ যাতে পরিস্থিতি অনুভব করে বা সচেতন হয়, সে দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের।
শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সশরীরে এখনও উপস্থিত হতে হচ্ছে না।
এছাড়া সরকারি বেসরকারি অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্য, হাটবাজার, শিল্প-কারখানা, পরিবহন সবকিছুই অনেক দিন ধরে প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে বলা যায়। এমনকি সভা সমাবেশ বা জমায়েত কোন কিছুই থেমে নেই।
এমন প্রেক্ষাপটে মাস্ক পরার বিষয়কে প্রতিরোধের একমাত্র ভরসা হিসাবে নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তা বাধ্যতামূলক করা হয়। বলা হয় নো মাস্ক নো সার্ভিস। এরপরও মাস্ক না পরার সংখ্যাই বেশি-এমন চিত্রই পওয়া যাচ্ছে।
সম্প্রতি খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে মাস্ক না পড়লে জরিমানা করা হয়েছে।
এখন ঢাকায় রাস্তা-বাজারসহ লোক সমাগমের জায়গাগুলোতে মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত নামানো হচ্ছে।
করোনা ভাইরাস, বাংলাদেশ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক একজন পরিচালক ড: বে-নজীর আহমদ বলেছেন, মানুষকে সচেতন করতে না পারলে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কোন ফল পাওয়া যাবে না।
“প্রতিরোধের বিষয়কে এখন প্রশাসনিকভাবে দেখা হচ্ছে। প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন নো মাস্ক-নো সার্ভিস, এ ধরণের প্রজ্ঞাপন বা নির্দেশ জারি করা হচ্ছে। কিন্তু শুধু প্রশাসনিক আদেশ জারি করেই কোন ফল কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না।”
তিনি মনে করেন, “কৌশল হিসাবে সীমিত ভয় জিইয়ে রাখা প্রয়োজন ছিল। সাধারণ মানুষ এমন একটা ধারণা পেয়েছে যে, করোনাভাইরাস নিয়ে ভয়ের কিছু নাই। ফলে মানুষের ভয় কেটে গেছে এবং সেটাই বিপদজনক।”
ড: বে-নজীর আহমদ বলেছেন, মানুষের ভয় যেহেতু কেটে গেছে এবং মানুষ প্রায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে। সেকারণে এখন লকডাউনের মতো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব নয়। এছাড়া সামাজিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধি মানাটা নিশ্চিত করা দুরহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারাও এমন পরিস্থিতি স্বীকার করেন।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেছেন, জনসচেতনতাকে গুরুত্ব দিয়ে তারা পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
“নো মাস্ক, নো সার্ভিস-এটা আমরা বলছি। আমরা চেষ্টা করছি, মানুষ যাতে তা মানে। এখন ধরেন জীবিকার জন্যে বা অর্থনীতির জন্যে মানুষতো কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু নিয়মতো মানছে না। নিয়ম না মানার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।”
তিনি উল্লেখ করেছেন, “সব স্তরের জনপ্রতিনিধি, ধর্মীয় নেতা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সবাইকে একযোগে মানুষের কাছে বার্তা দিতে হবে। কারণ টীকা না আসা পর্যন্ত মাস্ক পরা বা স্বাস্থ্যবিধি মানা ছাড়া আমাদের আর বড় কোন প্রতিষেধক নাই।”
তিনি দাবি করেছেন, বাংলাদেশে এখনও প্রখম ওয়েভ বা ঢেউ শেষ হয়নি। তাতে সংক্রমণ কিছুটা বাড়ছে। কিন্তু উদ্বেগজনক অবস্থায় যাতে না যায়, সেজন্য তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চিকিৎসা বা প্রতিকারের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নজর কিছুটা আছে এবং এতদিনে কিছু উন্নতিও হয়েছে। কিন্তু প্রতিরোধের ব্যাপারে নজর কম।
ড: বে-নজীর আহমদ বলেছেন, “প্রতিরোধের বিষয়টা এখন হাল ছেড়ে দেয়ার মতো হয়েছে। অথবা অন্যভাবেও বলা যায়, আমাদের নিয়তির ওপর ছেড়ে দেয়ার মতো অবস্থা হয়েছে।”
যদিও কর্মকর্তারা এসব বক্তব্য মানতে রাজি নন। কিন্তু তাদের নতুন কোনো কৌশল বা পরিকল্পনা তারা তুলে ধরেননি।