বিবিএস’র প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন, অর্থনীতিবিদরা বলছেন পূর্বনির্ধারিত!

0

বিদায়ী ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু গড় আয়ের পরিসংখ্যান সম্প্রতি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। তবে এই পরিসংখ্যানের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, করোনা মহামারির মধ্যে পরিসংখ্যান ব্যুরোর জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যান বাস্তবসম্মত নয়। এই পরিসংখ্যানকে ‘পূর্বনির্ধারিত’ বলেও অভিহিত করছেন তারা। বলছেন, এই প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে দেশের বাস্তব পরিস্থিতির কোনো মিল নেই। এ ধরনের পরিসংখ্যান দেওয়ার জন্য বিবিএস গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। 

 এই পরিসংখ্যান নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তবে প্রবৃদ্ধি নিয়ে এসব প্রশ্ন বা সমালোচনাকে অনুমাননির্ভর বলে দাবি করেছেন  অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। 

২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৮ দশমিক ২০ শতাংশ, যা এর আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের অর্জিত প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৫ শতাংশের চেয়ে কিছুটা বেশি। করোনার অভিঘাত বিবেচনায় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বলছিল, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের জিডিপি ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেড় থেকে তিন শতাংশে নেমে আসবে। তবে করোনা বিবেচনায় নিয়েও অর্থ মন্ত্রণালয়ের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন ছিল ৫ দশমিক ২০ শতাংশ। শেষ পর্যন্ত পরিসংখ্যা ব্যুরো জানিয়েছে, ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। অন্যদিকে আগের অর্থবছরে যেখানে মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৯০৯ ডলার, সেখানে গেল অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ৬৪ ডলার।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সংকটময় মুহূর্তে মাথাপিছু আয় বাড়ার পাশাপাশি জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্জিত হওয়া একেবারেই অযৌক্তিক। এই প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতার কোনো মিল নেই। সাধারণ মানুষের পকেটের যে অবস্থা এবং তাদের জীবনযাত্রার যে সংগ্রাম, তার সঙ্গে এই প্রবৃদ্ধির কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, আসলে এই ধরনের প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। করোনার আগে থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতি খারাপের দিকে যাচ্ছিল। আমদানি ও রফতানি কমেছিল, রাজস্ব আয়সহ সবই ছিল নিম্নমুখী। করোনা ছাড়াই আমাদের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের মতো হতো। তাহলে করোনার প্রভাব কোথায় গেল? করোনায় কি অর্থনীতির ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা? তাই বিবিএস‘কে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ  বলেন, কিভাবে হিসাব করে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ? ১৫৫ ডলার বেড়ে মাথাপিছু গড় আয় কিভাবে দুই হাজার ৬৪ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে? আমি বুঝতে পারছি না। কোনো কিছুই সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হচ্ছে না।

তিনি বলেন, দেশে আমদানি-রফতানি-রাজস্ব সবই কমেছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান নিচে নেমেছে। কর্মসংস্থান কমেছে, মানুষের আয় কমেছে, বেকারত্ব বেড়েছে, শহর ছেড়ে মানুষ গ্রামে চলে যাচ্ছে। এত কিছুর পরও কিভাবে মাথাপিছু আয় আর প্রবৃদ্ধি বাড়ে?

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, আসলে বিবিএস যে হিসাব দিচ্ছে, সেগুলোর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। এই হিসাব যথেষ্ট সন্দেহজনক। এই হিসাবের কোনো ভিত্তি নেই। এটি মনগড়া হিসাব।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান  বলেন, বিবিএস প্রবৃদ্ধির যে হিসাব দিয়েছে, সেটি বাস্তবসম্মত নয়। করোনার কারণে গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে দেশে আমদানি-রফতানি-রাজস্ব আয় এবং কর্মসংস্থান-দারিদ্র্য-বেকারত্বসহ শিল্প ও সেবা খাতে যে বিশাল একটা ধাক্কা লেগেছে, বিবিএসের হিসাবে তার কোনো প্রতিফলন নেই।

তিনি বলেন, আমরা যদি অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোর দিকে তাকাই দেখব রফতানি আয় ১৮ শতাংশ কমেছে, দেশে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে এসেছে। এছাড়াও দেশের অর্থনৈতিক খাতগুলো লকডাউনের সময় ৯ সপ্তাহ ধরে একেবারে বন্ধ ছিল। এরকম একটা পরিস্থিতিতে এই ধরনের প্রবৃদ্ধি কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়।

সেলিম রায়হান বলেন, বিবিএস বলেছে তারা অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের  হিসাব করে এই প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় নির্ধারণ করেছে। তার মানে তারা নিজেরাই স্বীকার করেছে কোভিডের কারণে মার্চের পর এপ্রিল, মে ও জুন মাসে যে ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল, তা হিসাবের মধ্যে আসেনি। সুতরাং তারা যে হিসাব দিয়েছে, সেটি তথ্যভিত্তিক নয়।

তিনি বলেন,  অন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী নেগেটিভ গ্রোথ (ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি) হচ্ছে, এমনকি আমাদের আশপাশের সব দেশেই দেখা গেছে গ্রোথ নেগেটিভ অথবা শূন্যের কাছাকাছি। সেখানে বাংলাদেশে যে প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে, তার সাথে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই।

সানেমের জরিপের তথ্য তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক বলেন, সানেম গত জুলাই মাসে একটি জরিপ চালিয়েছিল। সেখানে বিনিয়োগ ও বিক্রির পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিল। ফলে আমার কাছে মনে হয়েছে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই পরিসংখ্যান পূর্বনির্ধারিতই ছিল, যেমন বাজেটের সময় বলা হয়েছিল যে এবার প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অর্থবছর শেষে এসে সেটাই দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে তথ্যের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রেখে যদি এরকম পূর্বনির্ধারিত অঙ্ক বসিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাছে ভুল মেসেজ যাবে। বিবিএসের পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে। বর্তমান বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নেওয়া দক্ষতার অভাব। এভাবে একটি সংখ্যা বলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির যে ভয়াবহতা ছিল, তা আন্ডারমাইন করা হয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান দিয়ে বিবিএস বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি এখন একটি রাজনৈতিক সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। পরিসংখ্যানের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবি জানান তিনি।

ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, আমাদের দেশে মার্চ মাসে করোনা শনাক্ত হয়েছে। ওই মাসেই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। কাজেই অর্থনীতিতে এর প্রভাব শেষ প্রান্তিকে এসে বেশি বোঝা যাওয়া কথা। কিন্তু দেশে প্রবৃদ্ধি নিয়ে একটা মোহ তৈরি হয়েছে। এর কারণ প্রবৃদ্ধিকে রাজনৈতিকভাবেও ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ প্রবৃদ্ধি কেবল একটি সংখ্যা নয়, অর্থনীতিতে এর তাৎপর্য অনেক। কিন্তু এখন আমরা দেখছি এটি স্রেফ রাজনৈতিক সংখ্যায় পরিণত হয়েছে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com