মাদকের ছিঁচকে কারবারিদের গ্রেপ্তার করলেও গডফাদাররা আড়ালে-আবডালে থেকে যায়

0

মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান, বন্দুকযুদ্ধ এমনকি বেশকিছু মাদক ব্যবসায়ীর আত্মসমপর্ণের পরও ঠেকানো যাচ্ছে না মাদকের বিস্তার। করোনাকালীন সময়েও সারা দেশে মাদকের ছড়াছড়ি। হাত বাড়ালেই মাদকদ্রব্য মিলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযানের মধ্যেও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না মাদক ব্যবসা। উল্টো নতুন নতুন ব্যক্তিরা এই ব্যবসায় জড়াচ্ছেন। আর পুরাতন ব্যবসায়ীয়া আড়ালে আবডালে থেকে নতুন মুখ দিয়ে দেদারসে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। করোনাকালে চালান আসছে না এমন অজুহাতে দামও বাড়িয়ে নিচ্ছেন মাদক কারবারিরা। অথচ কৌশল পাল্টে সীমান্ত দিয়ে হরহামেশাই মাদকের চালান আসছে।আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব চালান সারা দেশের খুচরা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। একদিকে মাদক ব্যবসায়ীদের সংখ্যা যেমন বাড়ছে ঠিক তেমনি মাদক সেবনকারীর সংখ্যাও বাড়ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত চাহিদা বেশি থাকায় মাদক ব্যবসার লাগাম টানা যাচ্ছে না। এছাড়া লাভজনক ব্যবসা হওয়াতে মাদক ব্যবসায় ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বেশি। মাদক ব্যবসা করে অল্প সময়ে অনেকেই কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। এছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতা নিয়েই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে কারবারিরা।

খোঁজ নিয়ে ও সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা গেছে, মাদক ব্যবসা মোটেও কমেনি। বরং বেড়েছে। তবে পাল্টেছে কৌশল। যেসকল ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে মাদকের চালান দেশে নিয়ে আসেন তারা বেশ কৌশলী। বড় মাদক ব্যবসায়ীরা সীমান্তের ওপার মিয়ানমার থেকেই অধিকাংশ চালান নিয়ে আসেন। এসব চালান আনা থেকে শুরু করে হাতে আসা পর্যন্ত নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়। এক্ষেত্রে পাইকারি বিক্রেতাদেরও কৌশলি হতে হয়। মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এমন ব্যক্তিরা জানিয়েছেন মাদকের চালান আনার ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেয়াই থাকে মূল লক্ষ্য। কখনও কখনও সংশ্লিষ্ট এলাকার অসাধু কর্মকর্তাদের উৎকোচ দিয়ে চালান পার করতে হয়। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছে বড় চালান আটকা পড়ছে।

৪ঠা অক্টোবর ঢাকার বঙ্গমার্কেট এলাকায় একটি লাশবাহী গাড়ি থেকে তিনহাজার বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার করেছে মহানগর গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি)। যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৫০ লাখ টাকা। সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে এই ফেন্সিডিলের চালান এনে লাশবাহী গাড়ির ভেতরে কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে পাচার করছিল কারবারিরা। এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদে এই মাদক কারবারিরা জানিয়েছে, তারা কুমিল্লা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকা থেকে এসব চালান এনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দেয়। ১৫ই অক্টোবর শাহ্‌জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সৌদিগামী রেডিমেট গার্মেন্টস রপ্তানি চালানের ৩টি কার্টন থেকে ৩৮ হাজার ৯০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। যার বাজারমূল্য ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও বাংলাদেশ কোস্টগার্ড মাদকদ্রব্য উদ্ধার করে। এই পাঁচটি সংস্থা চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ৪৭ হাজার ১০১টি মামলা করেছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৬৩ হাজার ৩৭৪ জনকে। এই সাত মাসে সংস্থাগুলো ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করেছে ১ কোটি ৭১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৮৩টি। ২৬ হাজার ৬৭৪ কেজি গাঁজা, ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯৬৭ বোতল ফেন্সিডিল, ১০৮ কেজি হেরোইন, ৫৬ হাজার ২৭৬ বোতল বিদেশি মদ, ৩০ হাজার ৫২৬ বোতল বিয়ার, ৩৯ হাজার ৩৬৬টি ইনজেকটিং ড্রাগ। ২০১৯ সালে সংস্থাগুলো কর্তৃক মামলা দায়ের হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৯৮টি। আসামি করা হয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ৮৪৭টি। ওই বছর উদ্ধার করা হয়েছিল ৩ কোটি ৪৪ লাখ ৬ হাজার ৩২৮ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৩২৩ কেজি হেরোইন, ৩২ হাজার ৬৫৭ কেজি গাঁজা, ৯ লাখ ৭৬ হাজার ৬৬৬৩ বোতল ফেন্সিডিল, ১ লাখ ১৩ হাজার ২৭৯ বোতল বিদেশি মদ, ৬৮ হাজার ২৭০ বোতল বিয়ার, ৪১ হাজার ২৩৬টি ইনকেজকটিং ড্রাগ। ২০১৮ সালে একই সংস্থা কর্তৃক মামলা দায়ের হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৭৮টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৩২৩জনকে। উদ্ধার করা হয়েছে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার ৫৪৮ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৪৫১ কেজি হেরোইন, ৬০ হাজার ২৯৫ কেজি গাঁজা, ৭ লাখ ১৫ হাজার ৫২ বোতল ফেন্সিডিল, ১ লাখ ৫ হাজার ৭১৯ বোতল বিদেশি মদ, ১ লাখ ১৩ হাজার ৯১ টি বিয়ার ক্যান, ১ লাখ ২৮ হাজার ৭০৮টি ইনজেকটিং ড্রাগ।

সারা দেশে মাদকের আগ্রাসন বেড়ে যাওয়াতে ২০১৮ সালের ১৫ই মে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটা করে মাদকবিরোধী অভিযানে নামে। ওই সময় চিহ্নিত মাদক স্পটগুলোতে কিছুদিন অভিযান চালানো হয়। গ্রেপ্তার করা হয় অনেক মাদক ব্যবসায়ীকে। বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যও উদ্ধার করা হয়েছিল। কিন্তু সেই অভিযান বেশিদিন নিয়মিত করা হয়নি। অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাদকের ছিঁচকে কারবারিদের গ্রেপ্তার করলেও গডফাদাররা আড়ালে-আবডালে থেকে যায়। অনেকে দেশে আবার কেউ কেউ বিদেশে গিয়ে আত্মগোপন করে। অভিযান স্তিমিত হওয়ার পর গডফাদাররা আবার দেশে ফিরে এসে ফের চাঙ্গা করে ব্যবসা। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর এক হিসাবে দেখা মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বন্দুক যুদ্ধে প্রাণহানি হয়েছে ৫৪৯ জনের। এরমধ্যে র‌্যাব’র সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ১৫৫ জন। পুলিশের সঙ্গে ২৫৫, ডিবি পুলিশ ৫৯ জন, বিজিবি’র সঙ্গে ৭৭ জন ও যৌথ বাহিনীর অভিযানে আরও তিন জন নিহত হয়েছেন।

আড়াই বছরের পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিবছরই মামলা ও আসামির সংখ্যা বাড়ছে। তেমনি রেকর্ড পরিমাণ উদ্ধারও হচ্ছে। এছাড়া মাদক আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন সংশোধন করা হয়েছে। তবুও কমছে না মাদকের আগ্রাসন। সংশ্লিষ্ট সূত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন বিভিন্ন অভিযানে প্রায়ই মাদক ব্যবসায়ীরা গ্রেপ্তার হয়। কিন্তু আসামিরা আইনের ফাঁকফোকড় দিয়ে জামিনে বের হয়ে আসে। এছাড়া তদন্ত কর্মকর্তারা আদালতে সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে মাদকের মামলা আদালতে টিকে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাক্ষী-প্রমাণ হাজির করতে না পারার কারণে ২০/২৫ বছর আগের মামলাও আদালতে ঝুলে আছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক ও পুলিশের উপ মহাপরিদর্শক কুসুম দেওয়ান বলেন, মাদকের বিস্তার বেড়ে গেছে সেটা বলা যাবে না। তবে মাদক কারবারিরা তাদের মতো করে বিস্তারের চেষ্টা করছে। আর আমরাও তাদেরকে আটকের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া মাদক ব্যবসা একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে বিষয়টা এমন নয়। সব এজেন্সিগুলো মাদক নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য ঘন ঘন বড় বড় চালান আটক হচ্ছে। তিনি বলেন, গডফাদারদের তালিকা আমাদের কাছে আছে। তালিকা ধরে ধরে আমরা কাজ করছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের কার্যক্রম থেমে নাই। লাভজনক ব্যবসা হওয়াতে প্রায়ই নতুন নতুন মুখ মাদক ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছুদিন পর পর আমাদের তালিকা হালনাগাদ করা হয়। তালিকায় নতুন কারো নাম এলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com