ফরাসিরা কেন অভিযোগ করতে ভালোবাসে

0

ফরাসিরা নানা বিষয় নিয়ে অভিযোগ করতে বেশ পছন্দ করে। তাদের মতে, অভিযোগ করা মানে নতুন সম্পর্কের শুরু, কোনো একটি বিষয়কে আরও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। অন্য দেশে যেখানে অভিযোগ করার অর্থ কথার সমাপ্তি, সেখানে ফ্রান্সে কথা শুরু হয় অভিযোগ দিয়ে। লিখেছেন আরফাতুন নাবিলা

ফ্রান্সে অভিযোগের রীতি

ফ্রান্সে একে অন্যের মধ্যে কথোপকথনে সকাল শুরু হয় কিছুটা এভাবে : আবহাওয়া খারাপ, আঙুরের ফলন একদম ভালো নয়, রাজনীতিবিদরা সবাই অযোগ্য এ ধরনের অভিযোগের সুরে। একে অন্যের সঙ্গে হয়তো খাবার খেতে বসেছেন। সেখানেও প্রায় এ রকমই গল্প। এমনকি অচেনা কেউ হলেও শুরুর দিকে তারা কথাও শুরু করে খানিকটা অভিযোগ মিশিয়ে। অন্য দেশে এ রকম বিষয় ইতিবাচকভাবে দেখা না হলেও ফ্রান্সে অভিযোগ করে কথা বলা খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। কথা বলার শুরুতে অথবা অনেকক্ষণ কথা বলতে হলেও অভিযোগের বিষয়টি চলে আসে। কেউ হয়তো একটি রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে গিয়ে সেখানে বসেই খাবার পরিবেশনের দুর্বল বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা শুরু করে দিল অথবা কারও নতুন বাসার জানালাগুলো হয়তো পশ্চিমমুখী, তখন তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হলো নতুন পর্দা কেনার কথা। এ রকম ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ফরাসিদের অভিযোগের শেষ নেই। কানাডিয়ান সাংবাদিক জুলি বারলোর মতে, ‘আমেরিকানদের কাছে আপনি যদি নেগেটিভ কোনো কথা বলেন এর অর্থ হচ্ছে আপনি আর কথা বলতে চাচ্ছেন না। আর ফ্রান্সে এমন হওয়ার অর্থ হচ্ছে আপনি অন্য ব্যক্তিকে কথার পৃষ্ঠে কথা বলার জন্য অনুমতি দিচ্ছেন বা আগ্রহ জন্মাতে চাচ্ছেন। ফরাসিরা যেমনভাবে অভিযোগ বিষয়টির সঙ্গে অভ্যস্ত, উত্তর আমেরিকার মানুষরা ততটা নয়। তারা আসলে বদমেজাজি। বেশির ভাগ সময়েই কিছুটা গণ্ডগোল ভালোবাসে। অথবা কথা বলতে বলতে দারুণ কিছু তথ্য হয়তো সামনে চলে আসে যাতে তাদের জানার আগ্রহ আরও বাড়ে। কথার শুরুতে যেটিকে দ্বন্দ্ব বা অভিযোগ বলে মনে হয়, সেটি আসলে সহজভাবে বলা কোনো কথা নয়। সাধারণত অন্য দেশের মানুষ এভাবে কথা বলে না। আবার বলা যায় এটা আসলে তাদের চিন্তা প্রকাশের ধরন।’ 

ফ্র্যাংকো-হাঙ্গেরিয়ান-আমেরিকান লেখক এবং প্যারিস ইনস্টিটিউট ফর ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের ক্রিয়েটিভ রাইটিং ডিপার্টমেন্টের প্রধান অ্যানা পলোনয়ি বলেন, ‘আমেরিকানদের সঙ্গে এই পার্থক্য হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে নিজেদের ‘পরাজিত’ হিসেবে যেন পরিচিতি না পেতে হয়। তবে ফ্রান্সে এ বিষয় নিয়ে কেউ ভয় পায় না। কারও মধ্যে দ্বিধাও কাজ করে না। কারণ হেরে যেতে হলে আপনার চারপাশের জয়ের বিষয়গুলো নিয়েও চিন্তা করা প্রয়োজন। আর সামাজিক যোগাযোগের জন্য তারা এত কিছু লক্ষ করে বলে আমার মনে হয় না।’ অ্যানা বড় হয়েছেন মধ্য পশ্চিমা যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্য লোয়াতে। কিছুদিন ফ্রান্সে থেকে তিনি যখন আবার লোয়াতে ফিরে এলেন, তখন তিনি দুই জায়গার পার্থক্য বুঝতে পারলেন। খেয়াল করলেন, এখানকার সবাই যতটা সম্ভব নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে দূরে থাকে। যখন নিজের ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার কোনো বিষয় আসে, তখনই কেবল জোর গলায় কোনো ব্যক্তি নিজে থেকে দাঁড়িয়ে কথা বলেন। তবে এটাকে ঠিক অভিযোগ বলা চলে না। এ হচ্ছে দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেকে প্রকাশ করা। মনে হতো যেন, লোকেরা আসলে অভিযোগের মাধ্যমে কোনো রকম ঘনিষ্ঠতা করতে চাচ্ছেন না। একদম জোর গলায় কথা না বললেই চলছে না ঠিক তখনই তারা কথা বলেন। অ্যানা বলেন, ‘আমেরিকান অভিযোগে কথার শেষে সংযুক্ত করা আরও একটি লাইন থাকে। যখন আমি ইংরেজিতে কোনো অভিযোগ করি, তখন সেটিকে পুরো ভেঙে বলতে হয় অথবা তার শেষে কোনো বাক্য যুক্ত করতে হবে। ধরুন, কোনো বিষয়ের প্রত্যাশা নিয়েই আমি কথা বলছি, অথচ এর শেষে আমাকে বলতে হবে, ওহ! আমাকে এখন এসব বিষয়ের মধ্য দিয়েও যেতে হবে! কিন্তু ফরাসিদের বেলায় এ রকমভাবে কথা শেষ করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাদের মনোভাব কিছুটা এ রকম : আমি যত নির্দিষ্টভাবে কোনো অভিযোগ করতে পারব, ততো আমি অন্য ব্যক্তিকে জিনিসটার নেতিবাচক দিক সম্পর্কে বোঝাতে পারব।’ ফ্রান্সে অভিযোগ শব্দটিকেও ব্যবহার করা হয় কিছুটা বুঝেশুনে। আমরা যেটাকে সরাসরি অভিযোগ বলে বসি, তাদের ওখানে অভিযোগকে বোঝানোর জন্যও কয়েকটি শ্রেণি আছে। যেমন সাধারণত পুরনো অভিযোগকে বোঝাতে সেখানে বলা হয় ‘সু প্লাদোহাঁ’, আনুষ্ঠানিক অভিযোগকে বলা হয় ‘পোর্তে প্লান্ত’, অভিযোগ যখন শুধুই মজার জন্য তখন বলা হয় ‘হ্যালে’।

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফরাসি ভাষার সিনিয়র লেকচারার ডক্টর জিমা কিং বলেন, বদমেজাজি ফরাসিদের আপনি প্রায় সময়ই বিমর্ষ দেখবেন। তারা সব সময়ই কিছু না কিছু নিয়ে নালিশ করছে। আপনি হয়তো কোনো কিছু নিয়ে বিরক্ত অথচ সে কাজটি করেই যাচ্ছেন আর এটাই হয়তো স্বাভাবিক। যা সাধারণ নিয়ম সেভাবেই মেনে চলছেন সব। কিন্তু ফ্রান্সে ‘পর্টার প্লেইনতে’ অভিযোগ অনুযায়ী, বিরক্ত হলে সেটি নিয়ে আপনি কিছুই করছেন না বা বলছেন না তাহলে কেন কেউ আপনার কথা শুনবে? পলোনয়ি ফ্রান্সে এসে অভিযোগের এ বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। তার মতে, ‘কেউ যদি অভিযোগ করে, তখন আমার মনে হয় তার এখানে গুরুত্ব রয়েছে। আমি নিজেও আগে গুরুত্ব খুঁজি। আমার কাছে মনে হয়, টিকে থাকার জন্য এই অভিযোগটা জরুরি।’

ইতিবাচক অভিযোগ

ফরাসিদের সরাসরি এমন অভিযোগ করার বিষয়টি অবশ্য ইংরেজিতে কথা বলেন এমন অনেকের কাছে বেশ আপত্তিকর। তাদের মতে, নেতিবাচক কথাই নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে। আবার কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, ফরাসিদের এমন আচরণ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। যদিও নেতিবাচক আচরণের কিছু খারাপ দিক তো অবশ্যই আছে। ২০১৩ সালে বায়োলজিক্যাল সাইকিয়াট্রির একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, নেতিবাচক অনুভূতির কারণে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ২০১১ সালে অস্টিনের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, নেতিবাচক অনুভূতি মানুষকে আরও বেশি আক্রমণাত্মক মনোভাবের করে তোলে। অভিযোগের ফল সব সময় ইতিবাচক হয় না। সব সময় নালিশ করতে করতে যে কারও মনোভাব সম্পূর্ণ নেতিবাচক হয়ে যেতে পারে, তাই মস্তিষ্কও সব সময় নেতিবাচক চিন্তার দিকেই উৎসাহিত হয় বেশি। তবে ফরাসিরা এ ধরনের নেতিবাচক দিক বেশ ভালোভাবেই এড়াতে পারেন; কারণ ব্যক্তিগত জীবনের চেয়ে বাহ্যিক ইস্যুগুলো নিয়েই তারা কথা বলেন বেশি। অভিযোগ নিয়ে একটা জরিপ করা হয়েছিল। জরিপ অনুযায়ী ফরাসি জনগণের ৪৮ শতাংশ অভিযোগ করেছে সরকারের বিরুদ্ধে। এটা অবশ্য খুব একটা অবাক করা কথা নয়। কারণ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো যেভাবে মহামারী সামলেছেন তাতে ফরাসি জাতি সন্তুষ্ট নয়। তার প্রতি পুরো জাতির মনোভাবই নেতিবাচক। ব্যক্তিগত কারণেও তারা নিয়মিত অভিযোগ করতে থাকে। জরিপ অনুযায়ী, ২৩ শতাংশ অভিযোগ করে যখন কেউ তাদের কল ব্যাক না করে, ৩৩ শতাংশের অভিযোগ তারা চাবি অথবা ফোন খুঁজে পাচ্ছে না, ১২ শতাংশ শিশুদের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগ জানায়।

বারলোর মতে, ‘আমার মনে হয় ফরাসিরা জাতি হিসেবে খুবই আশাবাদী। নিজেদের জীবনযাপনের ব্যাপারে যথেষ্ট ইতিবাচক। কিন্তু দেশে থাকার জন্য তাদের অনেক কষ্ট করতে হচ্ছেএমনটা দেখানো তাদের প্রবণতা। কোনো অনুষ্ঠানে অংশ না নিয়ে যদি আপনি ফ্রান্সের প্রশংসা করেন, তবে আপনাকে নিয়ে মানুষ হাসবে।’ বেলজিয়ামের ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি লিউভেনের একজন গবেষক মারগট বাস্টিন। তিনি অভ্যন্তরীণ নেতিবাচক আচরণ কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, সেটি নিয়ে গবেষণা করেন। গবেষণাপত্রে তিনি বলেছেন ফরাসিরা যেভাবে নিজেদের ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়ে আগ্রহ দেখান, সেটাই বরং তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তবে এই নেতিবাচক আচরণ তা যেকোনো বিষয়েই হোক না কেন, যদি অতিরিক্ত হয়ে যায়, তবে সেটি তখন ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ফরাসি জাতি কখনো একসঙ্গে বিপর্যয়ের দিকে ঝুঁকে যায় না। আবার যদি কোনো পরিবর্তনের বিষয় আসে সেখানেও অভিযোগের মাত্রা কমে আসে। আমেরিকায় যখন ম্যানেজারের কোনো ভুল বা সঠিক কাজ নিয়ে কোনো কথা হয়, তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে অভিযোগ শোনানো হয়। সেখানে তাদের আর নতুন করে কথা বলার কোনো সুযোগ থাকে না। কিন্তু ফ্রান্সে বিষয়টা একটু অন্য রকম। অভিযোগ মানেই তাদের কাছে কথা শেষ নয়। তারা পরবর্তী সময়ে তাদের মতামত রাখতে পারে। বারলোর মতে, ‘আমার কাছে মনে হয় না তারা আসলে কোনো কিছু পরিবর্তন করতে চায় সে জন্য অভিযোগ করে। বিষয়টা আসলে তাদের সংস্কৃতি, কথোপকথনের সঙ্গেই মিশে আছে।’

ফ্রান্সে অভিযোগ করার বিষয়টি হলো একে অন্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের একটি সুযোগ। আর এ উপায়টা বেশ উপযুক্ত। ওকলাহামা ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা অনুযায়ী, যোগাযোগের জন্য সম্পর্ক তৈরি করতে অভিযোগ বেশ ইতিবাচক একটি মাধ্যম। বন্ধন তৈরি করতেও অভিযোগের বেশ গুরুত্ব রয়েছে। বাস্টিনের মতে, যখন অপর একজন ব্যক্তি আপনার কথা শুনছে, আপনি তখন তার সঙ্গে বেশ আপন অনুভব করবেন। আনন্দিত হবেন এই ভেবে যে, তিনি আপনাকে বুঝতে পারছেন।

অভিযোগের শুরু কবে থেকে

অনেকের মতে, ফরাসি জাতির এমন অভিযোগের শুরু ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে, যখন থেকে খাবার সংকট দেখা দেয়, বাড়তে থাকে ট্যাক্স, সামন্ততান্ত্রিক কিছু সামাজিক সংগঠন সোচ্চার দাবিতে রাস্তায় নামে। ফরাসিদের বিক্ষোভের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এ ছাড়া আছে শক্তিশালী ইউনিয়ন সংস্কৃতি যার চিত্র দেখা গেছে পর্যায়ক্রমিকভাবে বেশ কয়েকটি ধর্মঘটে। ফ্রান্সে যারা চাকরি খুঁজছে অথবা চাকরি থেকে বাদ পড়েছে তাদের সবার কাছে ‘মানুষের রাগের কথা শোনো’ এবং ‘জয়ের জন্য যুদ্ধ’ এই দুটো শব্দ অনেক বেশি শোনা যায়। উচ্চ কণ্ঠে জোর প্রতিবাদ করা অথবা কোনো অভিযোগ করার অর্থ ফরাসিরা নিজেদের দেশকে পদদলিত করতে চায় এমন নয়; বরং অন্যায় আর ধ্বংসের বিরুদ্ধে তৈরি করা নীতিগুলোকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করা। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ২০১৮ সালের অক্টোবরে হওয়া ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলনে এই অভিযোগ আরও বেশি শোনা গিয়েছিল।

ফ্রান্সে অভিযোগ যেকোনো বিষয় নিয়েই শুরু হতে পারে। যেকোনো নীতি, ট্যাক্স, আধুনিক জীবনের নানা পরিবর্তন, ব্যবহার্য জিনিস, শিল্প সব বিষয় নিয়ে ফরাসিরা নিজেদের কণ্ঠ সোচ্চার করতে পারে। এটাকে যদিও সহজ ভাষায় অভিযোগ বলা হয়, তবু নেতিবাচক কথার কারণে প্রতিটি বিষয়ের ভিন্ন একটা দিক সামনে আসে। যার সমাধান করা গেলে চমৎকার একটা ফল আসতে পারে। এ ধরনের সমালোচনামূলক মানসিকতা সংস্কৃতিচর্চায় উৎসাহিত হতে পারে বলে ফরাসিরা বিশ্বাস করে। আবার রাজনীতি, শিক্ষাসহ নানা বিষয় নিয়ে আওয়াজ তুলেও যে তার পরিবর্তন করা সম্ভব, এ বিষয় নিয়েও তারা বেশ সচেতন। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, শিক্ষার্থী, গীতিকার এমন মানুষদের কাছ থেকে যখন অভিযোগ আসে, তখন সেগুলোকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। কারণ সবাই জানে তাদের বলা অভিযোগগুলো গুরুত্ব দিলে সেই সংশ্লিষ্ট প্রতিটি নিয়মনীতিতে পরিবর্তন আসবে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com