রাজপথে ‘বৃহত্তর আন্দোলনের’ বার্তা

0

দীর্ঘ প্রায় দুই বছরের অধিক সময়ে ধরে (ষড়যন্ত্রমূলক) মামলায় কারাবন্দি থাকা দলের চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ শারিরীক অবস্থা নিয়ে এখন মুক্ত, তবে এখনও তিনি প্রায় ‘গৃহবন্দি অবস্থায়’, দেশে গণতন্ত্র অনুপস্থিত। ফলে এমন পরিস্থিতিতে বৃহত্তর আন্দোলন ছাড়া বিকল্প পথ দেখছে না বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি।

গতকাল ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে বিএনপি। এক ভার্চুয়াল সভায় দলের নীতিনির্ধারকরা রাজপথে আবারও কঠোর ও বৃহত্তর আন্দোলনের বার্তা দিয়েছেন। শীর্ষ নেতাদের সবারই মুখেই গণতন্ত্র ও খালেদা জিয়াকে পূর্ণমুক্ত করতে আন্দোলনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

অনুষ্ঠানে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের জন্যই দেশনেত্রী আজকে গৃহবন্দি অবস্থায়, কারাবন্দি হয়ে আছেন। তার যে ত্যাগ গণতন্ত্রের জন্য, বাংলাদেশের মানু্ষের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য-এটা নিসন্দেহ অপরিসীম একটা ত্যাগ। আজকে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমাদের বড় প্রতিজ্ঞা হোক- যেকোনো মূল্যে আমাদের চ্যালেঞ্জ গণতন্ত্রকে উদ্ধার করা, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা। দেশনেত্রীকে মুক্ত না করলে গণতন্ত্র মুক্ত হবে না-এটা হচ্ছে জরুরি কথা এবং সেটা আমাদেরকে অবশ্যই অত্যন্ত যথাযথ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সফল করতে হবে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজ বিশ্ব রাজনীতি পরিবর্তিত হচ্ছে। ১৯৭১ সালে যে পরিস্থিতি ছিলো, এখনকার পরিস্থিতি এক নয়, ১৯৭৫ সালে যে পরিস্থিতি ছিলো, এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। আজকে ২০২০ সালে যে বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট, সেই বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটকে অনুধাবণ করে এবং যোগ্য কৌশল উদ্ভাবন করে আমাদেরকে সেই কৌশলের সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য গণতান্ত্রিকভাবেই এগিয়ে যেতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত সত্য কথা আন্দোলনের কোনও বিকল্প নাই। কিন্তু সেই আন্দোলন কিভাবে ফলোপ্রসু হবে সেই বিষয়টা আমাদেরকে দেখতে হবে, বুঝতে হবে এবং তার জন্য আমাদেরকে আলোচনা করতে হবে, আলোচনার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।’

জিয়াউর রহমানসহ জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে সরকারের অপপ্রচারের উদ্দেশ্য নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার কৌশল উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে ছাত্র সংগঠনকে ‘ভ্যানগার্ডের’ ভুমিকা পালন করার আহবান জানান বিএনপি মহাসচিব।

সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আসুন হতাশ হবেন না, অনেকে হতাশার কথা বলেন। হতাশ হওয়ার হওয়ার সুযোগ নেই্। এটা বিএনপির ওপর দায়িত্ব। গোটা জাতি এটা বিএনপির ওপর দিয়েছে। আজকে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গোটা জাতির ভবিষ্যত নির্ভর করছে। তিনি বিএনপিকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন, এই জাতিরকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে হবে, গণতান্ত্রিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ যার স্বপ্ন শহীদ জিয়াউর রহমান দেখিছিলেন যার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন এবং যার পতাকা দেশনেত্রীর উড্ডীন করেছেন সেটা সফল করতে হবে।’

৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপির উদ্যোগে এই ভার্চুয়াল আলোচনা হয়। আলোচনায় প্রধান অতিথি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বক্তব্য রাখেন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টম্বর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সকালে স্বাস্থ্য বিধি মেনে শেরে বাংলা নগরে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা জিয়াউর রহমানের কবরে পুস্পমাল্য অর্পন করেন।

স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বর্তমান বাংলাদেশে দুইটা দুর্যোগের মধ্যে আছে। একটা হচ্ছে আওয়ামী দুর্যোগ আরেকটা হচ্ছে করোনা দুর্যোগ। এই দুই দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ অতিক্রম করছে। সেজন্য দেশে রাজনীতি নেই, গণতন্ত্র নেই্, বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ বিপর্য্স্ত..। এই অবস্থা থেকে পরিবর্তন আসবে। সেই পরিবর্তন করার দায়িত্বটা বিএনপির। কেননা আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র হত্যা করেছে, তারা তো গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেবে না, মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেবে না। সেজন্য বিএনপিকে সেই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার গুরু দায়িত্ব নিতে হবে। দেশের সকল জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে ইস্পাত কঠিন গণঐক্য করে এই সরকারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে।’

স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, ‘আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া একটা অহেতুক বানোয়াট মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন।দুই বছর তাকে কারাগারে রেখেছিলো।এখন তার সাজা স্থগিত রেখে তাকে বাড়িতে রেখেছেন। কিন্তু অন্তরীন থাকার মতোই। তিনি সম্পূর্ণভাবে মুক্ত নন। আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে তাকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করা। এটা আমাদের একটা অন্যতম কর্তৃব্য হবে বা লক্ষ্য হবে বেগম খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে আমাদের মাঝখানে নিয়ে আসা।’

লন্ডন থেকে তারেক রহমান বিএনপিকে নেতৃত্ব দেয়ায় তার ভুয়সী প্রশংসাও করেন মওদুদ। বিএনপিকে ভয় পায় বলে সরকার প্রধানসহ নেতারা বিএনপি, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে স্থায়ী এই সদস্য বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন হবে। তবে এই পতন নিজের থেকে হবে না। অন্য কেউ এসে করে দেবে না। এই পরিবর্তন আমাদেরকেই করতে হবে, দেশে গণতন্ত্র আমাদেরকে ফিরিয়ে আনতে হবে।’

‘শহীদ জিয়াউর রহমানের গণতন্ত্র, বেগম খালেদা জিয়ার সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য, আইনের শাসন ফিরিয়ে আনার জন্য, দেশে একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি ফিরি্রে আনার জন্য আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং আন্দোলন করতে হবে। আমাদেরকে প্রয়োজনে আরো ধরয্য ধরতে হবে কিন্তু আন্দোলন ছাড়াই এই কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের কোনো বিকল্প আছে বলে আমি মনে করি না।’

স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে দেখা যায়, বিলুপ্তি ঘটে। এখানে কী হয়েছে? এখানে যায় বিলুপ্তি ঘটে না, এই ফ্যাসিবাদী সরকারের বিলুপ্তি ঘটাতে হবে।কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকার, কোনো ফ্যাসিবাদী সরকার কখনোই বিনা চ্যালেঞ্জে বিনা আন্দোলনে যায় না, আওয়ামী লীগও যা্বে না। কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিবাদী সরকার-এদেরকে তাড়াতে হবে। এদের তাড়ানোর জন্য এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমাদের শপথ হোক-আমরা যেকোনো মূল্যে আমাদের নেতার নির্দেশে আমরা এমন কিছু করবো, যেমনি আমরা নব্বইয়ে এবং পরবর্তি সময়ে আন্দোলনে আমরা ফ্যাসিবাদী সরকারকে তাঁড়িয়েছিলাম, এই সরকারকেও ইনশাল্লাহ আমরা তাড়াবো। আজকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।’

১৯৭২-৭৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা ও ভিন্ন চিন্তার মানুষ হত্যার ইতিহাস তুলে ধরে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘ওই সময়ে তারা (আওয়ামী লীগ) মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা শুরু করে যার তালিকা ৩০ হাজারের উপরে। সেই দল দাবি করে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দল। তারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করেছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে বা ৭০ সালের নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন তার মধ্যে ৪৩ জন আছেন যারা পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন, যারা স্বাধীনতার যুদ্ধের বিপক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন তারা কিন্তু ঘুরে-ফিরে আবারো এই সংসদে আসছেন। তাদেরকে তিরস্কারও হয়নি, তাদের বিচারও করা হয়নি, তাদের আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কারও করা হয়নি। তারা নাকি মুক্তিযুদ্ধের দল।’

তিনি বলেন, ‘শহীদ জিয়াউর রহমান খাল খনন করছিলেন কেনো? শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব? কি কারণে পানির অভাব? ফারাক্কার মধ্য দিয়ে এই যে পানি প্রবাহ আটকানো। তিনি ভেবেছিলো যে ফারাক্বায় ভারতের সাথে চুক্তি করে পানি এনে পারবে না। তাই তিনি স্বনির্ভর করার জন্য পানির ক্ষেত্রে খাল-বিল-নদী-নালা খননের কাজ শুরু করেন। তখন সংসদে আওয়ামী লীগের এক নেতা রসিকতা করে বলেছিলো, জিয়াউর রহমান খাল কেটে কুমির আনছেন।’

গয়েশ্বর বলেন, ‘সেদিন তার কথাটা কেউ পছন্দ না করলে আজকে দেখা যায়- জিয়াউর রহমান খাল কেটে পানি আনার সাথে যে একটা কুমির আসছিলো অনেক কাল পরে জনগণ লক্ষ্য করছে। যে কুমিরের পেটে আজকে গণতন্ত্র, যে কুমিরের পেটে আজকে বিচার বিভাগ, যে কুমির বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করে, যে কুমির খুন করে, গুম করে, যে কুমিরের কারণে দেশনেত্রীকে বিনা বিচারে জেলে থাকতে হয়।’

মহাসচিবের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির সঞ্চালনায় ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য জমিরউদ্দিন সরকার, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস-চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের হাবিব উন নবী খান সোহেল, উত্তরের মুন্সি বজলুল বাসিত আনজু, যুবদলের সাইফুল আলম নিরব, শ্রমিক দলের আনোয়ার হোসেইন, মহিলা দলের আফরোজা আব্বাস, মুক্তিযোদ্ধা দলের ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, স্বেচ্ছাসেবক দলের আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল, ছাত্রদলের ফজলুর রহমান খে্াকন, মৎস্যজীবী দলের আবদুর রহিম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে অঙ্গসংগঠনের কাজী আবুল বাশার, আবদুল আলীম নকি, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, হাসান জাফির তুহিন, সুলতানা আহমেদ, নজরুল ইসলাম তালুকদার, ইকবাল হোসেন শ্যামলও যুক্ত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে উলামা দলের শাহ নেছারুল হক দলের প্রতিষ্ঠাতাসহ নেতা-কর্মীদের জন্য মোনাজাত পরিচালনা করেন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com