এত অনিয়ম করেছেন সেব্রিনা ফ্লোরা!

0

তথ্য গোপন করে একাধিক যোগ্য ও দক্ষ বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদফতরে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) হিসেবে যোগদান করেছেন প্রফেসর ডা: মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা। গত ১৩ আগস্ট মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। যদিও এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম, সরকারি কর্মচারী বিধিবিধান না মানা এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকে অভিযোগ পর্যন্ত রয়েছে। তারপরও অদক্ষ ও বিতর্কিত এই কর্মকর্তাকে এই পদে পদায়ন করায় অধিদফতরের সর্বস্তরে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

অধিদফতরের বিভিন্ন স্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে চাকরিতে যোদগদানকারী এই কর্মকর্তার চাকরি স্থায়ী হয় ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল। মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব হুমায়ন কবীর স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে চাকরি স্থায়ীকরণ করা হয় তবে বিসিএসে আত্তীকরণ হননি। পুরো চাকরিজীবনে এক দিনের জন্যেও মাঠপর্যায়ে চাকরি করেননি তিনি। এমনকি উপজেলা, জেলা বা মেডিক্যাল কলেজ পর্যায়েও নয়। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, বিভাগীয় পরীক্ষা, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষার মতো বাধ্যতামূলক মৌলিক বিষয়গুলো তিনি সম্পন্ন করেননি। এমনকি এগুলো থেকে তিনি প্রমার্জনাও পাননি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সরকারি সব ধরনের নিয়ম নীতি উপেক্ষা করে সেব্রিনা ফ্লোরাকে এই পদে পদায়ন করা হয়েছে। তারা বলেন, ‘দি বিসিএস রিক্রুটমেন্ট রুলস ১৯৮১ এবং দি বিসিএস এক্সামিনেশন ফর প্রমোশন রুলস ১৯৮৬, এজ এমেনমেন্ড আপটু আগস্ট ১৯৯৯’ অনুযায়ী কাউকে অতিরিক্ত মহাপরিচালক হতে হলে, তাকে অবশ্যই কমপক্ষে ১৮ বছরে চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এ ছাড়া অর্থ ও হিসাব শাখার পরিচালক, চিকিৎসা শিক্ষা, জনশক্তি উন্নয়ন, প্রাইমারি হেলথ কেয়ার, রোগনিয়ন্ত্রণ, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার, আইপিএইচএন, আইপিএইচ, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল- এই প্রতিষ্ঠানগুলোর যেকোনো একটির পরিচালক হিসেবে কমপক্ষে দুই বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এ ছাড়া মেডিক্যাল কলেজ, নিপসম, এনআইসিভিডি, আরআইএইচডি, এনআইও, আইডিসিএইচ অথবা মেডিক্যাল কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল বা প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথবা নিপসমের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে নিপসমে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে; কিন্তু এর কোনোটির অভিজ্ঞতাই তার ছিল না।

এ অবস্থায় বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের শিডিউলভুক্ত পদে নন বিসিএস (স্বাস্থ্য) কর্মকর্তা পদায়ন বাতিলের দাবি জানিয়েছে বিসিএস হেলথ অ্যাসোসিয়েশন। গত বুধবার তারা এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়েছে। বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি প্রফেসর ডা: আ ম সেলিম রেজা স্বাক্ষরিত ওই চিঠির অনুলিপি বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকেও দেয়া হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন সময়ে বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের শিডিউলভুক্ত বিভিন্ন পদ (যেমনÑ অতিরিক্ত মহাপরিচালক, বিভিন্ন ইনস্টিটিউট প্রধান, মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ, হাসপাতাল পরিচালক, অধিদফতরের পরিচালক, বিভাগীয় পরিচালক, সিভিল সার্জন, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা) নন বিসিএস কর্মকর্তাদের পদায়িত করা হচ্ছে, যা ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮১’, ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা) বিধিমালা, ১৯৮৬’ এবং ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা) বিধিমালা, ২০১৭’ পরিপন্থী।

চিঠিতে বলা হয়, এ ধরনের পদায়নের ফলে এক দিকে যেমন বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের কর্মকর্তারা অধিকারবঞ্চিত হওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে, যা কর্মস্পৃহা নষ্ট করছে। অন্য দিকে সরকারের স্বাস্থ্যসেবাও ব্যাপকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। তাই ক্যাডার পদে নন ক্যাডার পদায়ন অচিরেই বন্ধ করার পাশাপাশি চলমান ও প্রক্রিয়াধীন পদায়ন স্থগিতসহ এবং আগের পদায়ন বাতিল করে ক্যাডার কর্মকর্তা পদায়ন করতে হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাকরিতে যোগদানের পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য সেব্রিনা ফ্লোরা বিদেশ গমন করেন। লিয়েন শেষে ২০০৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সহযোগী অধ্যাপক চলতি দায়িত্ব হিসেবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোস্যাল মেডিসিন-নিপসমে যোগদান করেন। ২০০৯ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ক্ষতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের তালিকা প্রণয়ন করা হলে তিনিও আবেদন করেন। ২০১০ সালের ১৪ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-১ শাখা থেকে এ সংক্রান্ত রিভিউ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, ডা: মীরজাদি সেব্রিনা সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিয়মিত হননি। বিষয়ভিত্তিক সিনিয়রিটিতে তার অবস্থান ৪র্থ। তার থেকে সিনিয়র আরো তিন কর্মকর্তা বর্তমানে কর্মরত আছেন। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে আবেদন করলেও তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ছিলেন না।

নিপসমে চাকরিকালীন তিনি বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সহযোগী প্রতিষ্ঠানে (বিআইএসচএস) চাকরি করেছেন, নিয়মিত বেতন নিয়েছেন। সেই সময়ে গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত সংবাদও প্রকাশ হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি চাকরিতে কর্মরত অবস্থায় ২০০৮ সালে তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্স-এ ‘এপিডেমিওলজি এন্ড বায়োস্ট্যাটিস্টিক্স’ বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন পরিচালক প্রফেসর ডা: লিয়াকত আলী স্বাক্ষরিত নিয়োগপত্রে দেখা যায়, প্রথমে তাকে এক বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। একই বছর ৪ মে তার স্বাক্ষরিত নোটিশেও তার প্রমাণ মেলে। এ ছাড়া তিনি নিয়মিতভাবে সেখানে কোর্স পরিচালনা করেন এবং সব ধরনের একডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে যুক্ত থাকেন। এমনকি বিআইএইচএস-এর হয়ে ‘ফোর্থ কনটিনিউইং পাবলিক হেলথ এডুকেশন (সিপিএইচই)’-এর অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ২০১১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠানটির এপিডেমিওলজি বিভগের বিভাগীয় প্রধান হিসবে দায়িত্ব পালন করেণ। যদিও একই সময়ে তিনি নিপসমের হাজিরা খাতায়ও স্বাক্ষর করেন। এরপর ২০১২ সালের ২৯ মে সেব্রিনা ফ্লোরা সহযোগী অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) থেকে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি পান এবং নিপসমের এপিডেমিওলজি বিভাগে তার পদায়ন হয়।

সে সময়ে এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। দুদকের তৎকালীন মহাপরিচালক আবু মো: মোস্তফা কামাল স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকে অবগত করা হয়। পরে মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব খাজা আব্দুল হান্নান বিষয়টি তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে মহাপরিচালককে অনুরোধ জানান। তবে অদৃশ্য কারণে এই তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।

এ বিষয়ে সরকারের সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো সরকারি কর্মকর্তা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারবেন না। তদন্তে বিষয়টি প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। সেখানে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা বা শাস্তি প্রদান করা হবে। কিন্তু কেউ যদি এ বিষয়টি গোপন করেন তাহলে যিনি বা যারা গোপন করেছেন তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেন, প্রফেসর ফ্লোরা আইইডিসিআর পরিচালক থাকাবস্থায় প্রতিষ্ঠানের ম্যান্ডেট অনুযায়ী করোনা প্রস্তুতি ও পূর্বাভাস দেয়ার কাজে সঠিক তথ্য, উপাত্ত, প্রজেকশন সরকারকে না দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছেন। সঠিক তথ্য না দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে দেরি করিয়েছেন। ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষা, সম্ভাব্য রোগীর সংখ্যা সম্পর্কে প্রজেকশন, কন্টাক্ট ট্রেসিং, হাসপাতালে কোভিড রোগীদের প্রয়োজনীয় শয্যাসংখ্যা সম্পর্কে যথাযথ প্রজেকশন প্রদান ইত্যাদি না করে তিনি মিডিয়ার সামনে ব্রিফিং করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রয়োজনের তুলনায় করোনা পরীক্ষা না করতে পারা, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করতে না পারা, কিটের স্বল্পতা এবং হাসপাতালে করোনা রোগীর চাপ বাড়তে শুরু করলে পরে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তত্ত্বাবধান করতে শুরু করেন। তার নির্দেশে অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com